মনিরু রাভানিপুরের গল্প | তেহরান

এই রাস্তাটার নামই কি একসময় মোসাদ্দেক অ্যাভিনিউ ছিল? আর এইসব ডিপার্টমেন্টাল স্টোর? জানালায় বাহারি ডিজাইন, লাল গালিচায় ঢাকা মেঝে—এসব দোকানের সামনে দিয়েই কি লিফলেট বগলে করে ভোরের আলো ফোটার আগে বিদ্যুৎগতিতে ছুটে যেতে তুমি? সেগুলো চুপিচুপি গুঁজে দিতে দরজার ফাঁক দিয়ে? [*টীকা: মোসাদ্দেক অ্যাভিনিউ: ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর ঐতিহাসিক বৃক্ষশোভিত পাহলভি অ্যাভিনিউয়ের নামকরণ করা ইরানের ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মোসাদ্দেকের নামে। তবে এখন এই সড়কের নাম ভালী আসর।]
এই জায়গাতেই কি তুমি আর তোমার সাথি আন্দোলনকারীরা গলা ফাটিয়ে স্লোগান দিতে: 'বখতিয়ার দাস! গরুর চেয়েও অধম!' [*টীকা: বখতিয়ার দাস: শাহ-র শাসনামলের শেষ প্রধানমন্ত্রী শাপুর বখতিয়ার (১৯১৪—১৯৯১)। তিনি প্যারিসে খুন হন।]
নাকি এই দোকানের সামনেই আরেকদল বিক্ষোভকারী স্লোগান দিত, 'শাহ-কে দাফন করো! দেশকে গর্বিত করো!' আর সেই মোড়ের কথা মনে আছে, যেখানে তুমি মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে গলা ফাটিয়ে বলেছিলে: 'শতভাগ বনি-সাদর!' আর এই দেয়ালের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে, দুচোখ ভরা উত্তেজনার দীপ্তি নিয়ে দেখেছিলে মিছিলের ঢেউ কেমন করে রাস্তা বেয়ে নেমে যাচ্ছিল। [*টীকা: বনি-সাদর: আবুলহাসান বনি-সাদর (জন্ম. ১৯৩৩), ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রথম প্রেসিডেন্ট। পরে ক্ষমতাসীনদের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে বিরোধের জেরে ১৯৮১ সালে তাকে অভিশংসিত করা হয়। মৃত্যুদণ্ড এড়াতে হয়ে দেশ ছাড়েন। বর্তমানে তিনি ইউরোপে নির্বাসনে রয়েছেন।]
ঢেউ পেরিয়ে গেছে একের পর এক। এখন তুমি দাঁড়িয়ে আছ এক আসবাবের দোকানের জানালার সামনে, ভেতরে বাহারি সব বিলাসী পণ্য। চেয়ে দেখ, যতক্ষণ খুশি। প্রাণভরে দেখ। নজর কাড়ার মতোই জিনিস সব। এই সড়কে এখন আর কেউ চেনে না তোমাকে—একজনও না।
একজন বিক্রয়কর্মী এগিয়ে আসে—সুদর্শন, পরনে মার্জিত পোশাক, প্রশিক্ষিত। হাসি দিয়ে বলে, 'স্বাগতম!'
