ফুটপাতে ব্যুফে: নেই ক্যাশিয়ার, নেই মেসিয়ার, পেটভরে খেয়ে বিল দিয়ে যান

পরিকল্পনাটি একেবারেই সাদামাটা। টেবিলে সাজানো থাকবে খাবার—দুই ধরনের মাংস, ডিম, সবজি আর ভাত। যার যতটুকু দরকার, নিজেই তুলে নেবেন, খাওয়া শেষে দাম পরিশোধ করবে ক্যাশবাক্সে। তবে নতুনত্ব হলো—এটি কোনো বিলাসবহুল রেস্টুরেন্টের ব্যুফে নয়; ফুটপাতে এক সাধারণ ভাতের হোটেল।
নিম্ন আয়ের মানুষের কথা ভেবে শুরু হওয়া এই উদ্যোগ অল্প সময়েই রাজধানীতে সাড়া ফেলেছে। মাত্র তিন কেজি চাল দিয়ে শুরু করা হোটেলে এখন প্রতিদিন রান্না হয় এক মণ চালের ভাত।
দুই সপ্তাহ আগেও হোটেলের মূল ক্রেতা ছিলেন রিকশাচালক ও শ্রমিকেরা। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর বদলে গেছে দৃশ্যপট। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসছেন এই 'গরিবের ব্যুফে' দেখতে ও খেতে।
তবে 'ব্যুফে' কী বা কীভাবে এমন আয়োজন করতে হয়, তা জানেন না হোটেলের মালিক মিজানুর রহমান। তিনি শুধু জানেন, এই শহরে অনেক মানুষ পেটভরে দু'বেলা ভাত খেতে পারে না। সেই মানুষদের জন্যই তার এই আয়োজন।
পুঁজি কেবল 'বিশ্বাস'
মিজানুরের বাড়ি চাঁদপুরের হাইমচরে। ৯০-এর দশকের শুরুতে তিনি ঢাকায় আসেন। কারওয়ান বাজারে সবজি কুড়িয়ে জীবিকা চলত তার। পরে শুরু করেন শাকসবজির ব্যবসা। সর্বশেষ কাজ করেছেন একটি রিকশা গ্যারেজে।

সেসময় পেটভরে ভাত খেতে হলে তাকে বেগ পেতে হতো। অর্থের অভাবে বহুদিন আধপেটা খেয়েছেন। নিম্ন আয়ের শ্রমিক ও রিকশাচালকদের কষ্ট তিনি ভালো করেই জানেন। তাই বছরখানেক আগে ঠিক করেন, খুলবেন ভাতের হোটেল—যেখানে তিনি নিজেও খাবেন, আর অন্যদেরও ভরপেট খাওয়াবেন।
মানুষের প্রতি বিশ্বাস থেকেই উদ্যোগের শুরু, জানালেন মিজানুর। "আমার হোটেলে কোনো ক্যাশিয়ার, মেসিয়ার, কিছুই নাই। সবাই নিজে এসে প্লেট নেবে, ভাত নেবে, নিজের হাতে মাংস তুলে নেবে। খেয়ে বিল ক্যাশবাক্সে দিয়ে যাবে।" খেটে খাওয়া মানুষ যাতে তৃপ্তি সহকারে খেতে পারেন, সেই ভাবনা থেকেই এ নিয়ম করেছিলেন তিনি। জনপ্রিয় হবে—প্রথমে তা ভাবেননি।
হোটেলে থাকে তিন-চার ধরনের খাবার। গরুর মাংস-ভাত ১০০ টাকা, মুরগির মাংস-ভাত ৮০ টাকা, ডিম-ভাত ৬০ টাকা। এছাড়া শুধু রিকশাচালকদের জন্য সবজি দিয়ে ভাত পাওয়া যায় ৪০ টাকায়। এক টুকরো মাংস বা একটি ডিমের সঙ্গে যতবার ইচ্ছে ভাত ও তরকারি নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।

