হলদে পরীর দেশে

আবার চলিয়াছি যুগোশ্লাভিয়া। সেখানে আন্তর্জাতিক লোকসংগীত মহাসভার অধিবেশন বসিবে। ভূগোলে আমি কোনো দিনও ভালো ছেলে ছিলাম না। যুগোশ্লাভিয়া কোন দেশ, কেমন তার লোকজন, কোন পথ দিয়া কীভাবে সেখানে যাইতে হইবে, কিছুই জানি না। আমার ছেলে জামাল আর কামালের মানচিত্রের বইগুলি সামনে লইয়া পথের নির্দেশ ঠিক করি। ভূগোলের বই পড়িয়া ওদেশের লোকজনের কথা জানিতে চেষ্টা করি; কিন্তু আমাদের দেশের পাঠ্যবইগুলিতে কি ওসব জানার উপায় আছে—কোথায় যুগোশ্লাভিয়ার রাজধানী, কোথায় কোন বন্দর, কোথায় কোন নদী? শুধু নতুন নতুন নামে ভূগোলের বই ভর্তি। এত সর্বনাম শব্দ মুখস্থ করিতে হইত বলিয়াই ছোটবেলায় ভূগোল বইখানা আমার কাছে মাস্টার মহাশয়ের কঠিন বেতের চাইতেও ভয়ংকর বলিয়া মনে হইত। দেশের লোকজনের কথা বলিয়া, তাহার আবহাওয়ার কাহিনী বর্ণনা করিয়া ভূগোলের বইকে শিশুদের হৃদয়গ্রাহী করিবার ইচ্ছা কোনো পাঠ্যবই লেখকেরই দেখি না। কে আমাদের দেশের পাঠ্যবইগুলি নতুন করিয়া গড়িযা তুলিবে?
যাক সেকথা। করাচি আসিয়া নানা দেশের দূতাবাসে যাইয়া সেই দেশে প্রবেশের অনুমতিপত্র লইলাম। তুরস্কের দূতাবাস আমাকে অতি ভদ্রভাবেই গ্রহণ করিল। অন্যান্য দূতাবাসের কেহ কেহ আমাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসাইয়া রাখিলেন। কেহ দুই-তিনবার তাঁহাদের নিকট আমাকে দৌড়াদৌড়ি করাইলেন। কোনো কোনো দূতাবাসে পাহারাদার পাইকের বাধা অতিক্রম করিয়া যথাস্থানে প্রবেশ করিতে আমাকে গলদঘর্ম হইতে হইল। যুগোশ্লাভিয়ার দূতাবাসে আসিয়া আমি একেবারে অবাক হইয়া গেলাম। এখানে না আছে পাহারাদার পাইক, না আছে শাসনপ্রকরণের জাঁকজমক। দুইটি তরুণ কর্মচারী আমাকে বন্ধুর মতো গ্রহণ করিলেন। সিগারেট আনিয়া দিলেন, চা পান করিতে দিলেন। তাঁহারা ভালোমতো ইংরেজি বলিতে পারেন না। একজন কিছু বলিতে যাইয়া ঠেকিয়া গেলে অপরজন তাঁহাকে ইংরেজি কথা জুটাইয়া দিয়া সাহায্য করিলেন। অতি বিনয়ের সঙ্গে তাঁহারা আমাকে বলিলেন, 'আমাদের দূতাবাসে আপনিই প্রথম পাকিস্তানি আমাদের দেশে যাচ্ছেন। এর আগে আমরা অপর কাউকে আমাদের দেশে প্রবেশের ছাড়পত্র দিই নাই। আমরা নতুন লোক। আপনার প্রবেশপত্র লিখতে তাই আমাদের কিছুটা দেরি হবে। সেজন্য কিছু মনে করবেন না। এই বইগুলি দিই। আপনি ততক্ষণ পড়ুন।'