তোমাকে হালকা হেসে মাথা লোকটার অভিবাবাদনের জবাব দিতে হয়। চারপাশে চোখ বুলিয়ে এমন ভঙ্গি করতে হয়, যেন কোনটা নেবে বাছাই করছ। ভান ধরতে হয়, তুমি যেন একজন সম্ভাব্য ক্রেতা—স্মৃতির অলিগলিতে ঘুরে বেড়ানো ভবঘুরে নও। ছয় চেয়ারের একটা ডাইনিং সেট দেখাও।
'এই সেটটার দাম কত?' তুমি জিজ্ঞেস করো।
'তিরিশ লাখ তুমান।'
যেন কিছুমাত্র বিচলিত হওনি—একটা চেয়ার টেনে বসে দেখ, দেখে নিচ্ছ যেন কতটা আরামদায়ক।
তারপর ঘোষণা করো: 'খুব একটা আরামদায়ক না।'
পাশের আরেকটা সেট দেখায় লোকটি। 'ওপাশের সেটটা দেখুন। দামটা একটু বেশি।'
'টাকা কোনো ব্যাপার না,' নিরাসক্ত কণ্ঠে বলে বসো তুমি।
তুমি সেটটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখ। সৌন্দর্য দেখে তোমার নিশ্বাস আটকে আসে। কিন্তু মুখে বলো, এই বাদামি চামড়ার তোমার কিচেন কাউন্টারটার সঙ্গে ঠিক যায় না।
একটু মিথ্যে...কিন্তু কারও কোনো ক্ষতি তো করছে না।
লোকটা সমঝদারের ভঙ্গিতে মাথা দোলায়। বলে, 'কয়েক দিনের মধ্যে ইটালি থেকে নতুন মাল আসছে।'
তার কার্ড নিয়ে তুমি ঘুরে বেরিয়ে আসো দোকান থেকে।
পরের গন্তব্য গয়নার দোকান নয়, যদিও সেখানে ঢোকা আরও কঠিন। বেল বাজিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, ভেতর থেকে দরজা খোলার জন্য।
দরজা খুললে ঢুকে যাও ভেতরে। চোখ ভরে দেখ শেলফে সযত্নে সাজিয়ে রাখা সুন্দর সুন্দর ফুলদানি, সুদৃশ্য ডিনার সেট আর বাহারি সব থালাবাসন।
'এই ফুলদানিটা?'
'আড়াই লাখ তুমান।'
'এই ফলের বাটি?'
'সাত লাখ।'
ফলের বাটিখানার গায়ে পঞ্চদশ লুইয়ের ছবি খোদাই করা। যে লোকটা বছরের পর বছর গোসল না করে কাটিয়ে দিত, সেই তাকেই এখন দেখা যাচ্ছে রাজকীয় পোশাকে, ডান হাতের মুঠোয় স্ক্রল। পর্দার মতো ঝলমলে পোরসেলিন পাত্রে নিজের ছবি নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সে—ভাবা যায় না! তুমি আঙুল বুলিয়ে ছুঁয়ে দেখ ছবিটা, যেন ইতিহাসের সত্যতা যাচাই করছ।
'দয়া করে ছোঁবেন না।' পেছন থেকে ভেসে আসে বিক্রয়কর্মীর কণ্ঠ। চেহারায় গাম্ভীর্য, কপালে ভাঁজ, সুদর্শন তরুণ। যেন সে ঠিক জানে, তুমি কিছুই কিনবে না। না, এসব সাজানো জিনিস ছোঁয়া যাবে না। ইশারা করতে পারো। দেখাতে পারো পঞ্চদশ লুইকে, যার গায়ের গন্ধ থেকে ফ্রান্সে পারফিউম শিল্পের জন্ম হয়েছিল।
যুবক এবার গলা খাঁকারি দেয়। ইঙ্গিতটা স্পষ্ট: এবার সরে পড়ো। কাজেই তুমি ফলের বাটির সামনে থেকে সরে এসে থামলে একটা লম্বা গলার ক্রিস্টালের গ্লাসের সামনে। গ্লাসটা যেন ক্লিওপেট্রার হাতে ধরার জন্যই বানানো। এবার আর হাত বাড়িয়ে ছোঁয়ার সাহসও করলে না। আর অভিনয়ের দরকার নেই; তোমার অপ্রতিভ চেহারা এতক্ষণে বিশ্বাসঘাতকতা করে বসেছে। উদাস, এলোমেলো হাত দুটোও যেন তোমার ভেতরের হাহাকার ফাঁস করে দিচ্ছে। তাই হাত দুটো পুরে ফেলো খালি পকেটে। চোখ বন্ধ করে হয়তো চারপাশের দৃশ্য থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে পারো, কিন্তু হাত? এই অসহায়, হতাভাগা হাত দুটো কোথায় ঠাঁই পাবে?
