বন্ধুবিহীন, একা

একাকিত্বের প্রথম অনুভব কবে থেকে শুরু? ফিরে দেখলে, শহরে তখন একা বোধ করা সম্ভব ছিল না। ঘুম থেকে উঠে ঘুম যাওয়া অবধি শহর যে কল্লোলিনী, ইটের রাস্তার ওপর রিকশার ঝাঁকুনি–ফেরিওয়ালা আর ধুনকারের হাঁক–মহল্লার অ্যাটমসফিয়ার জমজমাট হয়ে আছে নাগরিকদের জীবনযাপনের বিবিধ শব্দে।
শহর তখন শহরতলির মতোই দেখতে, গ্রাম তখন একান্তই গ্রাম–'অনেক পাতার ঘনিষ্ঠতায় একটি প্রগাঢ় নিকুঞ্জ'। ছুটির নাম তখন ভারী অদ্ভুত, আম-কাঁঠালের ছুটি, রেইনি ডে, হাফ ইয়ারলি ছুটি, রোজার ছুটি, শীতের ছুটি। তেমনি এক ছুটিতে আব্বা নিয়ে গেল আমাদের দাদাবাড়িতে, গ্রামে, কে বলে যে জীবন দোয়েলের ফড়িঙের মানুষের সাথে তার দেখা হয় না? দিব্য হয়।
ধানকাটা মাঠে নাড়া জেগে আছে, তার ওপর বিস্তর মাকড়শার জাল। খড়ের কাঁথা মুড়ি দিয়ে গোঁ গোঁ নাক ডাকা নতুন আলুর খেত। দিগন্ত ধূসর-বেগুনি ধোঁয়াশায় আচ্ছন্ন, আকাশের মেঘের পরেই সেখানে জঙ্গল ঘনিয়ে আছে, তেমনি বিস্তীর্ণ আর অগম্য। সকালে জেগে দেখি নিহর পড়ে নিশ্চুপ ছনে ছাওয়া কুটির, মেটে উঠান আর খড়ের গাদা। পুকুরের পানি স্থবির। গরুও সেখানে অদ্ভুত একাকিত্বে হাম্বা রব করে। বাছুরের পিছু পিছু দৌড়ে চলে যাই আদিগন্ত ফসলহীন মাঠে। একা হওয়ার প্রথম নৈঃসর্গিক পাঠ।
একাকিত্বের প্রথম অনুভূতি আমায় এনে দিয়েছিল সোভিয়েত শিশুসাহিত্য। বাচ্চারা সন্ধ্যার বাগানে ফুলের কেয়ারিতে পানি দেবার সময় অন্ধকার বালতির জলে দেখছে নিজের মুখ। অথবা অরণ্যে মাথার ওপর অচেনা পাখির ডাক–স্কা স্কা স্কা আর পায়ের তলায় মচমচিয়ে ভেঙে যাচ্ছে পাইনগাছের মোচা–আপেলের শুকনো পাতা। অথবা উভচর মানুষ বিস্মিত হয়ে দেখছে এত দিন সমুদ্রের ভিতর বিশাল প্রাণীজগতে তার একা লাগেনি–স্থলের একটি মেয়েকে দেখবার পর তার কাছে সমুদ্র ফাঁকা হয়ে গেছে। অথবা তামা পাহাড়ের ঠাকরুণ দেখা দেয়ায় স্তেপানের জীবন বদলে গেছে আমূল। ওসব ধূসর অনুভূতির কথা আর কোনো সাহিত্য আমাকে পড়ায়নি, অন্তত সেই বয়সে।
আমাদের জন্য সবই ছিল উচ্চকিত সরব বর্ণাঢ্য। আমাদের ছবির বই ছিল রংচঙে, আমাদের শিশুপার্ক কিংবা নাগরদোলা ছিল প্রাইমারি কালারের বেঞ্চিতে ঠাসা। আমাদের বিনোদন ছিল ফুল-পাখি-লতাপাতার সংলাপময় 'ছড়াগান'। চোখ শিরশির করার বা বুক চিনচিন করার কোনো উপক্রমই নেই।

সেবা প্রকাশনীর অনুবাদে হাতে এল ড্যানিয়েল ডেফোর রবিনসন ক্রুসো। বিস্মিত হয়ে পড়লাম, একা একটি দ্বীপে বছরের পর বছর একটি লোক জীবন কাটিয়ে যাচ্ছে! হায় খোদা! আলেক্সান্ডর সেলকার্ক নামের এক স্কটিশ নাবিক নাকি সত্যিই এমনি করে একটা দ্বীপে আটকা পড়েছিল। এরপর পড়লাম–দ্য সুইস ফ্যামিলি রবিনসন। আনন্দমেলায় পড়লাম স্টিভেন কালাহানের সমুদ্রযাত্রার সত্য গল্প।
পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোর একটিতে থাকি তখন, অত কলরোলে কি এসব মানুষের নিঃসঙ্গতার নির্বেদ আস্বাদ করা যায়? মেরি শেলির গথিক নভেল তখনো আমাকে কেউ হাতে দেয়নি, তাই জানতে পারিনি ভিক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের তৈরি মানবেতর দানো কি আন্তরিক নিঃসঙ্গতার জ্বালায় অমন প্রতিশোধপরায়ণ খুনিয়া হয়ে উঠেছিল। 'লাইফ অব পাই' বের হবে আরও বহু বছর পরে, তখনো মানুষের একাকিত্ব ভেবে চমকে উঠব।
আম্মা নিউমার্কেট থেকে নিয়ে এল শার্লট ব্রন্টির 'জেন এয়ার'–অনাথিনী এক দুঃখী সংকল্পবদ্ধ মেয়ের গল্প। চোখের পানি মুছতে না মুছতে হাতে এল–আরেক ব্রন্টি সহোদরার দুনিয়া কাঁপানো প্রেমের উপন্যাস–'উদারিং হাইটস'। পাতানো ভাইবোন যারা প্রেমিক-প্রেমিকা, যাদের অস্তিত্বের কেন্দ্রে আছে একরকম ভয়ানক একাকিত্ব, সমাজে তারা বেখাপ্পা, স্বভাবে তারা ইয়র্কশায়ারের মুরল্যান্ডের মতোই রুক্ষ অবিন্যস্ত বাদাজমিন।
স্কুলের গ্রামার বইয়ের কল্যাণে পড়লাম একটি লাইন–'নো মেট নো কমরেড লুসি নিউ, শি ডোয়েল্ট অন আ ওয়াইড মুর, দ্য সুইটেস্ট থিং দ্যাট এভার গ্রিউ বিসাইড আ হিউম্যান ডোর।' তুষারঝড়ের রাতে ওয়ার্ডসওয়ার্থের 'লুসি গ্রে' চলেছে একাকিনী, আরেক মুরল্যান্ডের কন্যা, শহর থেকে তার মা ফিরবে–আলো দেখিয়ে মাকে বাড়ি নিয়ে আসবে সে। বাড়ি ফেরেনি লুসি, হারিয়ে গিয়েছে পথে। সিলভিয়া প্লাথের 'দ্য বেল জার' পড়েছি লন্ডনের পাবলিক লাইব্রেরিতে। কেমন করে একাকী মানুষ ছোট ছোট আঘাতে আবিষ্কার করে যেদিকেই সে যাচ্ছে, সেদিকেই কানাগলি, সম্ভাবনাহীন।

'আহা অন্তত তোমার মা তো তোমায় ভালোবাসে!'–এ তো আশ্বাস নয়, ভয়ানক ব্যঙ্গ, রসবিকৃতি। ধীরে ধীরে বায়ু-অপসারিত বেলজারের মতো দশা হচ্ছে তার, ভেতরকার শব্দ আর বাইরে পৌঁছাচ্ছে না। মনে আছে বইটা শেষ করে বেশ কয় দিন আর কিছুই পড়তে পারিনি। এমন হয়েছিল একটি স্মৃতিকথা পড়ে–'দ্য ডাইভিং বেল অ্যান্ড দ্য বাটারফ্লাই'। স্ট্রোক আর পরবর্তী বিশ দিনের কোমার পর জেগে উঠে লোকটা দেখছে–সে তার শরীরে বন্দী, মাথা আর একটি চোখের পাতা ছাড়া আর কিছু নাড়াতে পারছে না। একাকিত্বের কত পরত! মা-বাপের একমাত্র সন্তানেরা কি একা? মুরাকামির 'সাউথ অব দ্য বর্ডার, ওয়েস্ট অব দ্য সান' জানে।
