রাজনীতির টিক-টক: পাকিস্তানের তোশাখানার কুখ্যাত ঘড়ি!

দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, বিদেশি দূত ও খ্যাতিমান ব্যক্তিদের দেওয়া উপহার রাষ্ট্রীয় তোশাখানায় জমা দেওয়ার নিয়ম থাকলেও– পাকিস্তানের রাজনীতিবিদরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এর অন্যায় সুবিধা নেন। সম্প্রতি আদালত দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এবং তাঁর স্ত্রী বুশরা বিবিকে রাষ্ট্রীয় উপহার বিক্রির দায়ে ১৪ বছরের কারাদণ্ডও দিয়েছেন। বুধবার ইসলামাবাদের দুর্নীতিবিরোধী আদালত ইমরানকে এ সাজা দেন।
আদালতের রায় রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত এমন সমালোচনা রয়েছে পাকিস্তানে। তবে সে যাই হোক, দেশটির রাজনীতিবিদদের বহুমূল্য রাষ্ট্রীয় উপহার নিজের কাছে রাখার ঘটনা এবারই প্রথম নয়।
পাকিস্তান সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে যারা দায়িত্ব পালন করেছেন, গত বছরের মার্চে তাঁদের রাষ্ট্রীয় উপহারের বিবরণ প্রকাশের আদেশ দেন লাহোর হাইকোর্ট। আর তাতেই উঠে আসে, রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তাদের দামি হাতঘড়ির প্রতি দুর্বলতা। অর্থাৎ, রাষ্ট্রীয় তোশাখানায় এই উপহার জমা না দিয়ে, তার বদলে কিছুটা মূল্য দিয়ে তাঁরা এগুলো নিজেদের কাছেই রেখে দেন।
দেশটির শীর্ষ গণমাধ্যম দ্য ডন জানাচ্ছে, বহুমূল্য ঘড়ি হাতিয়ে নেওয়ার প্রলোভন তাঁদের বেশিরভাগের পক্ষেই সামলানো সম্ভব হয়নি।
পাকিস্তানের এই শীর্ষ সরকারি পদাসীন ব্যক্তিরা গহনা, বিলাসবহুল গাড়ি, মূল্যবান প্রত্নবস্তু থেকে শুরু করে এমনকী অলঙ্কৃত অস্ত্র– এমন নানান উপহার পান বিদেশিদের থেকে। ২০০৮ সাল থেকে দেশটির প্রধান তিনটি রাজনৈতিক দলের রাজনীতিবিদরাই ক্ষমতায় থাকাকালীন তোশাখানায় জমা দেননি অনেক উপহার। এক্ষেত্রে বিশ্লেষণের জন্য হাতঘড়িকে বেঁছে নেওয়ার দুটি কারণ উল্লেখ করেছে দ্য ডন।
প্রথমত; আদালতের আদেশ মেনে প্রকাশিত রেকর্ডে এক নজর বোলালেই দেখা যায়, রাষ্ট্রীয় উপহারের মধ্যে ঘড়ির সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। ২০০২ সাল থেকে তোশাখানার রেকর্ডে ১ হাজার ২৬২টি ঘড়ির (পকেট ও টেবল ঘড়িসহ) উল্লেখ আছে।
দ্বিতীয়; এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো– আদালত তোশাখানার সম্পূর্ণ রেকর্ড প্রকাশের আদেশ দেওয়ার কয়েক মাস আগে থেকেই – ইমরান খান যেসব দামি ঘড়ি তোশাখানায় জমা না দিয়ে নিজের কাছে রেখেছিলেন বা বিক্রি করেছিলেন– সে সম্পর্কিত তথ্য বিভিন্ন গণমাধ্যমের কাছে ফাঁস করা হয়েছে।