তুমি দোকান ছেড়ে বেরিয়ে আসো—ভয়ে, আর কিছুক্ষণ থাকলে যদি কিছু ভেঙে ফেলো! চোখে পড়ে জানালার ওপাশে রাখা নিঃসঙ্গ পোরসেলিনের বেদিটা। দেখে মনে হয় ছিপছিপে, কোমল পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কোনো ব্যালেরিনা।
না, এমন বিলাসবহুল দোকান সেই সময় ছিল না। 'সেই সময়'—কত বছর আগের কথা? তুমি ভাবো, সেই দিনগুলো কবে বিলীন হয়ে গেল? এসব দোকান, এইসব গগনচুম্বী টাওয়ার কবে গজিয়ে উঠল এখানে? আর এই ছোট্ট পার্কটা? ছিল না বোধহয়...নাকি ছিল?
ধীর পায়ে এগিয়ে যাও তুমি। রাজ্যের জড়তা তোমার হাঁটায়। তোমার পায়ের বয়স এখন আর বিশ নেই, যে পায়ে ভর করে তুমি উড়তে উড়তে এক গলি থেকে আরেক গলিতে ছুটে যেতে। এখন ওদের বয়স পঞ্চাশ। পা দুটো তোমার গোলগাল, পিপের মতো ভারী শরীরটাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে সেই ছোট্ট খেলার মাঠের দিকে, যেখানে বাচ্চারা চটপট উঠছে-নামছে জাঙ্গল জিমে।
আর কয়েক কদম গেলেই পৌঁছে যাবে একটা বেঞ্চে। কিন্তু আচমকা পথ আটকে দাঁড়ায় এক রোগা, মলিন পোশাক পরা লোক। কিছু বলার চেষ্টা করে সে, কিন্তু কথাগুলো অস্পষ্ট—জড়ানো উচ্চারণ। তবু মনে হলো, সে তোমার বা তোমার পোশাকের প্রশংসা করতে চাইছে। বুড়ো আঙুল আর তর্জনী এক করে বৃত্তের মতো করে বোঝাতে চাইছে, তুমি একদম ঠিকঠাক আছ। তোমার হাবভাব, কাপড়ের ভাঁজ—সবকিছু দেখিয়ে যেন নিঃশব্দে তারিফ করছে, 'তুমিই সেরা।'
এবার দোকান, টাওয়ার, জাঙ্গল জিম, শিশুর দল—সব ধূসর হয়ে যায় পেছনে। সবকিছু ম্লান হয়ে আসছে, শুধু লোকটার চেহারাই চোখে পড়ে। মুখটা তরুণ, লালচে। লজ্জায় কি? তুমি ভাবো। তোমাকে দেখে কি কারও কথা মনে পড়ে গেছে লোকটার? তার মায়ের কথা? কিন্তু কোনো সন্তান মায়ের দিকে এভাবে তাকায় না। চোখে কীসের যেন ঝিলিক, আপাদমস্তক মেপে নিচ্ছে তোমাকে। হাত দুটো শূন্যে নাড়ছে। শেষ কবে কারও এমন দৃষ্টির সামনে তোমার চেহারা আরক্ত হয়ে উঠেছিল? লোকটার কথা স্পষ্ট বুঝতে পারো না, কিন্তু ভেতর থেকে কিছু একটা বলছে—তার মুগ্ধতার কেন্দ্রবিন্দু তুমি।
তুমি তাকাও লোকটার দিকে, মৃদু হাসিতে প্রত্যুত্তর দেওয়ার চেষ্টা করো। তবু সে তোমার দিকে তাকিয়ে থাকে চোখে মুগ্ধতা আর প্রশংসা নিয়ে। হঠাৎ টের পাও, তোমার পাশের বেঞ্চে বসে আছে এক তরুণী—আকর্ষণীয়, প্রাণবন্ত। হাসছে সে তোমার দিকে তাকিয়ে। নাকি তোমার এই হাল দেখে হাসছে?