একা হলে পশু কী করে? আমাদের বাড়িতে কোরবানি ঈদের সময় যে বকরি বা গরু আসত, তারা তারস্বরে কাঁদত। সেই কান্নার শব্দ অসহনীয়। আব্বা বলত, গেরস্তবাড়ির আদরের প্রাণী, আশপাশে চেনা মানুষ না দেখে কাঁদছে। বেড়াল কুকুরও একা হলে চেঁচায়। চিড়িয়াখানায় দেখতাম একা শেয়াল খাঁচায় ক্রমাগত হনহন করে পায়চারি করছে, পাখি নিজের খাবারের থালা চঞ্চুতে তুলে মাটিতে ফেলে বারবার ঠনঠন শব্দ করছে। জানতাম না এমন পুনরাবৃত্তিমূলক ব্যবহারের কারণ নিঃসঙ্গতা। টাপিরের খাঁচায় লেখা বাংলা শিরোনাম আমার আজও মনে আছে–'একটি নিঃসঙ্গ টাপির'। পোষা প্রাণী একা বোধ করলে খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দেয়, সে বেড়াল হোক কি হাতি।

আত্মা যখন শূন্যস্থানে এলেন, তার প্রথম অনুভূতি হলো–ভয়ের, একাকিত্বের–অহম। সেই একলাপনা থেকে নিজেকে শুধরাতে তিনি উচ্চারণ করলেন–সোহম বা সোহুম; যার অর্থ সংস্কৃতে 'আমি তিনি/সে/ওই'। বা আমিই স্বয়ং বা আমি ঈশ্বরের সমতুল্য, মহাবিশ্ব বা চূড়ান্ত বাস্তবতার সঙ্গে মানবের আত্মা নিজেকে শনাক্ত করলেন। পরমেশ্বর নাকি যাকে নির্বাচন করেন, তাকে একাকী করেন। মোজেস চলে গেলেন পাহাড়ের অন্তিমে-দেখলেন একটি গাছে আলো চমকাচ্ছে, আর কেউ তো আশপাশে নেই! নবুয়ত লাভের আগ থেকেই মহানবী মুহাম্মদ (সা.) মক্কার সবার থেকে আলাদা, জেবেল-ই-নুরের নির্জন হেরা গুহায় তিনি একাকী ধ্যানমগ্ন। সিদ্ধার্থ তথা গৌতম বুদ্ধ যখন গৃহত্যাগ করলেন, তখন তিনি রাজপুত্র, দুঃখভোগ কাকে বলে তিনি জানেননি, রমরমা সংসারের কেন্দ্রে বসে কি আর বোধিলাভ হয়? সন্ন্যাস, তপস্যা, সাধনা, ধ্যানসমাধি এসব যে একার পথ। ফাল্গুনের রাত, পঞ্চমীর চাঁদ সব আয়োজন থাকবার পরেও কিসে ডাকে মানুষকে?
'বধূ শুয়েছিলো পাশে–শিশুটিও ছিলো;
প্রেম ছিলো, আশা ছিলো–জ্যোৎস্নায়–তবু সে দেখিল
কোন ভূত?"
সেই ভূত কি একাকিত্ব? সঙ্গীবিহীন হলেই যে ফিনফিনে পাত এসে চামড়া কাটতে থাকে? সেই ভূত কি কার্নিভ্যালের চিৎকারের মাঝে ভ্যান গখকে দেখা দিয়েছিল? সেই ভূত হেমন্ত মুখার্জির মেদুর গলায় গেয়ে ওঠে–আমি বন্ধুবিহীন একা। কেউ বোঝে না, কেউ যাচে না, কেউ খোঁজে না যাকে? কেন সে একা? রবীন্দ্রনাথ 'ঘরে-বাইরে'তে লিখেছিলেন–'আমার পথের সঙ্গিনীকে আইডিয়ার শিকল দিয়ে বাঁধতে চাইব না।' 'পুতুলনাচের ইতিকথা'য় মানিক লিখেছিলেন–'মানুষ আর যাই সৃষ্টি করতে পারুক নাই পারুক, প্রেয়সীকে সৃষ্টি করতে পারে না।' সঙ্গী/সঙ্গিনী তার আপন স্বভাবের সম্প্রসারণ হয়ে ওঠে বলে কি সে একা? কিংবা স্বভাবের মেলবন্ধন না হলে যুঝতে যুঝতে কি সে একা? রবীন্দ্রনাথের কথা যখন উঠলই, তখন একটু বলি।