সুচিন্তিত দুইখানা ম্যাগাজিনে যুগোশ্লাভিয়ার জনগণের নানা বিভাগে সাফল্যের চিত্রিত উপাখ্যান। আমি সেই বইগুলির মধ্যে চোখ বুলাইয়া যুগোশ্লাভিয়া দেশের বিষয়ে মনে-মনে একটা ধারণা রচনা করিতেছিলাম। অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁহারা আমাকে তাঁহাদের দেশের প্রবেশপত্র দিয়া দিলেন। খুঁটিয়া খুঁটিয়া আমি তাঁহাদের দেশের নানা তথ্য জানিয়া লইলাম। বিদায়ের সময় তাঁহারা আমাকে বলিলেন, 'আপনি আমাদের দেশে যাচ্ছেন, এ-খবর আমরা ইতিপূর্বে সংবাদপত্রে পড়েছি। আপনি জনগণের কবি। আশা করি আমাদের জনগণের রাষ্ট্র যুগোশ্লাভিয়া আপনার ভালো লাগবে।' আমি তাঁহাদের সঙ্গে বিদায় করমর্দন করিয়া বলিলাম, 'আমার যুগোশ্লাভিয়া যাত্রার প্রথম আতিথেয়তা আপনাদের নিকট হতে আরম্ভ হলো। আমি মুগ্ধ হলাম আপনাদের সুন্দর সৌজন্যে। আশা করি আপনাদের সুন্দর দেশে যেয়ে আপনাদের মতোই অনেক বন্ধু পাব।'
করাচি যাইয়া এবার একটি সুন্দর দম্পতির সঙ্গে আমার পরিচয় হইল। মি. মোহাম্মদ হোসেন আর মিসেস রোজী হোসেন। ইঁহাদের মধ্যে কাহাকে রাখিয়া কাহার প্রশংসা বেশি করিব, স্থির করিবার উপায় নাই। সুন্দর করাচিতে থাকিয়া তাঁহারা পূর্ববঙ্গের কুটির উন্নয়নে বক্তৃতা করিয়া, সমসাময়িক কাগজে প্রবন্ধ লিখিয়া নানারূপ জলসার অনুষ্ঠান করিয়া আমাদের এই প্রদেশকে তাঁহারা ওখানকার অবাঙালি ভাইদের মধ্যে সোন্দর্যয় করিয়া তুলিতেছেন। ওখানে বসিয়া পূর্ববঙ্গের সাহিত্যের সকল খবর তাঁহারা ভালোমতো পান না। চায়ের নিমন্ত্রণে ডাকিয়া আনিয়া আমার নিকট হইতে তাঁহারা পূর্ববঙ্গের সাহিত্যিক-প্রচেষ্টার নানা খবর খুঁটিয়া খুঁটিয়া জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। মিসেস হোসেন উর্দুভাষী জানেন। তাঁহার নিকট হইতে আমি বর্তমান উর্দু সাহিত্যের নামকরা লেখকদের বিষয়ে নানারূপ খবর জানিয়া লইলাম।

তাঁহাদের চায়ের আসরে একজন পাগলা শিল্পীর সঙ্গে পরিচয় হইল। শিল্পীর নাম সুলতান। যশোর জেলায় বাড়ি। কলিকাতা আর্টস স্কুল হইতে পাস করিয়া তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে ও পশ্চিম ভারতে কপর্দকহীন অবস্থায় দশ-বারো বৎসর ঘুরিয়া বেড়াইতেছেন। সম্প্রতি করাচিতে তাঁহার ছবিগুলির প্রদর্শনী হইয়া গিয়াছে। সেই ছবিগুলির সমালোচনা করিয়া করাচির সাময়িক কাগজগুলিতে বহু প্রবন্ধ বাহির হইয়াছে। শিল্পী সুলতানকে পশ্চিম পাকিস্তানে পরিচিত করাইতে এই হোসেন দম্পতির দান কোনো অংশে কম নয়। রাত প্রায় দশটা অবধি। হোসেন সাহেবের চালের মজলিশ গরম করিয়া পাগলা শিল্পী সুলতানকে সঙ্গে লইয়া ঘরে বাহির হইলাম। আমি থাকি শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের বাড়িতে। শিল্পী থাকেন স্যার আবদার রহিমর বাড়িতে। এক বাড়ি হইতে অপর বাড়ির ব্যবধান পাঁচ মিনিটের পথ। এই দূরত্বটুকু অতিক্রম করিতে আমাদের রাত একটা বাজিয়া গেল। শিল্পীর অঙ্কিত চিত্রের চাইতেও শিল্পীর বৈচিত্র্যময় জীবন আমার কাছে আরও লোভনীয় মনে হইল।
