বিমানবন্দরের আগুন কেন দ্রুত ছড়াল, কার্গো ভিলেজে কী থাকে?

শনিবার (১৮ অক্টোবর) দুপুর থেকে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ (আমদানি কমপ্লেক্স) ও এর আশপাশে ভয়াবহ আগুন জ্বলছে। ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। রাত পৌনে নয়টায় আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে বলে জানানো হয় বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে। উন্মুক্ত স্থানে আগুন লাগলেও তা নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের বেশ বেগ পেতে হয়েছে। এতে প্রশ্ন উঠেছে, আসলে কার্গো ভিলেজে কী থাকে? এবং কেন আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে এত সময় লাগছে?
হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মতো বিশ্বের প্রায় সব আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাত্রী চলাচলের পাশাপাশি পণ্য আমদানি ও রপ্তানির কাজও হয়। যাত্রীরা টার্মিনালের মাধ্যমে চলাচল করেন, কিন্তু আকাশপথে পণ্য পরিবহনের প্রক্রিয়া কিছুটা ভিন্ন। সরাসরি বিমানে কিংবা কার্গোতে পন্য আনা নেওয়া করা হয় না। কোনো পণ্য আমদানি বা রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্ক বিভাগ, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ, বিমান সংস্থা এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে হয়। এসব কার্যক্রমের কেন্দ্রস্থলকেই বলা হয় কার্গো ভিলেজ।
শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজটি আমদানি ও রপ্তানি কার্গো স্পটের দুটি ভবনের মাঝামাঝি অবস্থিত। এখানে মূলত আমদানি করা পণ্য সংরক্ষণ করা হয়। এমনকি আমদানি ভবনের আশপাশেও খালাসের অপেক্ষায় পণ্য রাখা থাকে। বিমান বাংলাদেশের অন্তত দুইজন কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে (টিবিএস) জানিয়েছেন, ভবনের পাশে রাখা এসব পণ্য সাধারণত সদ্য আমদানিকৃত।
ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মকর্তা টিবিএসকে জানান, 'প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে যে কার্গো ভিলেজের কার্গো গোডাউন থেকে আগুনের সূত্রপাত ঘটেছে।'
বিমান বাংলাদেশের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, 'আমি দীর্ঘদিন বিমানবন্দরের ভেতরে ডিউটি করেছি। যদিও আমরা সরাসরি কার্গো ভিলেজে দায়িত্ব পালন করি না, তবে সেখানে কী ধরনের পণ্য থাকে সে বিষয়ে ধারণা আছে। যেখান থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে, সেখানে সাধারণত দাহ্য পদার্থ থাকে। এর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল, গার্মেন্টস পণ্য, প্লাস্টিক সামগ্রীসহ এমন অনেক কিছু থাকে যা আগুনের সংস্পর্শে সহজেই জ্বলে উঠতে পারে।'