"ভাত চৌদ্দবার কইরা নেক কেউ, আমার সমস্যা নাই। যত ইচ্ছা খাইবেন। নিজে উঠাইয়া নিবেন। দাম একই," বললেন মিজানুর। "কে টাকা দিলো না দিলো, দেখার টাইম নাই আমার। নিজেই সব করি। পাশের লোকজন বলে অনেকে নাকি টাকা দেয় না, দুই-তিন পিস মাংস নেয়। আমি দেখি না। সবার প্রতি বিশ্বাস আছে আমার।"
ওয়ান ম্যান আর্মি
আগারগাঁও তালতলা বাসস্ট্যান্ডের সামানেই মিজানুরের ভাতের হোটেল। সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত চলে এর কার্যক্রম। দীর্ঘ এই সময়ে হোটেলের সব কাজ একাই সামলান মিজানুর।
ভোরে বাজার করতে বের হন তিনি। তালতলা বাজার থেকে চাল, সবজি, মাংস ও অন্যান্য মুদিপণ্য কিনে আনেন। এরপর শুরু হয় কাটা-ধোয়ার কাজ। সকাল ৮টার আগেই রান্না শুরু হয়, আর সারাদিন চলে পালা করে রান্না। ফাঁকে ফাঁকে প্লেট ধোয়া, লেবু কাটা, পানি পরিবেশন—সবই করেন নিজ হাতে।
সেলফ-সার্ভিস হলেও খদ্দের বাড়ায় এখন বেশ চাপ সামলাতে হয় তাকে। "দম নিতেই কষ্ট হয়, জিরানোর সময় নাই, শরীরে কুলায় না ভাই," বললেন মিজানুর। তবে যাদের পেটভরে ভাত খাওয়ানোর জন্য তিনি এই হোটেল খুলেছিলেন, একদিনও যদি কাজ বন্ধ থাকে—তারা খাবেন কোথায়? তাই আপাতত বিশ্রামের কথা ভাবছেন না তিনি।

খাবারে তৃপ্তির ঢেকুর
মিজানুরের এই পরিশ্রম বৃথা যায় না। তার রান্না খেয়ে প্রশংসা না করা মানুষ খুব কমই আছে। ইটের চুলায় কাঠের ধীর আগুনে রান্না হওয়ায় অনেকে এখানে পান বাড়ির খাবারের স্বাদ।
তিনি কিনে আনেন বিআর-২৮ জাতের চাল, আর গরুর মাংস নিজে দাঁড়িয়ে বেছে নেন। কসাইকে আগেই বলে দেন, টুকরোগুলো যেন সমান হয়। ভাত রান্না হয় চার দফায়, আর মাংস দুইবারে।
হাসপাতালে কর্মরত আবুল কালাম প্রায়ই দুপুরে আসেন এখানে খেতে। তার ভাষায়, "স্বাদটা খুব ভালো। বাড়ির মতো খাবার—অতিরিক্ত তেল-মশলা নেই। নিজের মতো করে যা খুশি খাওয়া যায়, মনে হয় বাড়িতেই খাচ্ছি।"

রিকশাচালক মোহাম্মদ জাকিরও সন্তুষ্ট, "খাবারের মান ভালো, সবকিছুই ভালো। ভাত নিলাম তিনবার। অন্য জায়গায় ৬০ টাকা খালি ভাতের দাম, এখানে মুরগি দিয়া খাইতেছি ৮০ টাকায়।"
কী পরিমাণ বিক্রি
সপ্তাহ দুয়েক আগে হোটেল বন্ধ করে আবার শাকসবজির ব্যবসায় ফেরার কথা ভাবছিলেন মিজানুর। ঠিক সেই সময় কাকতালীয়ভাবে একটি ইউটিউব চ্যানেল তার অভিনব উদ্যোগ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে সামাজিক মাধ্যমে। এরপর থেকে প্রতিদিনই বাড়ছে ক্রেতা ও দর্শনার্থীর ভিড়।
শুরু করেছিলেন মাত্র তিন কেজি চাল দিয়ে। এখন দৈনিক রান্না করতে হয় এক মণেরও বেশি চাল। তবে এত বেশি রান্না মানেই যে লাভও অনেক বেড়েছে—তা নয়। বর্তমানে প্রতিদিন ২৮ থেকে ৩০ হাজার টাকার বিক্রি হয়। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন হয় বড় অঙ্কের পুঁজি। শুধু দুই ধরনের মাংস কিনতেই প্রায় ১৫ হাজার টাকা খরচ হয়। অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ মিলিয়ে লাভ খুব বেশি নয়, তবে আগের চেয়ে ভালোই চলছে পরিবার।