কত পথ সে ঘুরিয়াছে, কত গাছের ছায়া-শীতল স্নেহ তাহাকে আকর্ষণ করিয়াছে। পথের সমস্ত লাভক্ষয় ছিন্ন করিয়া আপন সৃষ্টির দুরন্ত ক্ষুধায় সে হাহাকার করিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। কোথায় পশ্চিম দেশের এক মস্ত জমিদারের গৃহে সে কিছুদিন বাস করিয়াছিল। জমিদারের বারো বছর বয়স্ক লাল টুকটুকে মেয়েটি হাসনা তার কাছে ছবি আঁকা শিখিত। কত বৎসর শিল্পী তাহাকে ছাড়িয়া আসিয়াছে। হাসনা কিন্তু তাকে ভুলিতে পারে নাই। সেদিন তার চিঠি আসিয়াছে, 'ওস্তাদ সাহেব! আমাদের আসমানের পশ্চিম কিনারায় সূর্য অস্ত যায়। লাল নীলে হলুদে জরদে মিশিয়ে কোন শিল্পী মেয়ে রেশমি পরদার উপর ছবির পর ছবি এঁকে যায়। সেই ছবিগুলির দিকে চেয়ে চেয়ে আমি আপনার হাতের তুলির লেখা পড়তে পারি। রাতে আমার জানালা খোলা থাকে। শরৎকালের আসমানের বুকে ভাঙা ভাঙা মেঘগুলো ঘুরে বেড়ায়। আমি জানালায় চোখ মেলে চেয়ে থাকি। আমার মনে হয় আপনিই যেন তাঁদের তুলিতে করে সেই মেঘগুলোর গায়ে ছবি এঁকে চলেছেন। আমার ছবির খাতা মেলে ধরে আপনার আঁকা ছবিগুলো টুকে রাখি। ওস্তাদ সাহেব! আমরা আপনাকে ভুলিনি।'
সুলতানের গল্পর অন্ত নাই। কোথায় এক জঙ্গী সোরারমর্দ গভীর রাত্রিকালে আসিত তাঁহাকে বাজনা শুনাইতে। তারা দুইজনে চলিয়া যাইত গহন জঙ্গলে। সেখানে গভীর রাতের নীরবতার সঙ্গে সুর মিলাইয়া সেতারি তার সেতার বাজাইত আর কাঁদিত। সুলতানও তার সঙ্গে অশ্রুজলের বিনিময় করিত।
এরূপ কত গল্প শুনিলাম সুলতানের কাছে। তাহার নিকট হইতে বিদায় লইয়া গভীর রাত্রিকালে বিছানায় আসিয়া শয়ন করিলাম। আমার জানালা দিয়ে আকাশের চাঁদ দেখা যাইতেছিল। সুদূর পশ্চিম পাকিস্তানের সেই মেয়েটির মতোই আমিও মনে-মনে ভাবিতে লাগিলাম, কোনো পাগলা শিল্পী যেন আঙিনায় আঙিনায় চাঁদের তুলিতে করিয়া মেঘে-মেঘে ছবি আঁকিয়া চলিয়াছে।
পরদিন দুপুরবেলা সুলতানের ছবি দেখিতে গেলাম। মোহাম্মদ হোসেন তাঁর বন্ধু সামাদ শাহিনকে সঙ্গে লইয়া আসিলেন। করাচি আসিয়া যাঁহারা সামাদ শাহিনের সঙ্গে পরিচিত না হইয়াছেন তাঁহারা পশ্চিম পাকিস্তানের সংস্কৃতিজীবনের স্বাদ মোটেই পান নাই। তাঁর বিদূষী স্ত্রী মিসেস মমতাজ শিরিন উর্দু সাহিত্যে নামকরা গল্প-লিখিয়ে। সামাদ শাহিনের গ্রন্থশালা উর্দু সাহিত্যের খ্যাত-অখ্যাত লেখকদেরর কলগুঞ্জনে মুখরিত। তিনি 'নয়া দোর' নামে একখানা বার্ষিক পত্রের সম্পাদক। পৃথিবীর যে দেশে যত ভালো সাহিত্য-পুস্তক ইংরেজিতে ছাপা হইয়াছে, তাহার প্রায় অধিকাংশ শ্রেষ্ঠ পুস্তকই তিনি তাঁর লাইব্রেরিতে সংগ্রহ করিয়াছেন।
