টেসলার শেয়ার পতনের জন্য 'বামপন্থীদের' দুষলেন ট্রাম্প, সমর্থন জানাতে নিজেও কিনলেন গাড়ি

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মঙ্গলবার হোয়াইট হাউসের বাইরে একটি গাড়িতে ওঠেন, তবে সেটি ছিল না তার নিরাপত্তাবেষ্টিত বিখ্যাত প্রেসিডেন্ট লিমোজিন 'দ্য বিস্ট'।
সাউথ লনের গাড়ির সারিতে যখন সাধারণত কালো এসইউভিগুলো দেখা যায়, সেখানে এদিন ট্রাম্পের জন্য অপেক্ষা করছিল পাঁচটি টেসলা। এর মধ্য থেকে একটি লাল মডেল এস গাড়ির সামনের আসনে বসে তিনি বলেন, 'অসাধারণ!'।
সোমবার রাতে ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছিলেন যে ইলন মাস্কের কোম্পানি টেসলার শেয়ার দর ১৫ শতাংশের বেশি কমে যাওয়ায় তাকে সমর্থন জানাতে 'নতুন টেসলা গাড়ি কিনবেন তিনি। সে কথা-ই রাখলেন তিনি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক্সে নতুন গাড়ির সাথে ছবিও পোস্ট করেছেন তিনি। মাস্ককে সাথে নিয়ে টেসলার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, 'প্রথমত, এটি একটি অসাধারণ গাড়ি—যতটা ভালো হওয়ার সম্ভব, আর দ্বিতীয়ত, ইলন মাস্ক তার শক্তি ও জীবন এই শিল্পে উৎসর্গ করেছেন, অথচ তার প্রতি অন্যায় আচরণ করা হয়েছে।'
এর আগে ট্রাম্প গাড়ী কেনার ঘোষণা দিয়ে দাবি করেন, 'চরমপন্থী বামপন্থীরা' টেসলা বয়কট করে মাস্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে। তবে শেয়ার বাজার বিশ্লেষকদের মতে, দরপতনের মূল কারণ টেসলার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে অনিশ্চয়তা এবং গত এক বছরে বিক্রি কমে যাওয়া।
বিশ্লেষকরা আরও বলছেন, ট্রাম্পের শুল্ক নীতিও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করছে, যা শেয়ারবাজারে প্রভাব ফেলছে।
ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত মাস্কের ব্যবসা ও সরকারি ভূমিকার মধ্যকার সীমারেখা আরও ঝাপসা করে তুলছে। কারণ মাস্ক বর্তমানে ট্রাম্প প্রশাসনের সরকারি ব্যয় কমানোর কার্যক্রমের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, অন্যদিকে তার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান টেসলা, স্পেসএক্স ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স (সাবেক টুইটার) যুক্তরাষ্ট্রের সরকার থেকে বিলিয়ন ডলারের চুক্তি পাচ্ছে। একই সময়ে ট্রাম্প প্রশাসন বিভিন্ন খাতে ব্যয় সংকোচন করছে।
মাস্ককে সমর্থন জানাতে ট্রাম্পের প্রকাশ্য টেসলা কেনা নজিরবিহীন একটি ঘটনা। এতে ট্রাম্পের প্রশাসন ও ব্যবসায়িক স্বার্থের মধ্যে সংঘাতের আশঙ্কা তৈরি হতে পারে বলে মনে করছেন নীতিনির্ধারকরা।
সোমবার মার্কিন শেয়ারবাজারে বড় ধরনের ধস নামে। বিনিয়োগকারীরা ট্রাম্পের শুল্ক নীতির অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে শেয়ার বিক্রি করতে থাকেন।
ট্রাম্প নিজেও মার্কিন অর্থনীতির শ্লথগতির ইঙ্গিত দিয়েছেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি একে 'পরিবর্তনের সময়কাল' বলে উল্লেখ করেন, যা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আরও অনিশ্চয়তা তৈরি করে।
বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্পের শুল্ক নীতি পণ্যের দাম বাড়াতে পারে, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এতে টেক কোম্পানির শেয়ারের ওপর চাপ তৈরি হয়, যার মধ্যে টেসলা ১৫ দশমিক ৪ শতাংশ দর হারায়। এনভিডিয়া, মেটা, আমাজন এবং গুগলের মূল প্রতিষ্ঠান অ্যালফাবেটের শেয়ারও উল্লেখযোগ্য হারে দরপতন হয়।
টেসলা শেয়ার পুনরুদ্ধার