ছিন্নপত্রের পাঠকদের চেনা প্রসঙ্গ, 'শিলাইদহে পদ্মার বোটে ছিলাম আমি একলা, সঙ্গে ছিল এক বুড়ো মাঝি, আমার মতো চুপচাপ প্রকৃতির, আর ছিল এক চাকর, ফটিক তার নাম। সেও স্ফটিকের মতই নিঃশব্দ। নির্জনে নদীর বুকে দিন বয়ে যেত নদীর ধারারই মত সহজে। বোট বাঁধা থাকত পদ্মার চরে। সেদিকে ধু-ধু করত দিগন্ত পর্যন্ত পাণ্ডুবর্ণ বালুরাশি, জনহীন, তৃণশস্যহীন।' কোথায় যেন পড়েছিলাম, পদ্মা হাউসবোটে ভেসে জমিদারি তদারকির বছরগুলোতে কারও সঙ্গে কথা না বলতে বলতে রবীন্দ্রনাথ কখনো গলার স্বর হারিয়ে ফেলতেন। 'চরের বালুতে ঠেকা/ পরিত্যক্ত তরীসম রহিল সে একা।' প্রকাণ্ড চর, দূরে নদীর রেখা, এই শস্যহীন প্রান্তরের একা দিনগুলোতে তাঁর কলমে ফলেছিল গল্পগুচ্ছের সোনালি শস্য। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, পৃথিবী যখন তাঁর (রবীন্দ্রনাথের) শান্তি কেড়ে নিয়েছে, তখন এই হাউসবোট তাঁকে আশ্রয় দিয়েছে। হাউসবোট একটি প্রতীকী আধার এখানে, বিক্ষুব্ধ প্রতিভার অনন্ত আশ্রয় আসলে একাকিত্ব।
বাংলা কবিতায় নির্জনতম সাক্ষর রেখে গেছেন জীবনানন্দ দাশ। তাঁর পাণ্ডুলিপি ধূসর, তাঁর আকাশে সাতটি তারা উদয় হবার পরেও তিমির অখণ্ড। আমাদের ঠেলে দিয়েছেন নিবিড় নিসর্গে-বিজন শাদা পথে-ধুলি হয়ে যাওয়া ইতিহাসে-গলিত ক্লান্ত প্রাণে-অনন্ত নক্ষত্রবীথিতে-এমন এক চেতনারাজ্যে, যেখানে আগে বাঙালি তার সাবধানী-সংসারি পা ফেলেনি।

'আমি কবি, সেই কবি–
আকাশে কাতর আঁখি তুলি হেরি ঝরা পালকের ছবি!
আন্মনা আমি চেয়ে থাকি দূর হিঙুল-মেঘের পানে!'
সাহিত্যের আরূঢ় ভণিতা- টীকা-টিপ্পনির সিংহাসনচারীরা তাঁকে ছেড়ে কথা কয়নি তাই, আত্মসংশয় মেঘলা করে দিয়েছে আকাশ। তাঁর ব্যক্তিগত একাকিত্ব ব্যঞ্জনা পেয়েছে আমাদের প্রত্যেকের জীবনে–
'সকল লোকের মাঝে বসে
আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা?
আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
আমার পথেই শুধু বাধা?'
জীবনানন্দ একাই এ লেখা জুড়ে থাকতে পারেন। তাই অন্যত্র যাচ্ছি। 'কে যেন ইয়ার্কি করে ব্যাঙের রক্ত ঢুকিয়ে দেয় আমার শরীরে–আমি চুপ করে বসে থাকি–অন্ধকারে'–ভাস্কর চক্রবর্তী ছাড়া এমন লাইন আর কে লিখবেন! কবি ছাড়া আর কার এত সাহস যে লিখবেন–
'ভারতবর্ষের মতো দেশে নিজেকে নিঃসঙ্গ ভাবা অন্ধকার ভাবা অপরাধ।' আশেপাশে আছে, কিছু কিছু প্লাস্টিকের মানুষ। প্লাস্টিকের বউ নিয়ে অনবরতই তারা ঢুকে পড়ছে সিনেমায়। ভাস্কর নোংরা মশারির নীচে কাণ্ডজ্ঞানহীন শুয়ে স্বগতোক্তি করেন–'ছোট এক ঘরে শুয়ে আজ/ মনে পড়ে প্রেমিক ছিলাম', মাঝে মাঝে কেবল জিজ্ঞেস করেন–
'শান্ত একটা হাওয়া আর রেডিয়ো চালিয়ে কেউ ঘুমিয়ে পড়েছে।
যে জীবন পেলে তুমি কেমন লাগছে সে জীবন?
কষ্টকর? খুব একা? খুব বেশি একা?'