"দৈনিক ৪০০ মানুষ খায় এখন। অনেকে ফেসবুকে দেইখা চইলা আসে। আমার বাজারের টাকা থাকে না, বাজার করি বাকিতে। মুদি দোকানে বাকি রাইখা আসি। বিক্রি শেষ কইরা টাকা দিয়া আসি," বললেন মিজানুর।
তবে এই অতিরিক্ত প্রচারণা বিপদ ডেকে আনছে তার জন্য, সেটিও বললেন তিনি।
ভাইরালের যন্ত্রণা
মেট্রোতে চড়ে সকাল ১১টার দিকে দোকানের সামনে পৌঁছানো যায়। দূর থেকেই দেখা যায় মানুষের ভিড়। ফুটপাতের একই সারিতে আরও দুটি খাবারের দোকান থাকলেও সেখানে কয়েকজন ক্রেতা—কিন্তু মিজানুরের দোকানে বসার মতো জায়গাই নেই।
দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে অনেকে ভিডিও করছেন, কেউ ফেসবুক লাইভে ব্যস্ত। এই ভিড়ের কারণে ঠিকমতো কাজ করতে পারছেন না মিজানুর। খাবার খেতে আসা গ্রাহকরাও ফুড ভ্লগারদের প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে অস্বস্তিতে পড়ছেন।

'ভাইরাল' শব্দের অর্থ বোঝেন না মিজানুর, তবে জানেন—ফেসবুক আর ইউটিউবে প্রচারের পর গণমাধ্যমগুলো আসতে শুরু করেছে। গত দুই সপ্তাহ ধরে তিনি এই ভাইরাল হওয়ার অম্লমধুর অভিজ্ঞতা সহ্য করছেন।
"ভাইরাল হইয়া যন্ত্রণা হইছে ভাই। এত রানবে কে? বসার জায়গা নাই, চেয়ার-টেবিল নাই। পাবলিক আইয়া দাঁড়ায় থাকে। দুইটা লোক যে টাকা দিয়া রাখমু, সেই ক্ষমতা তো আমার নাই," দুঃখ প্রকাশ করলেন মিজানুর।
তবে এর বাইরেও আরও বড় একটি ভয় কাজ করছে তার মনে। "ভাইরাল হইছি, এখন প্রশাসনের নজর পড়ছে। অনেকে বলে ফুটপাত থেকে উঠায় দিবো, হোটেল ভাইঙ্গা দিবো। সরকারি লোকের ক্ষমতা আছে। কিন্তু আমাগো ফুটপাত ছাড়া কী আছে? গাছতলায় বইসা আমরা ভাত খাই, হেইডা যদি পছন্দ না হয়, তাইলে ভাইঙ্গা দেক।"

আপাতত দোকান নেওয়ার কথা ভাবছেন না তিনি। সে পুঁজিও নেই। 'ভাইরালের যন্ত্রণা' শেষ হলে পরিপাটি করে এই দোকানটিই চালাতে চান তিনি। ভবিষ্যতে কী করবেন, তা ভবিষ্যতই বলবে, এমনটাই অভিমত এই ব্যবসায়ীর।
ছবি: জুনায়েত রাসেল/দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড