যেভাবে লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে চুরি হওয়া কিয়ানু রিভসের ঘড়ি পৌছাল চিলির ডাকাতদের হাতে

লস অ্যাঞ্জেলেসে অভিনেতা কিয়ানু রিভসের বাড়ি থেকে চুরি হওয়া ছয়টি দামী ঘড়ি সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দিয়েছে চিলির কর্তৃপক্ষ। এই ঘড়িগুলো প্রায় ৯ হাজার কিলোমিটার দূরে সান্তিয়াগোর মার্কিন দূতাবাসে এফবিআই'র কাছে হস্তান্তর করা হয়।
এই বিলাসবহুল ঘড়িগুলোর সন্ধান পাওয়া ছিল পুরোপুরি কাকতালীয়—এমনটাই জানিয়েছে দূতাবাস।
চিলির পুলিশ জানিয়েছে, এই ঘড়িগুলো উদ্ধার হয়েছে সান্তিয়াগোর পূর্বাঞ্চলে সংঘটিত বাড়ি চুরির একটি বিস্তৃত তদন্তের অংশ হিসেবে। মূলত একটি সংঘবদ্ধ ডাকাতচক্রের সন্ধানে চালানো অভিযানে এগুলো পাওয়া যায়। চুরিকৃত সামগ্রীর মধ্যে একটি ঘড়িতে খোদাই করা লেখার সূত্র ধরে গোয়েন্দারা নিশ্চিত হন, এটি কিয়ানু রিভস তার 'জন উইক ৪'-এর স্টান্ট টিমকে উপহার দিয়েছিলেন।
চিলি পুলিশের অপরাধ তদন্ত শাখার ডেপুটি প্রেফেক্ট মার্সেলো ভারাস জানান, ২০২৩ সালে চক্রটি চিলিতে ধারাবাহিক ডাকাতি করছিল। তাদের সহিংসতার কারণে বিষয়টি আলোচনায় আসে এবং পুলিশি চাপ বাড়লে তারা দেশ ছেড়ে বিদেশে পালিয়ে যায়। সেখানে গিয়েও তারা একই কৌশলে ফাঁকা বাড়িতে ঢুকে চুরি চালিয়ে যেতে থাকে। তবে কেউ বাড়িতে থাকলে তারা সহিংস আচরণ করত বলেও জানান ভারাস।
অভিযান চালানোর সময় চিলির সান্তিয়াগোর পেনালোলেন এলাকায় একটি বাড়ি থেকে এক সন্দেহভাজনকে খুঁজে পায় তদন্তকারীরা। সেখান থেকেই উদ্ধার হয় বেশ কিছু মূল্যবান সামগ্রী, যার মধ্যে ছিল একাধিক ঘড়ি। এর একটির পেছনে খোদাই করা ছিল একটি বিশেষ বার্তা।

চিলির গোয়েন্দা কর্মকর্তা মার্সেলো ভারাস বলেন, 'আমাদের এক গোয়েন্দা, যিনি জন উইক সিরিজের বড় ভক্ত, ঘড়িটি দেখে সঙ্গে সঙ্গেই চিনে ফেলেন। তিনি আগে পড়েছিলেন যে রিভস তার স্টান্ট টিমের প্রত্যেককে একটি করে ঘড়ি উপহার দিয়েছিলেন।'
তিনি আরও জানান, 'আমরা ঘড়িটির উৎস ধরে অনুসন্ধান শুরু করি এবং শেষ পর্যন্ত নিশ্চিত হই যে এটি সত্যিই সেই উপহৃত ঘড়িগুলোর একটি।'
সিনেমা থেকে বাস্তব জীবনে
২০২১ সালে 'জন উইক: চ্যাপ্টার ৪' সিনেমার কাজ শেষে রিভস তার স্টান্ট টিমের পাঁচ সদস্যকে উপহার দেন রোলেক্স সাবমেরিনার মডেলের ঘড়ি। প্রতিটি ঘড়িতে খোদাই করা ছিল: 'থ্যাংক ইউ, জেডব্লিউ৪, ২০২১, দ্য জন উইক ফাইভ'।
চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোয় যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে যখন কিয়ানু রিভসের খোয়া যাওয়া দামী ঘড়িগুলো এফবিআই'র হাতে তুলে দেওয়া হয়, তখন চিলির প্রসিকিউটর ক্লাউডিয়া বার্রাসা স্পষ্ট করে বলেন—চুরি ও পাচারের ঘটনায় এখনো পর্যন্ত কোনও সরাসরি যোগসূত্র মেলেনি। অর্থাৎ, যেই দল রিভসের বাড়িতে চুরি করেছিল, তাদের সঙ্গে চিলিতে ঘড়িগুলো নিয়ে আসা অপরাধীদের সম্পর্ক প্রমাণিত হয়নি।
তবে চিলির পুলিশ কর্মকর্তা মার্সেলো ভারাস বলছেন, অভিযুক্ত এক ব্যক্তির কাছ থেকে উদ্ধার করা মোবাইল ফোনে যেসব তথ্য মিলেছে, তা ভিন্ন ইঙ্গিত দেয়। ওই ফোনে যুক্তরাষ্ট্রে তোলা কয়েকটি ছবি পাওয়া গেছে, যেখানে চুরি যাওয়া ঘড়িগুলোর একটি, একটি আগ্নেয়াস্ত্র এবং কিয়ানু রিভসের ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখা যায়। তদন্তকারীরা ধারণা করছেন, ছবিগুলো রিভসের বাড়িতেই তোলা হয়েছে।