'লোকটা কী বলতে চাইছে বুঝতে পারছি না,' মেয়েটিকে বললে তুমি, খানিকটা বিরক্তি ঢালতে চাইলে গলায়।
'সাবধান, ম্যাডাম,' বলে মেয়েটি। 'ওরা গ্যাং।'
'গ্যাং?' তোমার কণ্ঠে অবিশ্বাস।
গোলাপি সিল্কের ওড়নায় ঢাকা তরুণীর সুশ্রী চেহারায়। দৃঢ় ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে সে।
'একজন আপনার মনোযোগ সরাবে, আরেকজন চম্পট দেবে ব্যাগ নিয়ে,' বলে মেয়েটি।
বিশ্বাস হতে চায় না তোমার। লোকটা তখনও দাঁড়িয়ে আছে, তবে আর কোনো ইশারা করে না। চেহারায় উদ্বেগের ছাপ।
মেয়েটি হাসে, ঝকমকিয়ে ওঠে ধবধবে সাদা দাঁত।
সে ফিসফিসিয়ে বলে, 'মোবাইল বের করে বলুন, আপনি ওয়ান ওয়ান জিরো-তে কল করছেন। তারপর দেখুন কী কওে ব্যাটা।' [*টীকা: ওয়ান ওয়ান জিরো: ইরানে ১১০ হচ্ছে জরুরি সহায়তা নম্বর।]
নিজের অজান্তেই হ্যান্ডব্যাগ থেকে সেলফোন বের করো তুমি। তরুণী গলা চড়ায়, যাতে লোকটা শুনতে পায়: 'ওয়ান ওয়ান জিরোতে কল করুন।' লোকটা পাঁই ঘুরে দাঁড়ায়, হাঁটা ধরে রাস্তার দিকে।
মেয়েটি রাস্তার মোড়ে দাঁড় করিয়ে রাখা মোটরসাইকেলের দেখায় ইশারায়। 'ওই যে, মোটরসাইকেলে উঠবে এখন,' বলে সে। লোকটাকে লাফিয়ে মোটরসাইকেলে উঠে বসে ঝড়ের বেগে সটকে পড়তে দেখ তুমি।
তুমি হেলান দিয়ে বসো বেঞ্চে। এখন টের পাও গরমের তীব্রতা, গাড়ির গর্জন আর পার্কে বাচ্চাদের চিৎকার। ঘামে ভিজে যায় তোমার মুখ। সেলফোনটা হ্যান্ডব্যাগে রেখে সিগারেটের প্যাকেট বের করো। লাইটার? নেই।
'আমিও ধূমপান করি,' বলে মেয়েটি, 'তবে এখানে এলে সিগারেট-লাইটার বাড়িতে রেখে আসি।'
কিছু পথচারীকে জিজ্ঞেস করো লাইটার আছে কি না। নেই কারও কাছে।
'পার্কের মাথায় ছোট একটা দোকান আছে, ওখানে পেতে পারেন,' মেয়েটি বলে।
ছোট দোকানটা পার্কের শেষ মাথায়। শ্রান্ত পা টেনে নিয়ে গেলে হয় অন্তত পঞ্চাশ গজ। দোকানে ঢুকে পুরুষ খদ্দেেেদর দৃষ্টি অগ্রাহ্য করে তাদের সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেটে ধরালে। তারপর ধীরে ধীরে ফিরে এলে বেঞ্চে, মেয়েটির পাশে। সে হাসিমুখে তোমাকে পাশে বসতে ডাকে। তার পাশে বসে তুমি একটু স্বস্তি পাও।
লম্বা টান দিয়ে সিগারেট টানো। তিন-চারটে টান দেওয়ার পর আবার একটা ধরাও প্রথমটার আগুন থেকে।
বাইরের চিৎকার-চেঁচামেচি, ভারী যানজট আর ধোঁয়াটে বাতাসে ক্লান্ত হয়ে ওঠো।
মানুষের চিৎকার-চেঁচামেচি, গাড়ির গর্জন আর দূষিত বাতাসে ক্লান্ত হয়ে হঠাৎ বলে ফেলো: 'সবকিছু কত বদলে গেছে!'