কলেজজীবনে আমরা খুব আওড়াতাম নির্মলেন্দু গুণের 'আমি হয়তো মানুষ নই' কবিতাটা কিংবা–
'আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে, আমি চাই
কেউ একজন আমার জন্য অপেক্ষা করুক,
শুধু ঘরের ভেতর থেকে দরজা খুলে দেবার জন্য।
বাইরে থেকে দরজা খুলতে খুলতে আমি এখন ক্লান্ত।'
কিন্তু দরজা খুলে দেবার পরও কবির চাওয়া তো অন্তহীন, হাতপাখার হাওয়া, জল-ভাতে নুন, পাটশাকভাজার সঙ্গে ভাজা শুকনো মরিচ আর কামনা-বাসনাময় কুশলপ্রশ্ন 'তোমার চোখ এত লাল কেন?' আবুল হাসানেও একাকিত্বের স্বর স্পষ্ট, নইলে ভেবে নিতাম বাঙালি মুসলমানের সাহিত্যের ইতিহাসে একাকিত্ব নেই–শুধু দস্তরখান ঘিরে সমষ্টি আছে।
'অবশেষে জেনেছি মানুষ একা!
জেনেছি মানুষ তার চিবুকের কাছেও ভীষণ অচেনা ও একা!'
তাঁর পাতাকুড়োনির মেয়েরা ছায়া কুড়ায়, নাকছাবিহীন মেয়েরা একাকী আত্মহারা। ভিতরে বিষের বালি নিয়ে মুখ বুঁজে মুক্তো ফলায়, সে কি কেবল তাঁর ঝিনুকেরা?

বাংলা গল্পে-উপন্যাসে নিঃসঙ্গ মানুষ প্রচুর। রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছে বলাই একা, সুরবালা একা, ঘাটের কথার কুসুম একা, প্রতিবেশী সেই বালবিধবা একা, কাবুলিওয়ালা একা, মানভঞ্জনের গিরিবালা একা, মেঘ ও রৌদ্রের শশিভূষণ ভারী একা। গোরা একা অথচ সশব্দ, চোখের বালির বিনোদিনীর একাকিত্ব রীতিমতো অস্তিত্বসংকট, ঘরে-বাইরের প্রত্যেকটি চরিত্র একা এবং ইউনিক। বিভূতিভূষণে নিঃসঙ্গতা কিন্তু একাকিত্ব নয়, তাতে অপ্রাপ্তি ও নিষ্ঠুরতম দারিদ্র্য সত্ত্বেও জীবনধর্মের উদযাপন প্রবল ও সংলাপময়। সেটা 'আরণ্যক' হোক, কি 'ঊর্মিমুখর' বা 'স্মৃতির রেখা'। কালভার্টের পাশটিতে যে অযত্নের গাছে রাঙা ফুল ধরেছে, তা-ই বিভূতিভূষণের চরিত্রদের হৃদয় অব্যক্ত আনন্দে ভরিয়ে দিতে সক্ষম। আমার মন চিরদিন বলে এসেছে, ঔপন্যাসিকের হৃদয়ের প্রতিফলন হিসেবে তার চরিত্রের মনে এ আনন্দ উৎসারিত হয়নি, সাধারণ মানুষের জীবন যেকোনো উপলক্ষ ঘিরে আজও আনন্দে অধীর হতে সক্ষম। আমাদের মাটি উর্বর, আমাদের মনোভূমও তাই।
জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর 'গিরগিটি' গল্পে উঠোনের ডুমুর-পেয়ারা-মাদার-পেঁপের জঙ্গলের আড়ালের ঘরে থাকা ভয়্যুরিস্ট বুড়ো ভুবন সরকারকে মনে পড়ল। একই কম্পাউন্ডের প্রতিবেশী প্রণবের স্ত্রী মায়াকে সে চুরিয়ে দ্যাখে। মায়ার যৌবন সুন্দর-শক্ত-জমাট, রবিঠাকুরের 'মায়ার খেলা'র সেই লাইনটার মতো–আপনার মাঝে আপনি হারা আপন সৌরভে সারা। পাড়াগাঁয়ের গাছপালা-আগাছা ছাওয়া-নোনাধরা পাঁচিলে ঘেরা কুয়োতলায় স্নান করবার সময় সে একজিবিশনিস্টের আনন্দ পায়। তাকে একটি পরমসুন্দর বস্তুর মতো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দ্যাখে কে? কে করে নীরস সম্ভোগ আর কে করে সুন্দর স্তুতি? দুজন একান্ত একা মানুষ। একা করে নিয়ে শিকার করতে হয়, গিরগিটি তা জানে।
