জুলাই ঘোষণাপত্রে তুলে ধরা ইতিহাস এবং আওয়ামী লীগের বর্ণনা অত্যন্ত পক্ষপাতদুষ্ট: ডেভিড বার্গম্যান

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনুস প্রদত্ত 'জুলাই ঘোষণাপত্র' নিয়ে আমার প্রাথমিক কিছু মন্তব্য তুলে ধরা হলো—
১. এই ঘোষণাপত্রে তুলে ধরা ইতিহাস এবং আওয়ামী লীগের বর্ণনা অত্যন্ত পক্ষপাতদুষ্ট ও একপাক্ষিক। এতে মনে হয়, এসব বক্তব্য এসেছে সেইসব মানুষের পক্ষ থেকে, যারা শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের সরকারে থাকার সময়ের কাজকর্মের জন্য নয়, বরং দলটি তাদের কাছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচিত বলেই ঘৃণা করে। অন্য কথায়, এই ঘোষণাপত্রের অনেক কিছুই এমনভাবে লেখা হয়েছে, যেন এটি আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের প্রতিপক্ষ ও সমালোচকদের লেখা কোনো রাজনৈতিক দলিল।
২. সামগ্রিকভাবে এই ঘোষণাপত্রে যে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাস উপস্থাপন করা হয়েছে, তা সম্ভবত আরও বেশি সমস্যাজনক, যতটা আওয়ামী লীগ নিজের সরকার পরিচালনার সময় ১৯৭১ সালের যুদ্ধ নিয়ে তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক ইতিহাস তুলে ধরেছিল— যা কিনা তখন (আওয়ামী লীগের সমালোচকদের দ্বারা) তীব্রভাবে সমালোচিত হয়েছিল। এই ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে একদলীয় ও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাসকে বদলে আরেকটি আরও রাজনৈতিক ও পক্ষপাতদুষ্ট ইতিহাস প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। কে জানত, ৫ আগস্টের অর্থ এটা!
৩. ঘোষণাপত্রের ইতিহাসভিত্তিক বর্ণনায় রয়েছে বেশ কিছু উপেক্ষা, ভুল এবং বিকৃতি—
ঘোষণাপত্রে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের শাসনকাল কেবল একদলীয় শাসনব্যবস্থা বাকশাল হিসেবেই উপস্থাপিত হয়েছে। এতে স্বাধীনতা-পরবর্তী জাতি গঠনের আওয়ামী লীগ সরকারের নানা উদ্যোগ পুরোপুরি উপেক্ষিত হয়েছে (অনুচ্ছেদ ৪);
এখানে কিছুটা অদ্ভুতভাবে ১৯৭১ সালের পর 'জনগণের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থতার' জন্য দায় চাপানো হয়েছে সংবিধান প্রণয়নের পদ্ধতি ও কাঠামোর 'দুর্বলতার' ওপর। আওয়ামী লীগ ১৯৭২-৭৫ সালে প্রত্যাশা অনুযায়ী সাফল্য অর্জন করতে না পারার পেছনে নিশ্চয়ই অনেক কারণ থাকতে পারে, কিন্তু 'সংবিধান প্রণয়নের পদ্ধতি ও কাঠামো'র দোষ কেউ আগে দিয়েছেন, এমন কথা কখনো শুনিনি। (সম্ভবত এটি একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক গোষ্ঠীর দর্শন, যারা এখন বাংলাদেশে ক্ষমতাধর, এবং একটি নতুন সংবিধান প্রণয়নের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করাতে চায়।)
ঘোষণাপত্রে শেখ মুজিব ও তার পরিবারের ১৬ সদস্যকে সামরিক বাহিনী কর্তৃক ১৯৭৫ সালের আগস্টে হত্যা এবং তার মাধ্যমে সামরিক শাসনের সূচনার বিষয়টি একেবারেই উপেক্ষা করা হয়েছে (অনুচ্ছেদ ৪);
১৯৭৫ সালের নভেম্বরে শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের পর থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত সময়কাল, যখন বিএনপির নেতা জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় ছিলেন, সেটি ঘোষণাপত্রে অত্যন্ত সরলীকৃতভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে এটি ছিল 'সাধারণ জনগণের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর এক অভ্যুত্থান', যা 'বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার' পথ প্রশস্ত করে (অনুচ্ছেদ ৪)। এটি ঐ সময়কাল নিয়ে একটি অত্যন্ত প্রো-বিএনপি দৃষ্টিভঙ্গি।
ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, '১/১১'— অর্থাৎ জানুয়ারি ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিবর্তে সামরিক নিয়ন্ত্রিত সরকার ক্ষমতায় আসা— ছিল 'একটি ষড়যন্ত্রমূলক চুক্তির ফল' (অনুচ্ছেদ ৬)। বাস্তবতা হলো, ওই সময় বিএনপি সরকার নির্বাচন কারচুপির চেষ্টা করছিল এবং একমাত্র উপায় ছিল সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ, যা সে সময় অত্যন্ত জনপ্রিয় সিদ্ধান্ত ছিল।
ঘোষণাপত্রে আরও বলা হয়েছে, এই 'ষড়যন্ত্রমূলক চুক্তির' (১/১১) মাধ্যমেই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে (অনুচ্ছেদ ৬, ৭)। অথচ বাস্তবে, ২০০৯ সালের নির্বাচন কিছুটা অনিয়ম থাকলেও, সেটিকে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনগুলোর একটি হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং সে সময় আওয়ামী লীগ ছিল জনসমর্থনে এগিয়ে থাকা দল। কারণ, বিএনপি ২০০১-২০০৬ সময়কালে ক্ষমতায় থেকে নিজেদের সুনাম নষ্ট করেছিল।
২০০৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারে আসে— এই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি ঘোষণাপত্রে একেবারেই উল্লেখ করা হয়নি। পরিবর্তে সেখানে এমন একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, যেন আওয়ামী লীগ ১৬ বছর ধরে 'ফ্যাসিবাদী, অগণতান্ত্রিক এবং জনবিরোধী'ভাবে দেশ শাসন করেছে (অনুচ্ছেদ ৭)। এটি সম্পূর্ণভাবে অসত্য। বাস্তবে, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থেকে ধীরে ধীরে আরও বেশি অগণতান্ত্রিক ও কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠে।
৪. ঘোষণাপত্রে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের শাসনকালকে পুরোপুরি একপাক্ষিকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে—যেমনটি সাধারণত প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের প্রচারপত্রে দেখা যায়, কোনো ধরনের আইনি নথিতে নয়।
এই শাসনকাল বর্ণনায় ঘোষণাপত্রে যেসব বিশেষণ ব্যবহার করা হয়েছে, তা হলো: 'জনবিরোধী', 'স্বৈরাচারী', 'মানবাধিকারের পরিপন্থী', 'মাফিয়া ও ব্যর্থ রাষ্ট্র', 'মারাত্মক দুর্নীতি', 'ব্যাংক লুট', এবং 'পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জলবায়ুর বিরুদ্ধে ক্ষতিকর নীতি অনুসরণ'। এসব বর্ণনার কিছু কিছু নিঃসন্দেহে সত্য, তবে আওয়ামী লীগের আরেকটি দিক সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষিত হয়েছে এই ঘোষণাপত্রে। দলটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, মেয়েদের শিক্ষা, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায়ও উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। আওয়ামী লীগের শাসনামলে সবসময় দুটি সমান্তরাল বর্ণনা প্রচলিত ছিল—যদিও সময়ের সঙ্গে নেতিবাচক দিকগুলো ক্রমশ ইতিবাচক অর্জনকে ছাপিয়ে যায়।
ঘোষণাপত্রে আরও বলা হয়েছে (ধারা ১১): 'সমাজের সকল শ্রেণি, রাজনৈতিক দল, ছাত্র ও শ্রমিক সংগঠন বিগত প্রায় ষোলো বছর ধরে শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকারবিরোধী গণতান্ত্রিক অবস্থানের কারণে অব্যাহতভাবে কারাবরণ, নির্যাতন, মিথ্যা মামলার শিকার, হামলা, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছে।' এসব ঘটনা সত্য, তবে সেগুলো এখানে যেভাবে অতিরঞ্জিতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, বাস্তবে ঠিক ততটা ছিল না।
৫. ঘোষণাপত্রে ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের অধীনে সুপ্রিম কোর্টের একটি মতামতের উল্লেখ রয়েছে, যা অন্তর্বর্তী সরকারকে বৈধতা দিয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে (ধারা ২০)।
তবে যতদূর জানা যায়, সেই মতামতের স্বাক্ষরিত কপি এখনো কেউ দেখেননি, ফলে আদৌ এটি বিচারকরা স্বাক্ষর করেছিলেন কি না, তা নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে।
