অন্য কারও ঘুমের ভেতর

পৃথিবী ঘুমের আকার। অনেক আগে একবার হাঁটতে হাঁটতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। এখনো মাঝেমধ্যে মনে হয়, সেই ঘুমের মধ্যেই যেন আছি। ঘুমের মধ্যে একটা জীবন, আর যা কিছু বাস্তব তা স্বপ্নের মতো কিছু একটা। এমন কিছু সত্যি হলে অবশ্য মন্দ হতো না। দিন শেষে ঘুমই যে চিরসত্য।
অনেক বছর আগে এক দুপুরে জ্বর নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, টানা দুই দিন ঘুমেই কেটেছে। জীবন থেকে দুইটা দিন কোনো কারণ ছাড়াই হারিয়ে গেল। এখনো হুটহাট দিনটার কথা মনে পড়ে। সেদিন আমি যেন ঘোরগ্রস্ত কোনো অলৌকিক প্রাণী। আধো ঘুমে এক-আধবার চেষ্টা করেও জেগে উঠতে পারিনি। মনে হচ্ছিল, সেটাই হয়তো শেষ ঘুম। এখন ভাবলে মনে হয়, ৪৮ ঘণ্টায় অনেক কিছু করতে পারতাম। আসলে কিছুই করা হয় না শেষ পর্যন্ত। শুধু বয়ে যাওয়া। না ঘুমিয়ে সময় নষ্ট করা। এখনো অনেক নির্ঘুম রাতের বদলে সেই ঘুমিয়ে কাটানো ২টি দিনই বেশি তৃপ্তি দেয়।
আচ্ছা, সেদিন যদি ঘুমটা আর না ভাঙত! খুব বেশি কিছু বদলাত? একজন মানুষের চিরঘুমে পৃথিবীর তেমন কিছুই আসে যায় না, সে কেবল তার বুক থেকে ২১ গ্রামের একটা ভার নামিয়ে ফেলে।
প্রচুর মানুষ প্রতিদিন ঘুমানোর পর আর জেগে উঠছে না। অনেক মানুষ জানতে পারছে না পরদিন সকালের গল্পটা কেমন। সেই সকালটায় কী রোদ ছিল নাকি বৃষ্টি, তা-ও জানতে পারে না। সে হয়তো জানে শুধু একটা অন্ধকার টানেলের কথা। মানুষটা সেই অন্ধকার টানেলে ঢুকছে কিন্তু আর বেরোতে পারছে না। এই শেষ ঘুমটা নিয়ে আমি প্রায়ই ভাবি। ভাবি, একটা লেমন ইয়েলো সন্ধ্যা মুহূর্তের মধ্যে কীভাবে ধূসর হয়ে যাচ্ছে। একটা ঘুম হারিয়ে যাচ্ছে তুমুল ঘুমের জাদুর বাক্সে। যে বাক্স আর কখনোই খুলবে না। কেউ খুলবে না।
ঘুম আমাকে সব সময় মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়। এই লেখাতেও যাচ্ছে, যাবে। ছোটবেলায় কোথায় যেন পড়েছিলাম, ঘুম হচ্ছে সাময়িক মৃত্যু। সেই কথাটা মাথায় গেঁথে আছে। মৃত্যুর সঙ্গে ঘুমের সম্পর্ক নিয়ে আমি একসময় অনেক ভেবেছি। বলা বাহুল্য, কোনো কূলকিনারা মেলেনি শেষ পর্যন্ত।
খুব গভীরভাবে ভাবলে দেখবেন মানুষের বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়ার মধ্যে যৌক্তিক কারণ বেশি। বেঁচে থাকার মধ্যে নতুন কিছু নেই। সেই রিপিটিটিভ বিরক্তিকর একঘেয়ে একটা জীবন। তবুও বেশির ভাগ মানুষ বেঁচে থাকে। কারণ, তারা অলৌকিক কিছুর অপেক্ষায় থাকে। তাদের মনে হয়, ঘুম ভাঙলে হয়তো সব অন্য রকম হয়ে যাবে। এভাবে প্রতিদিন একই আশা নিয়ে ঘুমাতে যায় তারা। আগেই অবশ্য বলেছি, কেউ কেউ আছেন, যারা সেই ঘুম থেকে আর জাগেন না। কারণ, ঘুম এক নির্লিপ্ত ঘুণপোকা। আর ঘুমের ভেতর তারা খুঁজে পায় ক্রিমওয়ালা সুস্বাদু বিস্কুট।