সুবোধ ঘোষের 'পঙ্কতিলক'-এর সেই মেয়েটি? রেডলাইট ডিস্ট্রিক্টের কাছেই ভদ্রপাড়ার শেষ বাড়িটিতে যে থাকে, খারাপ পাড়ার মেয়েদের মতো সেই বিবাহার্থিনী মেয়েটিকেও সেজেগুজে প্রায়ই পাত্রপক্ষকে গান শোনাতে হয়, নানান লোকে দেখতে আসে তাকে। বিমল করের 'হেমন্তের ঘরবাড়ি' আর সুবোধ ঘোষের 'আগুন আমার ভাই', রূপবিকৃত স্বামীর প্রতি বীতশ্রদ্ধ–পালিয়ে যাওয়া বউয়ের গল্প, স্বামীর হৃদয়ের ফনফনে দহনের গল্প; বিমল করের গল্পে স্বামীটির বুকে হিম ঢুকে গেছে, বিবাগীর সংসার করে সে, সুবোধ ঘোষের গল্পে স্বামী অ্যাসিডের শিশি নিয়ে অপেক্ষমাণ। বিমল করের 'শীতের মাঠ'-এ অতসীর অসুস্থ পঙ্গু স্বামী নবেন্দু সারা দিন মাঠের দিকে মুখ করে বসে থাকে (এমন মাঠের দিকে মুখ করে তাকিয়ে থাকা অসুখী যুগলের কথা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহরও একটি গল্পে ছিল), মাঠের উজ্জ্বল আলো-দমকা বাতাস-অগাধ কুয়াশা সবই খেলে যায় তার জীবনের অ্যালিগরির মতো।

নারীর একাকিত্ব কিন্তু আলাদা। জ্যোতিরিন্দ্রের 'গিরগিটি'র মায়া যেমন, বিমল করের 'অশত্থ'-এর রেণু তেমন, গাছপালাময় ঘেরাটোপে তারা প্রকৃতির কন্যা হয়ে স্নান করে-যেন একলা থাকার ঐ মুহূর্তগুলো আনন্দ-গন্ডূষ ভরে পান করে তারা, উদযাপন করে। গৌরকিশোর ঘোষের 'প্রতিবেশী' উপন্যাসে একাকিনী অমিতা রোগে শয্যাশায়ী–প্রতিদিন জীবনের মুখোমুখি হবার আগে তবু সে সেজে নেয়, ওঁর 'কমলা কেমন আছে'র কমলা একাকী জীবনে অভ্যস্ত। সমরেশ মজুমদার মাতিয়ে দিয়েছিলেন একটি একাকী মেয়ের সংগ্রাম লিখে, তার নাম দীপাবলী (সাতকাহন)। জয় গোস্বামীর 'হৃদয়ে প্রেমের শীর্ষ'র সেই চিরকুমারী শিবুপিসির কথা মনে আছে? যার খোলা চুলে ঝরে পড়ছে অকৃপণ জোছনা, ক্ষীণগলায় গাইছেন–'মধুমালতী ডাকে আয়।' 'যাঁদের কৈশোর ও প্রথম যৌবন নিঃসঙ্গ কেটেছে তাঁরা জানেন, আর এ গান যাঁরা বয়ঃসন্ধিকালে শুনেছেন তাঁরা জানেন, এর বিষাদ কী সাংঘাতিক।'
ফসলের সাধহীন মাঠের শিয়রে চাঁদ চুপচাপ দাঁড়ালে যেমন দেখতে হয়, শিবুপিসিকে তেমন দেখতে লাগছে। এখানে আরেক নায়িকার কথা উল্লেখ না করলেই নয়। তিনি 'ন হন্যতে'র মৈত্রেয়ী দেবী। দোর্দণ্ড প্রতাপ বাবা মেয়েকে শ্বেতাঙ্গ প্রেমিকের সঙ্গে বিয়ে দিলেন না, নিজে কিন্তু পরবর্তী সময়ে সর্বসমক্ষে পরকীয়ায় লিপ্ত হলেন। বিয়ের পর মৈত্রেয়ী মংপুর দুর্গম শৈলাবাসে থাকতে এলেন। অবিশ্রান্ত বৃষ্টির নিশ্ছিদ্র অন্ধকার রাত জনমানবের চিহ্নহীন পথ। সেই অকূল নির্জনতায় স্বামীকে তিনি ভালোবাসলেন। তবে? 'কিছু তবে আছে নাকি? আছে আছে আছে–এই সাজানো সংসারের মধ্যে বসে আমার স্বামীর সস্নেহ ভালোবাসার আশ্রয়ে থেকেও আমার মন কেন এত শূন্যতায় ভরে থাকে কে বলবে? 'শূন্য হাতে ফিরে হে নাথ–পথে পথে'... বারান্দায় আমি আর আমার স্বামী বসে থাকি–আমি দু-চারটে কথা বলবার চেষ্টা করি। কিন্তু কোন ভাষায় কথা বলব?