৬. ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে (ধারা ২৪), ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে আন্দোলনে অংশ নেওয়া 'ছাত্র ও জনগণ'-এর বিরুদ্ধে ভবিষ্যতে যেন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রসূত মামলা না হয়, সেজন্য তাদের আইনি সুরক্ষা দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে—এটি অবশ্যই যৌক্তিক।
কিন্তু ঘোষণাপত্রে ব্যবহৃত ভাষা এমন ইঙ্গিত দেয় যে, এই আইনি সুরক্ষা আওতায় সেইসব ব্যক্তিও পড়বেন, যারা আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগ কর্মী ও পুলিশ সদস্যদের হত্যা করেছেন (যেই প্রেক্ষাপটেই তা ঘটুক)। এটি একটি বড় সমস্যা, কারণ এটি 'আইনের শাসন'-এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক, যদিও ঘোষণাপত্রে পরবর্তী অংশে বলা হয়েছে যে বাংলাদেশের জনগণ ঠিক এই আইনের শাসনের জন্যই আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করছে।
৭. ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে যে, এই দলিলটি 'পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারের প্রণীত সংস্কারকৃত সংবিধানের সংযোজিত সূচিতে অন্তর্ভুক্ত হবে' (ধারা ২৭)।
এতটা পক্ষপাতদুষ্ট ও রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত একটি নথি যদি কখনো সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়, তা নিঃসন্দেহে একটি লজ্জাজনক ঘটনা হবে।
৮. তবে ঘোষণাপত্রে কিছু ইতিবাচক দিকও রয়েছে। বিশেষ করে:
এতে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে যথাযোগ্য গুরুত্ব দিয়ে ইতিহাসে তার সঠিক স্থান দেওয়া হয়েছে এবং বলা হয়েছে, সেই যুদ্ধ ছিল 'উদার গণতান্ত্রিক' রাষ্ট্রের জন্য (ধারা ১, ২);
এতে আন্দোলন ও গণজাগরণ যথাযথভাবে চিত্রায়িত হয়েছে;
এতে বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষা স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। যেমন—তারা 'সুশাসন ও অবাধ নির্বাচন, আইনের শাসন, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার এবং রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আইনসম্মত গণতান্ত্রিক সংস্কার' চায় (ধারা ২২); এবং 'একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা, যা আইনের শাসন, মানবাধিকার ও নৈতিক মূল্যবোধ রক্ষা করে এবং দুর্নীতি ও শোষণমুক্ত' (ধারা ২৫);
এতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীসহ অন্যান্য বাহিনীর হাতে নিহতের সংখ্যা ছিল 'প্রায় এক হাজার'—যা অধিকতর বাস্তবসম্মত; কারণ সাধারণত আরও অতিরঞ্জিত সংখ্যা দাবি করা হয়।
৯. সবকিছু মিলিয়ে, ইউনুস যিনি কখনো দলীয় রাজনীতিতে সরাসরি জড়িত ছিলেন না এবং যিনি অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে এসেছেন দলীয় নিরপেক্ষতার অবস্থান থেকে, তিনিই এই ঘোষণাপত্রে নিজের নাম যুক্ত করেছেন—এটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
নির্বাচনের পরে ইউনুসের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা অজানা। তবে অনেকের দৃষ্টিতে, এই চার্টারে তাঁর সংশ্লিষ্টতা তাঁর একসময়ের উজ্জ্বল ভাবমূর্তির শেষ অধ্যায় রচনা করেছে।
১০. এই ঘোষণাপত্রটি আরও সংক্ষিপ্ত ও পরিস্কার হওয়া উচিত ছিল। ১৯৭১ সালের যুদ্ধসংক্রান্ত ধারা ১ ও ২ ছাড়া অন্য কোনো রাজনৈতিক ইতিহাস সংযোজন না করে, সরাসরি ধারা ১৩-র একটি সংশোধিত সংস্করণে যাওয়া যেত—যেখানে আওয়ামী লীগের ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদী চরিত্রের কথা বলা হয়েছে—এরপর ধারাবাহিকভাবে ১৫ থেকে ২৭ নম্বর ধারাগুলো সংশোধিত আকারে উপস্থাপন করলে দলিলটি অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য হতো।
ডেভিড বার্গম্যান ব্রিটিশ সাংবাদিক। লেখাটি তার ফেসবুক থেকে নেওয়া।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।