গৃহবন্দী ব্রাজিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট বলসোনারো; ট্রাম্পের সঙ্গে উত্তেজনা আরও বাড়ল

ব্রাজিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট জাইর বলসোনারোকে গৃহবন্দি করার নির্দেশ দিয়েছেন দেশটির সুপ্রিম কোর্ট। সোমবার এই নির্দেশ জারি করা হয়। একটি ব্যর্থ অভ্যুত্থান চেষ্টার মামলায় বিচার শুরুর আগেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো।
সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি আলেক্সান্দ্রে দে মোরেস এই আদেশ জারি করেন। গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগ তাকে নিষেধাজ্ঞার আওতায় এনেছিল।
বিচারপতি মোরেস বলেন, বলসোনারো তার বিরুদ্ধে দেওয়া নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেছেন। এমনকি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হস্তক্ষেপ পাওয়ার চেষ্টা করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
অন্যদিকে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ব্রাজিলের ওপর শুল্ক ও নিষেধাজ্ঞা আরও বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন। তবে বলসোনারোর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে অনড় রয়েছে ব্রাজিলের সর্বোচ্চ আদালত।
সুপ্রিম কোর্টে বলসোনারোর বিরুদ্ধে বিচার চলছে। অভিযোগ, ২০২২ সালের নির্বাচনে বামপন্থী নেতা লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভার কাছে পরাজয়ের পর তিনি মিত্রদের সঙ্গে মিলে সহিংসভাবে ফল উল্টে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করেছিলেন।
এ মামলার বিষয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প একে 'উইচ হান্ট' বা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা আখ্যা দিয়ে ব্রাজিলের পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর জানায়, বিচারপতি আলেক্সান্দ্রে দে মোরেস ব্রাজিলের প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহার করে বিরোধী কণ্ঠরোধ করছেন এবং গণতন্ত্রকে হুমকির মুখে ফেলছেন। তারা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, যারা নিষিদ্ধ কর্মকাণ্ডে সহায়তা করবে, তাদের সবাইকে জবাবদিহির মুখে পড়তে হবে।
তবে যুক্তরাষ্ট্র এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানায়নি। ট্রাম্প শুধু বলেছেন, প্রয়োজনে ব্রাজিলের পণ্যে আরও বেশি শুল্ক আরোপ হতে পারে।

সোমবার দেওয়া আদেশে বিচারপতি মোরেস বলসোনারোকে গৃহবন্দি করে মোবাইল ফোন ব্যবহার এবং কোর্ট অনুমোদিত ব্যক্তি ও আইনজীবী ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে দেখা করতে নিষেধ করেন।
বলসোনারোর মুখপাত্র জানিয়েছেন, সোমবার সন্ধ্যায় পুলিশ ব্রাসিলিয়ার বাসভবনে গিয়ে তাকে গৃহবন্দি করে এবং তার মোবাইল ফোন জব্দ করে।
বলসোনারোর আইনজীবীরা এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, তারা আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করবেন। তাদের দাবি, বলসোনারো কোনো আদালতের আদেশ লঙ্ঘন করেননি।
গত মাসে রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলসোনারো বিচারপতি মোরেসকে 'স্বৈরাচারী' বলে উল্লেখ করেন এবং তার বিরুদ্ধে জারি হওয়া নিষেধাজ্ঞাগুলোকে 'কাপুরুষোচিত কাজ' বলে অভিহিত করেন।
বলসোনারোর ঘনিষ্ঠজনরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, ট্রাম্পের কৌশল অনুকরণ করতে গিয়ে তার রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে পড়ছে। এতে প্রেসিডেন্ট লুলার বামপন্থি সরকারের প্রতি জনসমর্থন বাড়তে পারে।
তবে রোববার বলসোনারোর সমর্থকদের বড় জমায়েত, যা সাম্প্রতিক মাসগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়, এটি প্রমাণ করে ট্রাম্পের মন্তব্য ও বিচারপতি মোরেসের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা ডানপন্থিদের উৎসাহিত করেছে।
রিও ডি জেনিরোর এক সমাবেশে ফোনে যুক্ত হয়ে বলসোনারো তার ছেলে, সিনেটর ফ্লাভিও বলসোনারোর সঙ্গে কথা বলেন। অনেকেই এটিকে তার ওপর জারি থাকা আদালতের নিষেধাজ্ঞার পরীক্ষা হিসেবে দেখছেন।
বিচারপতি মোরেস জানান, সাবেক প্রেসিডেন্ট আদালতের আদেশ এড়িয়ে চলার একাধিক চেষ্টা করেছেন। তিনি রায়ে লিখেছেন, 'আইন অন্ধ হলেও বোকা নয়।'

