জুলাই ঘোষণাপত্র ‘অসম্পূর্ণ’, শহীদের সংখ্যা নিয়ে আপত্তি: এনসিপি

জুলাই ঘোষণাপত্রে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় উল্লেখ না থাকায় সেটিকে অসম্পূর্ণ বলে মনে করছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। তবে দলটি আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে কোনো আপত্তি না থাকার কথাও জানিয়েছে।
আজ (৬ আগস্ট) দুপুরে রাজধানীর বাংলামোটরে এনসিপির অস্থায়ী কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন দলটির সদস্যসচিব আখতার হোসেন।
সংবাদ সম্মেলনটি আয়োজন করা হয় জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে পঠিত ঘোষণাপত্র ও প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ নিয়ে দলের পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়া জানাতে।
আখতার হোসেন বলেন, 'কিছু বিষয় যদি জুলাই ঘোষণাপত্রের মধ্যে উল্লেখ থাকত, তাহলে এটি পরিপূর্ণ হতো বলে তারা মনে করছেন।'
তিনি ঘোষণাপত্রে অনুপস্থিত বিষয়গুলোর তালিকা তুলে ধরে বলেন, 'ঘোষণাপত্রে উপনিবেশবিরোধী লড়াইয়ের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এই ভূখণ্ডের মানুষের উপনিবেশবিরোধী লড়াইয়ের অন্যতম রেফারেন্স পয়েন্ট ১৯৪৭-কে এখানে উল্লেখ করা হয়নি। আমরা মনে করি, এই বাংলাদেশের বা এই ভূখণ্ডের একটা সার্বভৌম রাষ্ট্র পাওয়ার পেছনে ১৯৪৭, ১৯৭১ এবং আমাদের চব্বিশের আন্দোলন- এই সবকিছুর একটি সম্মিলন এই ঘোষণাপত্রকে আরও সমৃদ্ধ করতে পারত।
শহীদের সংখ্যা নিয়ে তিনি বলেন, 'এ ঘোষণাপত্রে (চব্বিশের) শহীদের সংখ্যার ব্যাপারে 'প্রায় এক হাজার' শব্দবন্ধ ব্যবহার করা হয়েছে। অথচ জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১ হাজার ৪০০ মানুষ এই অভ্যুত্থানের সময়কালে শহীদ হয়েছেন। এ পরিসংখ্যান আমাদের সবার জানা। সে ক্ষেত্রে এক বছর ধরে সরকার যে শহীদ ও আহত ব্যক্তিদের প্রকৃত সংখ্যা নির্ণয় করতে ব্যর্থ হয়েছে, তার একটা ছাপ আমরা এই ঘোষণাপত্রের মধ্যে দেখতে পেলাম।'
এছাড়া, সাম্প্রতিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ গণআন্দোলনগুলোর অনুপস্থিতি নিয়েও হতাশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, 'পিলখানা হত্যাকাণ্ড, শাপলা গণহত্যা, বিচারিক হত্যাকাণ্ড, ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন, ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যার বিরুদ্ধে আগ্রাসনবিরোধী আন্দোলন, মোদিবিরোধী আন্দোলনের কথা এ ঘোষণাপত্রে উল্লেখ নেই।'
সংবিধান ও সাংবিধানিক অন্তর্ভুক্তি প্রসঙ্গ
এনসিপির এই সদস্যসচিব বলেন, 'সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টা আমাদের কাছে মনে হয়েছে, এই ঘোষণাপত্রের ২৫ ও ২৭ নম্বর পয়েন্টে আয়োজিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নির্বাচিত সরকারের সংস্কারকৃত সংবিধানের তফসিলে এ ঘোষণাপত্রকে উল্লেখ করার কথা বলা হয়েছে।'
এ প্রসঙ্গে তিনি এনসিপির অবস্থান স্পষ্ট করে বলেন, 'এনসিপি দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশে একটি নতুন সংবিধানের দাবি জানিয়ে আসছে। সেই লক্ষ্যে গণপরিষদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নতুন সংবিধান, সংবিধান পুনর্লিখনের দাবি এনসিপি সরকারের কাছে করে আসছে।'
তিনি যোগ করেন, 'ঐকমত্য কমিশনে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংস্কারের বিভিন্ন বিষয়বস্তুতে ঐকমত্য তৈরি হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেখানে বাস্তবায়নের পথ কী হবে, তা নিয়ে আলোচনা করা হয়নি। সে ক্ষেত্রে যখন এই ঘোষণাপত্রকে পরবর্তী সংস্কারকৃত সংবিধানের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়, স্বভাবতই এনসিপি যে নতুন সংবিধানের দাবি জানিয়েছে, গণপরিষদের কথা বলেছে, সংবিধানের অন্তর্ভুক্তির কথা বলেছে, সেই প্রক্রিয়াকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়।'
তিনি দাবি জানিয়ে বলেন, 'বাংলাদেশে যে নতুন রাজনৈতিক জনগোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটেছে, তাদের অভিপ্রায়কে ধারণ করতে একটি নতুন সংবিধানই সমাধান এবং সেই নতুন সংবিধানের প্রস্তাবনার মধ্যেই জুলাই ঘোষণাপত্রকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানাই।'
তিনি আরও বলেন, 'ঐকমত্য কমিশনে জুলাই সনদ কার্যকরের পন্থা হিসেবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার কথা বলা হয়েছে। আমরা দেশবাসীর কাছে এর আগেই খোলাসা করে বলতে চাই, জুলাই সনদে যে সংস্কারগুলোর বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য তৈরি হয়েছে এবং কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেসব সংস্কারের বিষয়বস্তুকে অন্তর্বর্তী সরকারের সময়কাল থেকেই বাস্তবায়ন করতে হবে। লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার (এলএফও) করে এটাকে কার্যকর করতে হবে। জুলাই সনদ ও ঘোষণাপত্রের কার্যকারিতার ভিত্তিতে সামনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে।'
নির্বাচন নিয়ে অবস্থান
নির্বাচন প্রসঙ্গে আখতার হোসেন বলেন, 'নির্বাচন আয়োজনের আগে অন্তর্বর্তী সরকারের অবশ্যপালনীয় কিছু কর্তব্য রয়েছে। গণহত্যাকারীদের বিচার করা এবং রাষ্ট্রকাঠামোর গুণগত পরিবর্তনের জন্য সংস্কারের ম্যান্ডেট নিয়ে এ সরকারের যাত্রা শুরু হয়েছে। অতএব নির্বাচনের আগেই বিচারকে দৃশ্যমান করা এবং সংস্কারকে বাস্তবায়ন করা এ সরকারের অবশ্য কর্তব্য।'
'একই সঙ্গে নির্বাচনের আগেই সরকারকে মাঠ প্রশাসনের নিরপেক্ষতা এবং লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি ও নিশ্চয়তা দিতে হবে। জুলাই ঘোষণাপত্রে দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলো অবশ্যই বাংলাদেশে বাস্তবায়িত করতে হবে,' তিনি যোগ করেন।
সংবাদ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব (দপ্তর) সালেহউদ্দিন সিফাত। উপস্থিত ছিলেন দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব, যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন প্রমুখ।