তাছাড়া, লাখ লাখ রুপি দামের এসব ঘড়ি আত্মসাতের অভিযোগে ইমরানের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে পাকিস্তানের জাতীয় দুর্নীতিবিরোধী ব্যুরো (এনএবি)। এরমধ্যে বর্তমান সরকারের অনেক মন্ত্রী ইমরানকে 'ঘড়ি চোর' বলে সম্বোধন করে বলছেন, রাষ্ট্র ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনি তোশাখানার উপহার থেকে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হয়েছেন।
কিন্তু, সরকারি রেকর্ডে দেখা যাচ্ছে, 'ঘড়ি চোর' সম্বোধনকারীদের অনেকে নিজেরাই তোশাখানায় জমা না দিয়ে ঘড়ি নিজেদের কাছে রেখেছেন। সব দলের রাজনীতিবিদরাই আছেন 'ঘড়ি চোর'-দের কাতারে।
তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরতে, পাকিস্তানের বিগত তিনটি সরকারের এই কর্মকাণ্ডের বেসাতি তুলে ধরেছে দ্য ডন। এসব সরকারের নেতৃত্বে ছিল বড় তিন রাজনৈতিক দল। তবে তোশাখানার রেকর্ড শত শত পাতার হওয়ায়– এক্ষেত্রে শুধুমাত্র হাতঘড়িকে আলোচনার সুবিধার্থে বেঁছে নিয়েছে।
পাকিস্তান পিপলস পার্টির সরকার (২০০৮-১৩)
পিপিপি'র রাজনীতিবিদরা ৬০টি হাতঘড়ি নিজেদের কাছে রাখেন, যার মোট মূল্য ১ কোটি ২২ লাখ রুপি। তবে এগুলোর মূল্য হিসেবে তোশাখানায় তাঁরা মাত্র ২০ লাখ রুপি জমা দেন।
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানি, তাঁর পরিবার ও অতিথিরা ৯টি হাতঘড়ি উপহার নেন, যার দাম হিসেবে দেন মাত্র ৩ লাখ ৫১ হাজার ৫২৬ রুপি।
পিপিপির কো-চেয়ারম্যান এবং ২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি পদে থাকা আসিফ আলী জারদারি রাষ্ট্রীয় উপহারের ৮টি ঘড়ি নেন, যার বাজারমূল্য ৪৪ লাখ রুপি হলেও– তিনি তোশাখানায় এর দাম দেন মাত্র ৭ লাখ রুপি।
তৎকালীন বিদ্যুৎ ও পানিমন্ত্রী রাজা পারভেজ আশরাফ (২০১২ সালে গিলানির পরিবর্তে প্রধানমন্ত্রীও হন) এবং তাঁর পরিবার ১২ লাখ রুপি বাজারমূল্যের পাঁচটি হাতঘড়ি রেখে দেন, মাত্র ২ লাখ ৩০ হাজার ৪১০ রুপি পরিশোধ করে।
পিপিপি সরকারের পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী ড. আসিম হোসেন ৫ লাখ ৪৫ হাজার রুপি বাজারমূল্যের পাঁচটি হাতঘড়ি নেন। কিন্তু, দাম হিসেবে তোশাখানায় মাত্র ৯৫ হাজার ৯৬২ রুপি জমা দেন।
পিপিপি সরকারের অন্যান্য সাংসদ ও মন্ত্রীদের এ সংক্রান্ত তথ্য জানতে এখানে ক্লিক করুন।
পাকিস্তান মুসলীম লীগ নওয়াজ এর সরকার (২০১৩-২০১৮ সাল, , এবং ২০০৮ সালে কিছু সময় পিপিপির সাথে জোট সরকারে থাকাকালীন)
পিএমএল-এন এর জনপ্রতিনিধিরা রাষ্ট্রীয় উপহারের মোট ৫৪টি হাতঘড়ি নিয়েছেন, যার বাজারমূল্য ১৭ কোটি ৩০ লাখ রুপি। কিন্তু, তাঁরা তোশাখানায় এর দাম পরিশোধ করেন মাত্র ৩ কোটি ৪৫ লাখ রুপি।