'প্রায় প্রতি মুহূর্তেই বদলায় কিছু না কিছু,' মেয়েটি বলে।
'আগে এই রাস্তায় গাছগাছালি ছিল। ছায়া ছিল।'
'এখন আছে শুধু কংক্রিট, গাড়ি...আর নানান গ্যাং। গাছ নেই,' তরুণী বলে।
গাড়িতে ঠাসা রাস্তায় দৃষ্টি ফেরাও তুমি। মনে পড়ে, একসময় এই পথে হেঁটে বেড়াত মানুষ। ভাবো—তুমি আসলে ব্যারেল নও, তুমি একটা মই। বিলাসী দোকান, নিরাপদ আসন আর মোটা ব্যাংক ব্যালান্সের খোঁজে সেই মই বেয়ে উঠেছে কত মানুষ।
'সবসময় এত সিগারেট খান?' মেয়েটি এবার মৃদু উদ্বেগ নিয়ে প্রশ্ন করে।
'শুধু যখন অতীতের কথা ভাবি,' তুমি জবাব দাও।
'স্মৃতি?' সে বলে। তার ডাগর, উজ্জ্বল দুই চোখের কোণে অশ্রু চিকচিক করে ওঠে। ভয় পেয়ে যাও, এই বুঝি অশ্রুর বান বইবে দুগাল বেয়ে।
'তুমি তো তখন বাচ্চা ছিলে—সেইসব দিন মনে থাকার কথা না।'
'এই শহরের স্মৃতি সবারই মনে আছে,' মেয়েটি বলে, গলায় হালকা বিষাদের রেশ।
'কিন্তু সবার স্মৃতি একরকম হয় না।'
'তা ঠিক। যখন বোমা ফেলা হয়েছিল , আমি তখন খুব ছোট,' তরুণী বলে, দৃষ্টি চলে যায় সুদূরে। [*টীকা যখন বোমা ফেলা হয়েছিল: ইরান-ইরাক যুদ্ধের (১৯৮০—১৯৮৮) সময়ের কথা বোঝানো হয়েছে।]
'শুধু বোমা না,' বলো তুমি।
'জানি,' সায় দেয় মেয়েটি। 'ভেতরেও যুদ্ধ চলছিল। রাস্তায় রাস্তায় লড়াই।'
'একটা ব্যাপার নিশ্চিত—তখন নিরাপত্তা ছিল বেশি,' তুমি দৃঢ় কণ্ঠে বলো। 'এখন আর সেটা নেই।'
'হ্যাঁ,' জোরালো গলায় সায় দেয় মেয়েটি। 'অনেক দিন হলো হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে বাইরে বের হই না। শুধু চাবি আর সেলফোন রাখি পকেটে।'
তারপর সে তাকায় পার্কে খেলতে থাকা শিশুদের দিকে। দুচোখ যেন হঠাৎ চকচক করে ওঠে। 'ওদের দিকে আরও বেশি খেয়াল রাখা থাকা দরকার,' বলে সে।
মিষ্টি কণ্ঠে শোনায় শহরের নানা গল্প। একাকী নারীদের ওপর হামলা, ছিনতাই। শিশু অপহরণ, তরুণদের নেশায় হারিয়ে যাওয়া।
তেষ্টা পায় তোমার। ভীষণ তেষ্টা। মনে হয়, বরফজলে ভাসতে পারলে বেশ হতো! নিস্তার পাওয়া যেত শরীর-মগজ পুড়িয়ে দেওয়া এই অভিশপ্ত গরম থেকে। মেয়েটির কাঁধে হাত রাখো তুমি।
'আমার খুব তেষ্টা পেয়েছে। তুমি কী খাবে?'
মেয়েটি মুখ তুলে তাকায় তোমার দিকে। গালের হাড় খানিকটা উঁচু, লম্বা অক্ষিপল্লব ভুরু ছুঁই-ছুঁই।
'আপনাকে কষ্ট দেব না...' বলে সে উঠে দাঁড়াতে চায়। তুমি তার কাঁধে আলতো চাপ দিয়ে বসিয়ে দাও, নিজে এগিয়ে যাও দোকানের দিকে। পেছনে থেকে তার কোমল কণ্ঠ আর মিষ্টি হাসিতে ধীরে ধীরে চাপা পড়ে চিৎকার-চেঁচামেচি আর গাড়িঘোড়ার আওয়াজ।
তুমি ভাবো, পৃথিবী তো শুধু ধোঁয়াশা আর কুৎসিত জিনিসে ভর্তি নয়। আজও অচেনা মানুষের পাশে বসে ঠান্ডা পানীয়তে চুমুক দেয়া যায়, তার সঙ্গ উপভোগ করা যায়।
পানীয়তে চুমুক দেয় মেয়েটি। তুমি জানতে চাও, 'নিয়মিত আসো এখানে?'