স্যার আবদার রহিমের কুঠির নিকটস্থ একটি ছোট্ট ঘরে সুলতান থাকে। ওপাশের প্রশাদেও ঘরে চাকরদের অবস্থান। কোথা হইতে একটি নোংরা গন্ধ ভাসিয়া আসিতেছে। সমস্ত ঘরগুলিই অপরিষ্কার। কম্বল দিয়াইয়া সুলতান আমাদিগকে বসিতে দিল। তার সবগুলি ভালো ভালো ছবি প্রদর্শনীতে বিক্রি হইয়াছে। ল্যান্ডস্কেপের অনেকগুলি ছবি সুলতান আমাদিগকে দেখাইল। আমি ছবি ভালো বুঝি না। সুতরাং, এ বিষয়ে আমার পাঠকেরা যেন বিশেষজ্ঞদের অভিমত সংগ্রহ করেন। কিন্তু সুলতানের ছবিতে যে অপূর্ব বর্ণসামঞ্জস্যের পরিচয় পাইলাম, তাহা ভুলিবার নয়। নানা দুঃখকষ্ট অভাবের মধ্য দিয়া সুলতানকে চলিতে হইয়াছে। কিন্তু তাঁহার ছবিতে সেই দুঃখ-কষ্টের এতটুকুও ছাপ নাই। নানা অবস্থা-বিপর্যয়ের মধ্যে থাকিয়াও এই বীর শিল্পী তার স্বপ্নালু জগৎটিকে অটুট রাখিয়াছেন। তাঁর ছবিগুলি দেখিয়া দুঃখদুর্দশাগ্রস্ত লোকগুলি যদি ক্ষণিকের জন্যও তাঁর স্বপ্নজগতের এতটুকু স্বাদ পায়, তা-ই কি শিল্পীর পক্ষে কম কৃতিত্ব!
আমি সুলতানকে বলিলাম, 'তোমার ছবিগুলিতে আমাদের স্বপ্নজগতের পরিচয় আছে। তার দাম কম নয়। কিন্তু আমরা তো শুধু স্বপ্ন নিয়েই বাঁচতে পারি না। আমাদের নিত্যনৈমিত্তিক জীবনে যে নানা অভাব-অভিযোগ দৈন্য ক্ষুদ্রতা তার কথা কিছু আঁকা থাক তোমার ছবিগুলোতে। তোমার বৈচিত্র্যময় জীবনের সুদীর্ঘ পথে যারা এসে তোমার শিল্পী-অন্তরকে নাড়া দিয়েছে, তাদের কথাও তোমার ছবিগুলিতে দেখতে চাই। এই পৃথিবীতে সুন্দরকে উপভোগ করার ক্ষমতা আমাদের কোথায়? যারা দশ হাতে সুন্দরের অপমান করেছে তাদের বিরুদ্ধেও তোমার ছবিতে শাণিত তরবারি অঙ্কিত দেখতে চাই।'

আমার কথা শুনিয়া সুলতান কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া বলিল, 'আপনি যখন ইউরোপ হতে ফিরে আসবেন, তখন আমার নতুন আঁকা ছবিগুলি দেখিয়ে আপনার কথার জবাব দেব।'
বন্ধুবর শাহিন আর মোহাম্মদ হোসেনের আফিসে জরুরি কাজ ছিল। তাই ছবি দেখার মজলিশ বেশিক্ষণ স্থায়ী হইল না। তাঁহারা উভয়েই সুলতানের ছবিগুলির প্রশংসা করিলেন।
বিকালে শিক্ষামন্ত্রী বন্ধু ফজলুর রহমান সাহেবের সঙ্গে বহুক্ষণ আলাপ-আলোচনা করিয়া আমার সুদূর ইউরোপ ভ্রমণের বিষয়ে নানা পরামর্শ করিলাম।