নওয়াজ শরীফের মন্ত্রিসভায় পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী থাকা এবং ২০১৭ সালে তাঁর পরিবর্তে প্রধানমন্ত্রী হওয়া শহীদ খাকান আব্বাসী ও তাঁর পরিবার ১২টি বহুমূল্য হাতঘড়ি নিজেদের কাছে রাখেন (যারমধ্যে চারটি রোলেক্স ও তিনটি উবলো)। এগুলোর বাজারমূল্য ছিল ১০ কোটি ১ লাখ রুপি, কিন্তু তাঁরা দাম পরিশোধ করেন মাত্র ২০ লাখ রুপি।
ঘড়ির সংখ্যা ও দামের হিসাবে– প্রধান তিন রাজনৈতিক দলের রাজনীতিবিদদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছেন আব্বাসী।
পিএমএল-এন নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ ও তাঁর পরিবার রাষ্ট্রীয় উপহারের ১১টি হাতঘড়ি নেন, যারমধ্যে পাঁচটি ছিল রোলেক্স ব্র্যান্ডের। এসব ঘড়ির মোট দাম ১ কোটি ৭৬ লাখ রুপি, কিন্তু তাঁরা পরিশোধ করেন মাত্র ৩৫ লাখ রুপি।
এই সরকারে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন করা খাজা আসিফ পাঁচটি হাতঘড়ি নেন, যার মোট দাম ৪ কোটি ১৪ লাখ রুপি। কিন্তু, তোশাখানায় তিনি মূল্য পরিশোধ করেন মাত্র ৮২ লাখ রুপি।
এই সরকারের রাষ্ট্রপতি মামনুন হোসেন ও তাঁর পরিবারও পাঁচটি হাতঘড়ি নিজেদের কাছে রাখেন, যার দাম ছিল ২৭ লাখ রুপি। কিন্তু, তাঁরা পরিশোধ করেন মাত্র ৫ লাখ ৩৫ হাজার ৬০ রুপি।
পাকিস্তান তেহরিক -ই- ইনসাফ (শাসনকাল ২০১৮- ২০২২)
২ কোটি ৭০ লাখ টাকা তোশাখানায় জমা দিয়ে রাষ্ট্রীয় উপহারের ২০টি হাতঘড়ি নিয়েছেন পিটিআই এর নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা।
প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় দলের চেয়ারম্যান ইমরান খান ৭টি হাতঘড়ি নেন, যার দাম ৯ কোটি ৬৬ লাখ রুপি। ঘড়ির দামের দিক থেকে সব দলের রাজনীতিবিদদের মধ্যে তাঁর অবস্থান দ্বিতীয়।
ইমরান এগুলোর দাম হিসেবে ২ কোটি ১০ লাখ রুপি পরিশোধ করেন, এরমধ্যে তিনটি ছিল রোলেক্স এবং একটি গ্রাফ ব্র্যান্ডের।
ইমরানের প্রবাসী বিষয়ক সহকারী জুলফি বুখারী রাষ্ট্রীয় উপহার থেকে ২০ লাখ রুপি দামের তিনটি হাতঘড়ি নেন, এজন্য তিনি তোশাখানায় দিয়েছিলেন সাড়ে ৯ লাখ টাকা।
তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কুরেশি ১৮ লাখ রুপি দামের দুটি ঘড়ি তোশাখানায় জমা দেননি, তবে এর মূল্য হিসেবে ৮ লাখ ৭০ হাজার রুপি জমা দেন।
পিটিআই সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পারভেজ খাট্টাকও দুটি ঘড়ি তাঁর কাছে রেখে দেন। এগুলোর দাম ছিল ১৩ লাখ রুপি। কিন্তু, তিনি পরিশোধ করেন মাত্র ২ লাখ ৫৪ হাজার রুপি।
পিটিআই সরকারের অন্যান্য সাংসদ ও মন্ত্রীদের হাতঘড়ি নেওয়ার তথ্য জানতে দ্য ডনের এই লিঙ্কটি দেখুন।