আমাদের ভাষাই যে পৃথক। তাই একটু পরেই দুজনেই চুপ। এই মানবহীন দেশে শব্দগুলি যেন নির্জনতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে–অন্ধকার বন থেকে একটা 'রাত-কো-চরা' ডেকে ওঠে, একটা বাদুড় ঝুপ করে পড়ে যায়। ঝিঁঝি পোকা ডাকতে থাকে অবিশ্রান্ত ঝিঁ ঝিঁ ঝিঁ–পাশের ঝরনাটাও তো থামে না, ঝরঝরঝরঝর চলেইছে চলেইছে–এ শব্দগুলো মানুষের সঙ্গী নয়–এরা কেবল বলতে থাকে, তুমি একলা, তুমি একলা–আমি বুঝতে পারি, প্রতিদিন বুঝতে পারি আমার জগৎটা হারিয়ে গেল।' বাংলা ভাষায় এমন মর্মন্তুদ একাকিত্বের সাহসী বিবরণ আর আছে বলে আমার মনে হয় না।
মৈত্রেয়ী দেবী বিশ্বাস করতেন মানুষের সংস্পর্শে-সংঘাতে নিত্যমথিত না হলে কেউ লিখতে পারে না। একটি সিনেমায় এর পক্ষে আর বিপক্ষে উভয় সুরই বেজেছে, নাম 'প্যাটারসন'। মফস্বল শহরের এক বাস ড্রাইভার তার প্রতিদিনকার রুটিনবাঁধা জীবন চালায়, আড়ালে ভারী চমৎকার কবিতা লেখে। স্ত্রীর সঙ্গে তার পার্থক্য বিস্তর, প্যাটারসনের জীবন মন্থর, এত অন্তর্গত সে জীবনের প্রাপ্তিযোগ যে চোখে পড়ে না। ভারী ফাঁকা মনে হয়। একই ধাঁচের রুটিনবদ্ধ জীবন 'পারফেক্ট ডেইজ'-এর হিরায়ামার, তারও আছে সাধনা।
সিনেমায় নির্জন মুহূর্তের কথায় মনে পড়ল–'দ্য স্পিরিট অব সেইন্ট লুইস'-এর কথা, পর্দায় দীর্ঘ সময় ধরে অভিনেতা দুজন–জিমি স্টুয়ার্ট আর একটা মাছি। একাকী আর কোণঠাসা 'সানসেট বুলেভার্দ'-এর নরমা ডেসমন্ড আর 'আ স্ট্রিটকার নেমড ডিজায়ার'-এর ব্লঞ্চ দ্যবুয়াঁ, ওই যে তার শেষ কথাটি, '(তুমি) যে কেউ হও না কেন, আমি চিরদিন অচেনা মানুষের দয়াদাক্ষিণ্যের ওপর নির্ভর করেছি।' কিচেনসিংক ড্রামার প্রায় সব নায়ক-নায়িকা গভীরভাবে একা, এ নিয়ে অন্যত্র লিখেছি বলে এখানে এ প্রসঙ্গ দীর্ঘ করছি না। আচ্ছা, 'গণশত্রু'র সেই প্রগতিশীল ডাক্তারকে ভুলে গেলাম কী করে! 'আগন্তুক'-এর সেই মামা? সমাজের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে উদার উন্মুক্ত মানুষ এঁরা, তাই বড্ড একা।
ডোপামিন, সেরোটোনিন, এন্ডোরফিন, অক্সিটোসিন...আনন্দের আরক দেহে যত, তারা কি সবাই সঙ্গনির্ভর? 'দুইজনে পাশাপাশি যবে/ রহে একা, তার চেয়ে একা কিছু নাই এ ভুবনে।' এডগার দেগার 'অ্যাবসিন্থপায়ী যুগল', মুঙ্কের 'সেপারেশন'-এ যুগলের নিঃসঙ্গতা, 'টু উইমেন অন দ্য শোর'-এ অপেক্ষমাণ দুই নিঃসঙ্গ নারীকে ভেবে দেখুন। নিঃসঙ্গ সাধনা ছাড়া যে মোক্ষ মেলে না! আপনা থেকে বাছাই করে নেয়া যে নিঃসঙ্গতা–তার উপকার অনেক। আপনার হাতে তখন নিজের সৃজনশীল কাজটি করবার অঢেল সময়, সামাজিক পীড়ন ও উদ্বেগ কম, চিন্তাভাবনা স্বচ্ছতর ও স্বাধীনতর। আত্মানং বিদ্ধি তথা নিজেকে জানবার ঢালাও ফুরসত। হয়তো তাই শিল্পীরা শেষ পর্যন্ত একাকী।