তিনি আরও বলেন, 'শুরুতে যেখানে আগুন লাগে, সেখানে থাকা দাহ্য পদার্থগুলোর কারণে পানি ছিটানোর ফলে আগুন আরও ছড়িয়ে পড়ে। আগুন নিয়ন্ত্রণে নামার আগে পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে অভিযান পরিচালনা করলে ভালো হতো।'
আরেক কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, 'আগুন প্রথমে কার্গো ভিলেজের ভেতর নয়, ইমপোর্ট কার্গো এলাকায় সদ্য আসা পণ্যগুলোতে লাগে। পরে তা কার্গো ভিলেজে ছড়িয়ে পড়ে। এই এলাকায় সব আমদানিকৃত পণ্য থাকে, তবে রপ্তানি কার্গো এলাকায় এখন পর্যন্ত আগুন ছড়ায়নি।'
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক নাসির উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, 'আমরা এখন বোঝার চেষ্টা করছি কী পরিমাণ কার্গোর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এখন পর্যন্ত যতটুকু জানা গেছে, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন কুরিয়ার সার্ভিসের পণ্য যেখানে রাখা হয়, সেই স্থানটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া সেখানে কেমিক্যালেরও কয়েকটি গুদাম রয়েছে, সেগুলোতেও আগুন লাগার খবর পাওয়া গেছে।'
কার্গো ভিলেজ ও আশপাশের এলাকায় আসলে কী থাকে?
হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজটি মূলত দুটি অংশে বিভক্ত: একপাশে ইমপোর্ট কার্গো জোন এবং অপর পাশে এক্সপোর্ট কার্গো জোন। ইমপোর্ট কার্গো জোনের ভবনের আশপাশে সাধারণত সদ্য আগত পণ্যগুলো রাখা হয়। আর পুরো কার্গো ভিলেজেই আমদানিকৃত পণ্য খালাস এবং রপ্তানির জন্য প্রস্তুত পণ্য জাহাজীকরণের অপেক্ষায় থাকে।
শুল্কায়ন প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর আমদানিকারক বা তাদের প্রতিনিধিরা সেখান থেকে পণ্য বুঝে নেন। শুল্কায়ন সম্পন্ন হতে কত সময় লাগবে, তার ওপর নির্ভর করে কোনো পণ্য কার্গো ভিলেজ বা কমপ্লেক্সে কত দিন থাকবে।
বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ আসলে একটি আধুনিক কেন্দ্র, যেখানে বিমানযোগে আমদানি ও রপ্তানিকৃত সব ধরনের পণ্যের পরিচালনা, সংরক্ষণ, পরীক্ষা, প্যাকেজিং এবং কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স; সব কাজ এক জায়গায় সম্পন্ন হয়। এটি মূলত বিমানবন্দরের পাশে অবস্থিত একটি 'একীভূত কার্গো হাব' বা লজিস্টিক সেন্টার।
কার্গো ভিলেজের ভেতরে পণ্যগুলো নির্দিষ্ট কয়েকটি ভাগে সংরক্ষিত থাকে। এর মধ্যে রয়েছে ইমপোর্ট ও এক্সপোর্ট গুদামঘর, কার্গো হ্যান্ডলিং টার্মিনাল, কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স জোন, বিশেষায়িত স্টোরেজ ইউনিট, ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার ও কুরিয়ার কোম্পানির অফিস (যেমন: ডিএইচএল, ফেডএক্স ইত্যাদি), নিরাপত্তা ও পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা, এবং লজিস্টিকস ও পরিবহন জোন।
যদি কার্গো ভিলেজে পচনশীল পণ্য যেমন: ফলমূল, শাকসবজি ইত্যাদি থাকে, তাহলে সেগুলো ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই বিমানবন্দর থেকে জাহাজীকরণ বা খালাস করা হয়। এসব পণ্য বিশেষভাবে নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রার পৃথক স্থানে রাখা হয়। অপরদিকে, অনেক তৈরি পোশাক মালিক বিদেশি ক্রেতাদের কাছে নির্ধারিত সময়ের (লিড টাইমের) মধ্যে পণ্য পৌঁছাতে দ্রুত বিমানযোগে চালান পাঠান। এসব ক্ষেত্রে সাধারণত ২–৩ দিনের মধ্যেই পণ্য কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছে যায়।

তবে কখনো কার্গো বিমানে জায়গা সংকট দেখা দিলে রপ্তানিমুখী পণ্যের চালান কয়েক দিন পর্যন্ত কার্গো ভিলেজ বা কমপ্লেক্সে অপেক্ষমাণ থাকে। সে সময় রপ্তানিকারকেরা নির্দিষ্ট ভাড়া পরিশোধ করে পণ্য সেখানে সংরক্ষণ করেন। একইভাবে, আমদানিকারকেরাও শুল্কায়ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে কয়েক দিন সময় নিতে পারেন, ফলে তাদের পণ্য আমদানি কার্গো ভিলেজেই কিছুদিন থাকে। অর্থাৎ, আমদানি ও রপ্তানি; দুই ক্ষেত্রেরই যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয় বিমানবন্দরের এই কার্গো ভিলেজ থেকেই।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ আগুনে শত শত টন আমদানিকৃত পণ্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে পারেন আমদানিকারকেরা। বিমা দাবি করে ক্ষতিপূরণ আদায় করাও হবে সময়সাপেক্ষ।
এক আমদানিকারক বলেন, 'আমার পাঁচটি শিপমেন্ট ছিল, যার একটি কার্গো ভিলেজে ছিল। কিন্তু বাকি চালানগুলোর আপডেট এখনো জানা নেই। আমার পণ্যগুলো পুড়ে গেলে আমি পুরোপুরি শেষ হয়ে যাব।'