একসময় রাত জাগার বাজে অভ্যাস ছিল। সিনেমা দেখতে দেখতে প্রচুর রাতকে ভোরে বদলে দিয়ে তারপর ঘুমাতে যেতাম। সেই দিনগুলোতে ঘুম পেলেই টিনের বাক্স বের করে বিস্কুট খেতাম। বিস্কুট খেয়ে ঘুম তাড়াতাম। শুনতে অদ্ভুত মনে হলেও এটা কিন্তু সত্যি। সে সময়েই কোনো রাতে 'শেফালি কি জানে'তে লিখেছিলাম, 'এরপর আর কিছু নেই। বিস্কুটের গুঁড়ো, রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং কার্ল মার্ক্স–কোনোটাই তারা ঠিকঠাক বুঝতে পারে না। তারা মূক কিংবা বধির–কোনোটাই নয়। তাদের কেবল ঘুম আসে। অনেকটা রিপভ্যান উইংকেল কিংবা আসহাবে কাহাফের সদস্যদের মতো। বেশি ঘুম এলে তারা বিস্কুট খেতে শুরু করে। সারা রাত ধরে বিস্কুট খেতে থাকে। সকাল হওয়া পর্যন্ত তারা বিস্কুট খেতে থাকে। বিস্কুট শেষ হয়ে গেলে তারা মিথ্যা মিথ্যা বিস্কুট খুঁজতে থাকে। এ সময় সকাল হলে দোকান থেকে বিস্কুট কিনে আনে। আবার বিস্কুট খেতে থাকে। আবার বিস্কুট শেষ হয়ে গেলে তারা বিস্কুট খোঁজার ভান করে। আবার সকাল হলে তারা দোকান থেকে বিস্কুট কিনে আনে। তারা জানে পৃথিবীতে তারা কেবল বিস্কুট খেতে এসেছে। ঘুম পেলেই তারা বিস্কুট খেতে শুরু করে আর হলুদ শুয়োর স্বপ্ন দেখে।'
ঘুম মানে কিন্তু স্বপ্নও। জেগেও আপনি স্বপ্ন দেখতে পারেন। কিন্তু সেটা কখনো ঘুমিয়ে দেখা স্বপ্নের মতো হয় না। জেগে দেখা স্বপ্নের লাগাম আপনার হাতে থাকে আর ঘুমের মধ্যে দেখা স্বপ্নের নাটাই থাকে অন্য কোনো জগতে। নয়তো একই দৃশ্যে কীভাবে অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ এক হয়ে যেতে পারে! বেশ অদ্ভুতই বটে।
ঘুমের ভেতর নাক-ডুবিয়ে রাখার পরও শেষ পর্যন্ত মানুষের ভেতর জমে থাকা কষ্টকে ঘুমও আড়াল করতে পারে না। গোঙানির ভেতর হুটহাট ফিরে আসে সেই সব কষ্ট। হ্যাঁ, এই কষ্টটুকু মিথ্যা নয়। ঘুম ও মৃত্যুর মাঝে এই কষ্টটাই ঝাউবনের মতো দুলতে থাকে। এই দুলতে থাকাটাই শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকা। ঘুমিয়ে থাকা।