মঙ্গলবার বাজার খোলার পর টেসলার শেয়ার ৩ দশমিক ৬ শতাংশ বেড়েছে, অন্য প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ারও কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তবে বিনিয়োগকারীদের উদ্বেগ কাটেনি।
সোমবার এক বিশ্লেষক সতর্ক করে দেন, টেসলার নতুন গাড়ি সরবরাহ পূর্বাভাসের চেয়ে কম হতে পারে। এর প্রভাবেই শেয়ারের দর এতটা কমেছে।
ট্রাম্প এরপর তার 'ট্রুথ সোশ্যাল' প্ল্যাটফর্মে রিপাবলিকান ও কনজারভেটিভদের আহ্বান জানান মাস্ককে সমর্থন জানাতে এবং টেসলা কিনতে। যদিও তার নীতিই বৈদ্যুতিক গাড়ি শিল্পের জন্য প্রতিকূল।
বৈদ্যুতিক গাড়ি নীতিতে ট্রাম্পের দ্বৈত অবস্থান
২০২১ সালে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এক আদেশে ২০৩০ সালের মধ্যে মার্কিন বাজারে বিক্রিত গাড়ির অন্তত অর্ধেক বৈদ্যুতিক করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলেন। ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে সেটি বাতিল করেছেন।
এছাড়া, সরকারি চার্জিং স্টেশনের জন্য বরাদ্দ অর্থও স্থগিত করেছেন তিনি। অন্যদিকে, তার শুল্ক নীতির কারণে কানাডা ও মেক্সিকো থেকে আমদানি করা টেসলা যন্ত্রাংশের খরচ বাড়বে, যা কোম্পানির লাভ কমিয়ে দিতে পারে।
তবে ট্রাম্প টেসলা ও মাস্কের প্রতি নিজের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, 'ইলন অসাধারণ কাজ করছে। কিন্তু চরমপন্থী বামপন্থীরা অবৈধভাবে ষড়যন্ত্র করে টেসলা বয়কট করছে।'
তিনি আরও বলেন, 'আমি কাল সকালেই নতুন একটি টেসলা কিনব, মাস্কের প্রতি সমর্থন জানাতে।'
রাজনৈতিক বিতর্কে জড়াচ্ছেন মাস্ক
টেসলার শেয়ার দর নির্বাচনের আগে যে অবস্থায় ছিল, এখন সেই পর্যায়ে ফিরে এসেছে। নির্বাচনের পর মাস্কের ব্যবসায়িক লাভের আশা করে বিনিয়োগকারীরা শেয়ার কিনলেও, এখন আবার শেয়ার বিক্রি শুরু করেছে।
মাস্ক সম্প্রতি 'ডিপার্টমেন্ট অব গভর্নমেন্ট এফিসিয়েন্সি' নামের একটি অনানুষ্ঠানিক সংস্থা চালাচ্ছেন, যার লক্ষ্য সরকারি খরচ কমানো। তবে এর কোনো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি নেই।
তিনি উগ্র ডানপন্থী মতবাদে সমর্থন দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রে তার অবস্থান বিতর্কিত হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি ওরেগনের পোর্টল্যান্ডে এক টেসলা শোরুমের সামনে ৩৫০ জন বিক্ষোভ করেছে, নিউইয়র্কেও বিক্ষোভ হয়েছে এবং কয়েকজন গ্রেপ্তার হয়েছে।
বিশ্লেষক লিনসে জেমস বলেন, 'মাস্কের রাজনীতি তার ব্র্যান্ডের ওপর কিছুটা প্রভাব ফেলছে, তবে দরপতনের মূল কারণ ব্যবসায়িক পারফরম্যান্স।'
বিক্রি কমেছে
ইউরোপ ও চীনে টেসলার নতুন গাড়ির অর্ডার গত এক বছরে প্রায় অর্ধেক কমে গেছে। ইউরোপে জানুয়ারিতে বিক্রি ৪৫ শতাংশ কমেছে, যা ইউরোপীয় অটোমোবাইল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী বড় পতন।
চীন ও অস্ট্রেলিয়াতেও বিক্রি কমেছে, যেখানে টেসলার জন্য বাজার খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, টেসলার শেয়ার অতিমূল্যায়িত ছিল, ফলে দরপতন অনেকটা সংশোধনমূলক। পাশাপাশি, চীনা বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাতাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতাও বাড়ছে।
বিনিয়োগকারীরা উদ্বিগ্ন যে মাস্ক তার কোম্পানিগুলোর প্রতি যথেষ্ট মনোযোগ দিচ্ছেন না।
ফক্স বিজনেসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি স্বীকার করেছেন যে, টেসলা, স্পেসএক্স এবং তার অন্যান্য ব্যবসা সামলানো তার জন্য 'অত্যন্ত কঠিন' হয়ে পড়েছে।
স্পেসএক্সের স্টারশিপ রকেটের সাম্প্রতিক দুটি উৎক্ষেপণ ব্যর্থ হয়েছে। তার মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স (সাবেক টুইটার) সম্প্রতি কারিগরি সমস্যার কারণে বন্ধ ছিল।