সন্ধ্যার পরে রাত দশটায় আবার সুলতানের আস্তানায় গেলাম। সুলতানের এক বন্ধু সোরারবাদক আসিয়াছে তার বাজনা শুনাইবার জন্য। একখানা বেড়া দেওয়া গায়ে জড়াইয়া মলিন বেশে শিল্পী বসিয়া আছে। তার সমস্ত পোশাক-পরিচ্ছদ, হাতে-পায়ে, মুখে পৃথিবীর সমস্ত মলিনতা যেন সে কুড়াইয়া পুড়াইয়া আনিয়া জীবন্ত করিয়া রাখিয়াছে। কিন্তু তার সেতারটিকে সে অবহেলা করে নাই। এই যন্ত্রটিকে সে পিতল ও রূপাখচিত নানারূপ নকশা করাইয়া রূপসী রমণীর মতো করিয়া সাজাইয়া রাখিয়াছে। শিল্পীর নিজের গায়ের ধুলা হয়তো সে একদিনও পরিষ্কার করে নাই, কিন্তু এই যন্ত্রটির গায়ে কোথাও একবিন্দু ময়লা দেখিতে পাইলাম না।
সুলতানের এখনো নৈশভোজন হয় নাই। একটি যুবক বাহিরের দোকান হইতে ১০-১২ খানা চাপাতি ও সামান্য কিছু তরকারি শাণতায় করিয়া আনিয়া দিল। চার-পাঁচজন যুবক আর এই শিল্পীকে সঙ্গে লইয়া সুলতান তাহাই আহার করিল। পরিচয় লইয়া জানিলাম, এই যুবকেরা বেকার অবস্থায় সুদূর পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো কোনো গ্রাম হইতে করাচি আসিয়াছে চাকরির অনুসন্ধানে। সুলতান তাহাদিগকে আশ্রয় দিয়াছে। মনে-মনে ভাবিতে লাগিলাম, যাহার নিজেরই আশ্রয় নাই, সে-ই বোধ হয় এমন করিয়া অপরকে আশ্রয় দিতে পারে। এই করাচি শহরে কত ধনী ব্যক্তি আছে, তাহাদের কতজনের অন্তর সুলতানের মতো এমন করিয়া পরের জন্য কাঁদে?
অনুসন্ধান করিয়া জানিলাম কিছুদিন আগে সুলতান প্রদর্শনী করিয়া কিছু টাকার ছবি বিক্রি করিতে পারিয়াছিল। সেই টাকায় সে তার সহচর এই ক্ষুদ্র দলটিকে লইয়া কোনোরকমে সংসারযাত্রা নির্বাহ করিতেছে।
আমি সুলতানকে বলিলাম, 'তুমি দেশের শিল্পী। তোমার জীবন কত মূল্যবান। এইভাবে বাজারের সাধারণ দোকান হইতে নোংরা খাদ্য কিনে এনে তোমার জীবনকে বিপদাপন্ন করার তোমার কোনো অধিকার নাই। যে দোকান হতে খাদ্য এনে তুমি খাও, দিনের বেলা দেখেছি, সেখানে খাদ্যবস্তুর উপর মৌমাছির চাকের মতো মাছি ভনভন করছে।'
সুলতান হাসিয়া বলিল, 'ভালো দোকান হতে খাবার এনে খেলে তার দাম বেশি পড়ত। আমার এতগুলি বন্ধুকে নিয়ে আমি খরচ কুলিয়ে উঠতে পারতাম না।'
এ কথার আর আমি কী উত্তর দিব! অল্পক্ষণের মধ্যেই আহারাদি সমাপ্ত হইলে। এবার সেতারি তাহার যন্ত্রটি কোলের উপর লইয়া ধীরে ধীরে বাজানো আরম্ভ করিল। সে কী মধুর বাজনা! ধীরে ধীরে যেন নেশানিবতা হইতেই অস্পষ্ট সুর বাহির হইয়া সুরে নৃতভঙ্গিতে উচ্চ হইতে উচ্চতর গ্রামে উঠিয়া আবার মৃদু হইতে মৃদুতর হইয়া অনন্ত নীরবতায় লীন হইতেছিল। তারই সঙ্গে সঙ্গে শিল্পীর দেহে-মুখে-চোখে ভাবান্তর হইতেছিল। রাত প্রায় ১টা অবধি তাহার বাজনা শুনিয়া গৃহে ফিরিয়া আসিলাম। আমাকে আগাইয়া দিতে দিতে সুলতান বলিল, প্রতিদিন সারারাত জাগিয়া সে এই শিল্পীর বাজনা