ঘুম সব সময় ব্যক্তিগতভাবে আমাকে কৌতূহলী করেছে। মানুষের ঘুমের ভঙ্গি, ঘুমের সময় মুখের অভিব্যক্তি কিংবা ঘুমের গভীরতা অনেক ভাবায়। আমার মাকে দেখতাম পিন পতনের শব্দেই ঘুম ভেঙে যেতে। আবার মামার ঘুম এতই গভীর যে বোমা মেরেও সে ঘুম ভাঙানো যায় না। আমার সম্ভবত দুটোর মাঝামাঝি কিছু একটা হবে। অন্য সবকিছুর মতোই গড়পড়তা। না খুব গভীর না খুব হালকা।
ঘুম নিয়ে লিখতে গিয়ে এক বন্ধুর কথা মনে পড়ছে। একবার চুয়েটের কোনো এক হলে তার রুমে গিয়ে থেকেছিলাম। তুমুল শীতের রাত, হঠাৎ দেখি ফ্যানের শব্দ। চোখ খুলে দেখি সেই বন্ধুর মোবাইল ফোন থেকে শব্দটা আসছে। অবাক হয়ে জানতে চাইলে বলল, ফ্যানের শব্দে ঘুমানোর অভ্যাস হয়ে গেছে। এটা না শুনলে তার ঘুম আসে না। যেহেতু শীতে ফ্যান চালানোর উপায় নাই, তাই শব্দ রেকর্ড করে রাখা। এই শব্দ শুনেই সে ঘুমাত। জানি না এখনো তার সেই অভ্যাস আছে কি না? হয়তো আছে, হয়তো নাই।
ঘুম আমার ভালো লাগার আরেকটি কারণ ঘুম আলো থেকে কিছু সময়ের জন্য আড়াল করে রাখে। আলোকে ভুলে থাকার এই প্রাণান্ত চেষ্টার ক্ষেত্রে ঘুম অনেকটা মহৌষধের মতোই। এখন আমার মনে পড়ছে জন কিটসের 'ঞড় ঝষববঢ়' কবিতার কথা। তিনি লিখেছিলেন:
'O soft embalmer of the still midnight,
Shutting, with careful fingers and benign,
Our gloom-pleased eyes, embowered from the light,
Enshaded in forgetfulness divine.'
আমরা সব সময়ে আলো থেকে আড়াল খুঁজি। আলো থেকে আড়াল করে রাখার প্রার্থনাটুকু সর্বজনীন। আমরা সবাই জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে আলো থেকে দূরে থাকতে চাই। ঘুমই আমাদের শেষ পর্যন্ত সাময়িকভাবে সেই স্বস্তিটুকু দেয়।
লিখতে লিখতে ঘুম নিয়ে আরও কিছু ব্যক্তিগত আলাপ মনে পড়ে গেল। বংশানুক্রমিকভাবেই আমার চোখ সব সময় লাল থাকে। দেখলে নাকি মনে হয়, হয় ঘুম থেকে উঠেছি কিংবা গিয়ে ঘুমাব। এ নিয়ে অনেক সময় বিব্রতকর পরিস্থিতিতেও পড়তে হয়েছিল। এখনো হুটহাট কেউ কেউ জিজ্ঞেস করে, ঘুমিয়ে এসেছেন নাকি গিয়ে ঘুমাবেন? এসব প্রশ্নের উত্তরে এখন আর কিছু বলি না, মুচকি হেসে এড়িয়ে যাই।
ঘুমের মধ্যে আমি অবশ্য অনেক মানুষকে হাসতে দেখেছি। বিশেষ করে শিশুদের। সেই হাসি ঠোঁট থেকে শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে চিবুক পর্যন্ত। আমি ভাবি, ঘুমের ভেতর জীবনের না জানা কোনো রহস্যের সন্ধান সে পেয়েছে? ঘুম কি কোনো তুমুল দার্শনিক অভিজ্ঞান নাকি অজানা কোনো প্রেমিকার লেখা চিঠি! এসব ভাবতে ভাবতেই হাসি থেমে যায়। দুপুরের মৃদু আলো এসে পড়ে সেই ঠোঁটে। আমরা যে যার মতো ব্যস্ত হয়ে পড়ি। ঘুমের ভেতর হাসিতে জড়িয়ে থাকা সেই মায়া আর কোথাও থাকে না। যেন নিষ্পাপ মানুষের দেশ থেকে সে ফিরে এসেছে নিজ ভূমিতে। পাপের দেশে।