সোমবার সিএনএন ব্রাজিলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সিনেটর বলসোনারো বলেন, বিচারক আলেক্সান্দ্রে দে মোরেসের আদেশ 'যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার প্রতিশোধ নেওয়ার স্পষ্ট উদাহরণ'। তিনি আরও বলেন, 'আমি আশা করি, সুপ্রিম কোর্ট ওই ব্যক্তি (মোরেস) যিনি এত অস্থিরতা তৈরি করছেন, তাকে থামাবে।'
বিচারকের গ্রেপ্তার-সংক্রান্ত সতর্কবার্তা ও অন্যান্য আদেশ সুপ্রিম কোর্ট বহাল রেখেছে।
এই আদেশ ও চলমান বড় মামলাটি দুই বছর ধরে চলা তদন্তের ফল। অভিযোগ, বলসোনারো নির্বাচনী ফল অস্বীকার করে একটি আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন, যার শেষ পরিণতি ছিল ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে ব্রাসিলিয়ায় তার সমর্থকদের দাঙ্গা। এই ঘটনা ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটল ভবনে ট্রাম্পের সমর্থকদের তাণ্ডবের সঙ্গে তুলনা করা হয়।
যেখানে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে একাধিক মামলার অগ্রগতি থমকে আছে, সেখানে ব্রাজিলের আদালত দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছে। এতে বলসোনারোর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়েছে এবং ডানপন্থী আন্দোলনের বিভাজন দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে নির্বাচন আদালত তাকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত সব ধরনের নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া থেকে নিষিদ্ধ করেছে।
বলসোনারোর ছেলে ও কংগ্রেসম্যান এদুয়ার্দো বলসোনারো যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান ঠিক তখনই, যখন তার বাবার বিরুদ্ধে ফৌজদারি বিচার শুরু হয়। ওয়াশিংটনে তিনি বাবার পক্ষে সমর্থন জোগাড় করতে গিয়েছিলেন বলে জানা গেছে।
এদুয়ার্দো দাবি করেন, তার যুক্তরাষ্ট্র সফর ট্রাম্পকে ব্রাজিলের বিরুদ্ধে নতুন শুল্ক আরোপে প্রভাবিত করেছে।
সোমবার গ্রেপ্তারের পর এদুয়ার্দো এক বিবৃতিতে বিচারক মোরেসকে 'নিয়ন্ত্রণহীন সাইকোপ্যাথ, যিনি প্রতিশোধ নিতে কখনো পিছপা হন না' বলে অভিহিত করেন।
গত মাসে ট্রাম্প বলসোনারোকে লেখা একটি চিঠি প্রকাশ করেন, যেখানে তিনি লেখেন, 'তোমার সঙ্গে অন্যায় হচ্ছে—একটি পক্ষপাতদুষ্ট ব্যবস্থার মাধ্যমে। এই বিচারকাজ এখনই শেষ হওয়া উচিত!'
ব্রাজিলের ফেডারেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী গ্রাজিয়েলা তেস্তা বলেন, বলসোনারোর গ্রেপ্তার ট্রাম্পকে ব্রাজিলের বিরুদ্ধে আরও পদক্ষেপ নিতে সুযোগ দিতে পারে। তার মতে, বলসোনারো ইচ্ছাকৃতভাবেই উত্তেজনা বাড়াচ্ছেন।
রাজনৈতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান থিংক পলিসির লিওনার্দো বারেত্তো বলেন, 'পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে, কারণ অনেকে ভাবতে পারেন এটা মোরেসের বিরুদ্ধে ম্যাগনিটস্কি নিষেধাজ্ঞার প্রতিশোধ।'
উল্লেখ্য, গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র মোরেসের সম্পদ জব্দ করেছিল।