'যতটা পারি, আসি। সাধারণত খুব সকালে আসি, হাওয়া তখনও বেশ তাজা থাকে,' জবাব দেয় তরুণী।
হঠাৎ ওর ফোন বেজে ওঠে। কোটের পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে সাবলীল, মোহনীয় ভঙ্গিতে কানে তোলে।
'হ্যালো?... হ্যালো?... হ্যালো?...' মাউথপিসের কাছ মুখ নিয়ে কয়েকবার বলে সে। তারপর তোমার দিকে তাকিয়ে কাঁধ ঝাঁকায়: 'লাইনটা কেটে গেছে।'
হঠাৎ তোমার ভেতরে দুর্দমনীয় একটা ইচ্ছে জাগে—ওর নম্বরটা চাইতে ইচ্ছে হলো। আশপাশের ছোট্ট কোনো রেস্তোরাঁয় একদিন ওর সাথে রাতের খাবার খেতে খেতে গল্প করতে পারলে বেশ হতো।
'জিনিসটা খুব ভালো ছিল,' সোডার বোতল বেঞ্চের কাছে নামিয়ে রেখে বলে মেয়েটি।
ওর সেলফোনটা আবার বেজে ওঠে। আবারও লাইন কেটে যায়। তোমার দিকে ফিরে তাকায় সে, মুখে ভুবনভোলানো মিষ্টি হাসি।
'তুমি কি একাই থাকো?' খানিকটা ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করো তুমি। নিজেই ভাবো, প্রশ্নটা কি বেশি ব্যক্তিগত হয়ে গেল?
'হ্যাঁ, ভদ্রলোকেরা যদি থাকতে দেয়,' জবাব দেয় সে। ইঙ্গিতটা বুঝে দুজনেই হেসে ওঠো ।
তোমরা ফোন নম্বর আর ঠিকানা বিনিময় করো। তুমি তার নম্বর সেভ করো নিজের সেলফোনে।
নিজেকে বলো, এই তো একটা বন্ধুত্বের শুরু। মুহূর্তটা উদযাপন করার মতো—দুটো সোডা, পরে কোনো রেস্তোরাঁয় রাতের খাবার...তারপর? কে জানে! হয়তো ওর বাড়িতে নিমন্ত্রণ?
দোকানে দাঁড়িয়ে আছ তুমি মিনিট পাঁচেক ধরে। অপেক্ষা করছ সোডার জন্য। অবশেষে পেয়ে গেলে। পকেটের খুচরো দিয়ে দাম মিটিয়ে দিলে।
দূর থেকে চেয়ে দেখো—বেঞ্চ ফাঁকা। দুই হাতে দুটো বোতল ধরে তুমি ছুটে যাও। দুচোখ ভরা আশা নিয়ে এদিক-ওদিক তাকাও। কেউ আসবে, কেউ ফিরবে। না, কেউ নেই। কেউ না।
হ্যান্ডব্যাগে হাত দাও সেলফোন বের করতে। ওকে কল দেবে।
সেলফোন নেই।
ওয়ালেট নেই।
আইডি কার্ডও নেই।
চুরি হয়েছে—লুট হয়ে গেছে তোমার সবকিছু।
- মনিরু রাভানিপুর বিপ্লবোত্তর ইরানের অন্যতম খ্যাতিমান লেখক। তার বিখ্যাত উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে—'হার্ট অভ স্টিল', 'জিপসি বাই ফায়ার', 'দ্য ড্রাউন্ড'। তার ছোটগল্প সংকলন 'কানিজু' এবং 'স্যাটান'স স্টোন' অনূদিত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি ব্রাউন ইউনিভার্সিটির ইন্টারন্যাশনাল রাইটার্স প্রজেক্ট-এর সাবেক ফেলো। বর্তমানে লাস ভেগাসে বাস করেন এবং ইউনিভার্সিটি অভ নেভাডা-র ব্ল্যাক মাউন্টেন ইনস্টিটিউট-এর সঙ্গে যুক্ত।