ঘুমের কথা বললে স্বাভাবিকভাবেই আসে আসহাবে কাহাফের সাত সদস্যের ঘুমের কথা। বাদশার দেওয়া মৃত্যুর ফরমান থেকে বাঁচতে পালিয়ে যাওয়া ক্লান্ত সাত যুবক আশ্রয় নেয় একটা গুহায়। বাইরে তাদের পাহারা দেয় এক কুকুর। ভ্রমণের ক্লান্তি গায়ে জড়িয়ে গুহার মধ্যেই যুবকেরা ঘুমিয়ে পড়ে। এটা এমন ঘুম, যা কেবল নিজেকেই দীর্ঘায়িত করে। বলা হয়, 'যুবকেরা এমনভাবে ঘুমিয়েছিল যেন তাদের চোখগুলো খোলা, দেখে মনে হবে তারা জেগেই আছে। আর কুকুরটি গুহার বাইরে দুই পা প্রসারিত করে বসে থেকে তাদের পাহারা দিচ্ছিল। এমন অবস্থায় যে কেউ দেখলে তাদের হিংস্র শিকারির দল মনে করে ভয়ে পালিয়ে যাবে।' অদ্ভুত সেই ঘুম। এভাবে তারা ঘুমাল টানা তিন শ বছরের বেশি। এরপর ছোট বিরতি, তারপর চিরঘুম।
ওয়াশিংটন আরভিংয়ের রিপ ভ্যান উইংকেল আবার ২০ বছর ঘুমিয়েছিল। আমিও চাই এমন ঘুম। ৩০০ বা ২০ বছর না হোক–২, ৩ কিংবা ৪ বছরের একটা ঘুম তো হতেই পারে। যে ঘুমে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাবে বেঁচে থাকার সমস্ত ক্লান্তি। তবে স্বপ্ন দেখব এমন কোনো ঘুম নয়। গভীর এক ঘুম, নিষ্প্রভ সেই ঘুণপোকার মতো।
ঘুম যে শেষ পর্যন্ত খুবই বিষণ্ন কিছু, কবি-সাহিত্যিকদের লেখা বারবার সে কথা মনে করিয়ে দেয়। ফ্রাঞ্জ কাফকার 'মেটামরফোসিস'-এর গ্রেগর সামসা কিন্তু ঘুম থেকে জেগেই নিজেকে পোকায় রূপান্তরিত অবস্থায় আবিষ্কার করেছিলেন।
জীবনানন্দ দাশও ঘুমকে রীতিমতো বিধ্বংসী রূপে হাজির করেছেন:
'কোনোদিন ফুরুবে না শীত, রাত, আমাদের ঘুম?
ফুরুবে না। ফুরুবে না।
কোনোদিন ফুরুবে না শীত, রাত, আমাদের ঘুম?
না, না, ফুরুবে না।
কোনোদিন ফুরুবে না শীত, রাত, আমাদের ঘুম?
ফুরুবে না। ফুরুবে না। কোনোদিন–'
কিংবা রবার্ট ফ্রস্টের অতি ব্যবহারে ক্লিশে হয়ে পড়া সেই লাইনগুলোর কথাও বলতে পারি:
'The woods are lovely, dark and deep, But I have promises to keep, And miles to go before I sleep.'
আমি অবশ্য ঘুমানোর আগে কোথাও যেতে চাই না। আমার শেষ পর্যন্ত আর কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। আমি কেবল ঘুমের প্রস্তুতি নিতে চাই। একটু পরেই ঘুমিয়ে পড়ব, এই আনন্দটুকু উপভোগ করতে চাই। আর এটুকু নিয়েই ঢলে পড়তে চাই একটা নিরুপদ্রব ঘুমের ভেতর। এই এখন লেখাটা এটুকু লিখতে লিখতে আমার ঘুম পাচ্ছে...এটুকুই থাক...