ভারাস জানান, আইনি প্রক্রিয়ার কারণে ঘড়িগুলো ফিরিয়ে দেওয়ার আগে কিয়ানু রিভসের স্বীকৃতি পাওয়া জরুরি ছিল। তিনি লস অ্যাঞ্জেলেস পুলিশ স্টেশনে ছবির মাধ্যমে নিশ্চিত করেন যে, উদ্ধার হওয়া ঘড়িগুলো কিয়ানু রিভসেরই।
আশ্চর্যজনকভাবে, কিয়ানু রিভসের সর্বাধিক জনপ্রিয় চরিত্র 'জন উইক'-এও তিনি এমন এক সাবেক খুনির ভূমিকায় অভিনয় করেন, যার বাড়িতে চুরির পর (এবং প্রিয় কুকুরটি হত্যার পর) তার প্রতিশোধের যাত্রা শুরু হয়। বাস্তব জীবনেও রিভস বারবার অনধিকারপ্রবেশ ও চুরির শিকার হয়েছেন।
২০২৩ সালে ঘটে যাওয়া সর্বশেষ চুরির ঘটনায় রিভস প্রায় ৭০ লাখ ডলারের সম্পদ হারান বলে জানান চিলির পুলিশ ও অপরাধ তদন্ত বিভাগের উপপরিচালক হুগো হ্যাগার।
এর আগেও, ২০১৪ সালে 'জন উইক' সিরিজের প্রথম চলচ্চিত্র মুক্তির কয়েক মাস আগে মাত্র তিন দিনের ব্যবধানে রিভসের লস অ্যাঞ্জেলেসের বাড়িতে দুইবার অনধিকারপ্রবেশ ঘটে। যদিও ওই ঘটনায় কিছু চুরি হয়নি, তবে তার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ তখনই শুরু হয়েছিল।
আন্তর্জাতিক চক্রের জাল
তদন্তে উঠে এসেছে, ২০২৩ সালে সংঘটিত চুরির ঘটনার পর চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন দেশে পালিয়ে যায় এবং একই কৌশলে চুরি চালিয়ে যেতে থাকে। চিলির তদন্ত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ঘড়িগুলোর সঙ্গে একটি মোবাইল ফোনও উদ্ধার হয়, যাতে রিভসের বাড়িতে তোলা ছবি, একটি আগ্নেয়াস্ত্র এবং অভিনেতার ড্রাইভিং লাইসেন্সের ছবিও ছিল।
এছাড়া, এই চক্রের একজন যুক্তরাষ্ট্রে চুরি চালিয়ে যায়, আরেকজন আর্জেন্টিনায় গিয়ে গ্রেপ্তার হয়। কারও বিরুদ্ধে ডাকাতি ও শুল্ক জালিয়াতির অভিযোগে মামলা চলছে, আবার এক সদস্য চক্রগত সংঘর্ষে নিহত হয়েছে।
ভিসা সুবিধা নিয়ে বিতর্ক
যুক্তরাষ্ট্রে চিলির নাগরিকদের জন্য বিদ্যমান ভিসা ছাড় সুবিধা নিয়েও এই ঘটনার প্রেক্ষিতে নতুন করে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। কিছু মার্কিন কর্মকর্তার দাবি, এই সুযোগের অপব্যবহার করে সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্যরা সহজেই যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করে অপরাধ করছে।
তবে সম্প্রতি চিলি সফরে এসে মার্কিন স্বরাষ্ট্রসচিব ক্রিস্টি নোম বলেন, এই কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে এবং চিলির সঙ্গে যৌথ বায়োমেট্রিক নজরদারি প্রকল্প সম্প্রসারণ করা হবে।
অবশেষে ফিরছে ঘড়িগুলো
সান্তিয়াগোর মার্কিন দূতাবাসে এক আনুষ্ঠানিক আয়োজনে ঘড়িগুলো এফবিআই'র কাছে হস্তান্তর করা হয়। দূতাবাসের কর্মকর্তা ব্লেইন ফ্রিস্টোন জানিয়েছেন, তিনি ব্যক্তিগতভাবে ঘড়িগুলো রিভসের কাছে ফিরিয়ে দেবেন।
চিলি পুলিশের মতে, চোরেরা সাধারণত এসব মূল্যবান জিনিস পার্সেল করে বা নির্দোষ পর্যটকের মাধ্যমে এক দেশ থেকে আরেক দেশে পাঠায়, যাতে বিমানবন্দরে সন্দেহ না হয়।
'বিশ্বখ্যাত কোনও তারকার ব্যক্তিগত স্মারক জিনিস হলে, কালোবাজারে এর দাম আরও অনেকগুণ বেড়ে যায়,'—বলেন তদন্ত কর্মকর্তা মার্সেলো ভারাস।