পেন্টিংয়ের ইতিহাসে একাকিত্ব বহু রূপে ঘুরেফিরে এসেছে। ফ্রিডরিশের 'ওয়ান্ডারার অ্যাবভ দ্য সি অব ফগ', অঁরি রুশোর 'ক্রান্তীয় ঝড়ে বাঘ', 'ঘুমন্ত জিপসি', 'সাপুড়ে' এমনকি 'উৎসবের সন্ধ্যা'ও বড় একাকিত্বে মোড়া। হুইসলারের 'মা' ধূসর দেয়ালের পটে শূন্যমনা। লাউরির 'দেয়ালে ঘুমন্ত মানুষ' তো বটেই, কারখানায় ঢুকতে থাকা বা বের হওয়া মানুষের মিছিলেও একাকিত্বের গভীর ব্যাধি উপস্থিত। এন্ড্রু ওয়ায়েথের 'ক্রিস্টিনাজ ওয়ার্ল্ড'-এ ভূলুন্ঠিত অসুস্থ ক্রিস্টিনার কাছ থেকে তার ঘর কত না দূরে! ভ্যান গখ (নিজের সহ) যাঁদের পোর্ট্রেট করেছেন, প্রতিটিতে রঙের অত জৌলুসের পরেও খেলা করে যায় নিবিড় নিঃসঙ্গতা–তাঁর ক্যানভাস ঐ অনুভবেই তার/প্রাইম করা।
একাকিত্বের বিপদও সাংঘাতিক। জগদ্বিখ্যাত সুইডিশ ব্যান্ড 'অ্যাবা'র সোনালিচুলো গায়িকা অ্যা'নেথা, গানের দল ভাঙবার পর আড়ালে চলে যান–খামারবাড়িতে থাকতে শুরু করেন, এক বছরের ভেতর মায়ের আত্মহত্যা আর বাবার মৃত্যুর পর গভীর অবসাদে নিমজ্জিত হন অ্যা'নেথা। অনেক দিন ধরে এক ডাচ ফর্কলিফট ড্রাইভার গ্রাফ অ্যা'নেথার পিছু নিয়েছিলেন, ডিপ্রেশনের একপর্যায়ে অ্যা'নেথা অখ্যাত গ্রাফের কাছে ধরা দেন। পরবর্তী সময়ে গ্রাফের অসুস্থ অবসেশন থেকে তাঁকে পালাতে হয়।
অ্যাবিউজে সাধারণত অ্যাবিউজার তার ভিক্টিমকে প্রথমেই সামাজিক অন্যান্য সংযুক্তি (বন্ধুবান্ধব-আত্মীয়স্বজন) থেকে বিচ্ছিন্ন করে নেয়, গ্রুমিং বা মগজধোলাই করা সহজ হয়, পারিবারিক সহিংসতার বেলায়ও এই প্যাটার্ন লক্ষণীয়। কখনো সহিংসতার জন্য সুবিধাজনক হিসেবে অ্যাবিউজার বেছেই নেয় এমন মানুষকে যে একা।
চল্লিশের দশকে জেমস মেসন অভিনীত 'দ্য সেভেন্থ ভেইল' বা ইনগ্রিড বার্গম্যানের 'গ্যাসলাইট' মনে করে দেখুন। আবার অনেক মানসিক রোগে রোগী নিজেই দৈনন্দিন জীবনে একা থাকতে ভালোবাসে। মাদার তেরেসা বলেছিলেন, 'সবচেয়ে ভয়ানক দারিদ্র্যের নাম একাকিত্ব আর অনাদর।' আর মেরিলিন মনরো বলেছিলেন, 'একাকিত্ব তাঁকে পুনরুদ্ধার করে নেয়।' নিঃসঙ্গতার বহুবিধ রূপ, ধ্বংসের আবার সৃষ্টিরও। উভয়ই সত্য। চ্যাপলিনের মতে আমরা জন্মাই-জীবন বাই-মরে যাই...সবই একা।