শোনে। লোকটি অদ্ভুত ধরনের। সারা দিন এখানে-ওখানে ভিক্ষা করিয়া কাটায়। কাউকে বাজনা শুনাইয়া পয়সা লয় না। সে বলে, 'বাজনা শুনানো মানে নিজের অন্তরকে অপরের অন্তরে ভরিয়া দেওয়া। ইহা মূল্য দিয়া হয় না।' রেডিও তাহাকে প্রোগ্রাম দেওয়ার জন্য কত চেষ্টা করিয়াছে! কত বড়লোক বাজনা শুনিবার জন্য তাহাকে আহ্বান করে। সে কাহারও ডাকে সাড়া দেয় না। শুধুমাত্র রাত্রে আসিয়া সে সুলতানকে বাজনা শুনাইয়া যায়। সে বলে, রসিক ব্যক্তির কাছেই শুধু রস বিতরণ করিতে হয়। অরসিকের কাছে রসের অবতারণা করিলে শিল্পকেই শুধু অপমান করা হয়।

বিছানায় শয়ন করিয়া করাচির এই সদ্যপরিচিত বন্ধুদের কথা চিন্তা করিতে লাগিলাম। মিস্টার হোসেন, মিসেস রোজী হোসেন এঁরা তথাকথিত অভিজাত সমাজে বসত করিয়া সুদূর বাংলাদেশের গ্রাম্য গান, মাটির পুতুল, লোকনৃত্যের কথা চিন্তা করিতেছেন, আর শিল্পী সুলতান নোংরা গৃহকোণে ছেঁড়া কম্বল বিছাইয়া, কাগজের উপর সমস্ত ইন্দ্রজাল তার তুলির মোহনস্পর্শে ভুলাইয়া আনিয়া, ছবির লীলায়িত রেখায় জীবন্ত করিয়া রাখে, আর পার্শ্বে বসিয়া তার সেতারি বন্ধু ছিন্ন মলিনবেশে ধূলধুসরিত দেহে অতীত ভারতের রাজসভার অভিজাত সংগীতকে তাহার হাতের তারযন্ত্রের উপরে আনিয়া সুরের মহামধুরী বিস্তার করে।
ইহারা সকলেই শিল্পী। কবে ইহারা একত্রে আসিয়া উপবেশন করিতে পারিবে?
ইউরোপ হইতে ফিরিয়া আসিয়া সুলতানকে বহু অনুসন্ধানেও খুঁজিয়া পাই নাই। আরও একান্তে বসিয়া শিল্পীকে ভাবিতেছি, শিল্পীকে উপযুক্ত পরামর্শ দেওয়ার ক্ষমতা আমার কতটুকু আছে? সুলতানের সঙ্গে দেখা হইলে বলিতাম, 'বন্ধু! তুমি কিছু মনে করিও না, তোমাকে পরামর্শ দেওয়ার আড়াল রচনা করিয়া আমি সেদিন আমার সাহিত্যিক মনকেই উপদেশ দিয়াছিলাম।' ইহার পরে আরও বহু বিচিত্র অবস্থায় সুলতানকে দেখিয়াছি। সেসব কথা সামান্য কিছু লিখিয়া রাখি। ইহার বছর দুই পরে একদিন টিমটিম করিয়া বৃষ্টি হইতেছে, দেখি সুলতান আমার দরজায় দাঁড়াইয়া। তাহাকে আদর করিয়া বৈঠকখানায় বসাইলাম। ইতিমধ্যে সুলতান ইউরোপ-আমেরিকা ঘুরিয়া আসিয়াছে। বহু দেশের খবরের কাগজ ফটোসহ তাহার উপর কিছু কিছু লিখিয়াছে। সুলতান বলিল, 'এবার বাংলায় এলাম আপনার উপদেশমতো দেশের জনসাধারণের কথা চাক্ষুস জেনে তাদের ছবি আঁকতে।' সুলতানকে রঙের দোকানে লইয়া গেলাম। সে রং-তুলি-কাগজ মিলিয়া প্রায় দুইশত টাকার সওদা করিল। তারপর একদিন তাঁর নিজের দেশে যশোরে চলিয়া গেল। সুলতানের অতীত কাহিনি আপাতত মুলতবি থাক।
হলদে পরীর দেশে, প্রথম প্রকাশ ১৯৬২,
পলাশ প্রকাশনী, ঢাকা