২০ বছর ধরে কালু মিয়ার কালাভুনায় মজে আছে সিনেপাড়া

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন (এফডিসি) থেকে একটু বাম দিকে হাঁটলেই চোখে পড়ে এক বড় কাঁচাবাজার। আর এ বাজারের ওপরের তলায় অস্থায়ীভাবে আছে ছোট ছোট কিছু রুম। নড়বড়ে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতেই দেখা মিলবে একটি হোটেলের। সামনে কোনো নামফলক নেই, তবুও সবার কাছে এটি পরিচিত 'কালু মিয়ার হোটেল' নামে।
প্রায় ২০ বছর আগে বড় ভাইয়ের সাথে খাবারের ব্যবসায় নামেন কালু মিয়া। এফডিসিতে নাটক, সিনেমা বা বিজ্ঞাপনের শুটিং চলাকালে খাবার সরবরাহ করাই তাদের মূল কাজ। কোন নায়ক-নায়িকা বা পরিচালক কী খাবার খেতে পছন্দ করেন, এর সবই নখদর্পণে আছে তার।
মাত্র ছয় বছর বয়সে বিভিন্ন হোটেল থেকে এফডিসিতে খাবার পৌঁছে দেওয়ার কাজ শুরু করেন কালু মিয়া। তারপর কেটে গেছে দীর্ঘসময়, এখন তিনি ক্যাটারিং ব্যবসায়ী। এফডিসি ও আশপাশের প্রায় সব অফিস-আদালতের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়মিত খাবার সরবরাহ করে তার হোটেল। আবার চাইলে দুপুর একটা থেকে তিনটার মধ্যে এখানে দুপুরের খাবারও সেরে নিতে পারবেন।

জায়গা অস্থায়ী হলেও মানুষের মনে স্থায়ী
২০০৫ সালে বড় ভাইয়ের হাত ধরে এফডিসিতে আসেন কালু মিয়া। তখন বাংলা সিনেমার সোনালি যুগ আর না থাকলেও, সরগরম থাকত এফডিসির সিনেপাড়া। নিয়মিত হতো নাটক, সিনেমা আর বিজ্ঞাপনের শুটিং। আর শুটিং মানেই শিল্পী-কলাকুশলীদের জন্য দিনে কমপক্ষে পাঁচবেলার খাবার।
আর এ খাবার এফডিসির ভেতরের ক্যান্টিন থেকে না খেয়ে, বাইরের বিভিন্ন ক্যাটারিং সার্ভিস থেকে নেয়াটাই বেশি পছন্দ করেন সবাই। কারণ চাহিদামতো অর্ডার দিয়ে রাখলেই সে অনুযায়ী খাবার পাওয়া যায়। কালু মিয়া বলেন, 'দেশের এমন কোনো খানা নাই যা আমরা রান্না করে দিতে পারি না। যেই মাছ বা মাংস যেভাবে রান্না করার অর্ডার আসে, সেভাবেই রান্না করে দেই। পাশেই কারওয়ান বাজার, এইখানে দুনিয়ার সবই পাওয়া যায়।'
কালু মিয়া আর তার ভাই স্বপন মিয়া মিলে ক্যাটারিং-এর নাম দিয়েছিলেন 'ভাই ভাই ক্যাটারিং সার্ভিস।' হোটেলের রশিদে এখনও 'ভাই ভাই ক্যাটারিং' লেখা থাকলেও, সবাই চিনেন কালু মিয়ার হোটেল নামেই।
তবে দুঃখের বিষয় এখনও স্থায়ীভাবে কোনো জায়গায় হোটেল চালু করতে পারেননি তারা। শুরু করার পর থেকে গত ২০ বছরে প্রায় ছয় থেকে সাতবার স্থান পরিবর্তন করতে হয়েছে তাদের। কখনও এফডিসির গেটের বিপরীতে, কখনও কারওয়ান বাজার রেলগেটের পাশে কিংবা হাতিরঝিল মোড়ের কাছে—এভাবেই বিভিন্ন জায়গায় অস্থায়ীভাবে চালিয়ে গেছেন খাবারের ব্যবসা।

তবে বারবার স্থান পরিবর্তন করলেও, খাবারের কদর কমেনি একটুও। প্রতিদিন গড়ে দেড়শ থেকে দু'শো মানুষের খাবার পাঠানো লাগে বিভিন্ন স্থানে। আর হোটেলেও বসে খেতে পারেন প্রায় ১০০ জন।
জোছনা বেগমের ভাঙা চাঁদ
কালু মিয়ার হোটেলের পাশের ঘরেই দেখা গেল আরেকটি ছোট্ট হোটেল। সেটি পরিচালনা করছেন একজন মাঝবয়সী নারী। কালু মিয়ার হোটেলের মতো এখানেও কোনো নামফলক নেই। জানা গেল, এর নাম 'হালিম হোটেল'। এখন হোটেলের দেখভাল করেন হালিম মিয়ার স্ত্রী জোছনা বেগম।
কালু মিয়ার বহু আগে থেকে এই ব্যবসায় আছেন হালিম মিয়া। প্রায় ৩৫ বছর আগে এফডিসি এলাকায় শুরু করেছিলেন নিজের হোটেল। একসময় নিজেই রান্না করতেন, অতিথিদের আপ্যায়নে ব্যস্ত থাকতেন।
তবে এখন সেই আগের জৌলুস আর নেই। কয়েক বছর ধরে পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী তিনি। এখন আর হোটেলে আসতে পারেন না। স্বামীর অনুপস্থিতিতে হালিম হোটেলের সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন জোছনা বেগম। স্বল্প আয়ের মধ্যেই চলছে স্বামীর চিকিৎসা ও সন্তানদের পড়াশোনা।
এই সুযোগে প্রতিযোগিতায় অনেক এগিয়ে গেছেন কালু মিয়া। তারপরও কিছু নির্দিষ্ট ক্রেতা এখনো দুপুরবেলা এসে খেয়ে যান হালিম হোটেলে। ক্যাটারিং অর্ডারও আসে, যদিও খুব বেশি মানুষের খাবার পরিবেশন করার সক্ষমতা নেই তাদের। সাধ্যের মধ্যে যতটা সম্ভব, অর্ডার মতো রান্না করে দেন জোছনা বেগম।
জোছনা বেগম বলেন, 'উনি [হালিম মিয়া] থাকতে আমাদের এত কষ্ট করা লাগে নাই। এখন খরচ উঠাইতেই অনেক পেরেশানি হয়। বাবুর্চি আর কর্মচারীর বেতন দিয়ে লাভ থাকে খুব কম। কালুর হোটেলেই সবাই আসে। আমাদের কাছে কেউ আসতে চায় না আর। আল্লাহ উনারে সুস্থ করে দিলে আবার আগের মতো ভালো দিন আসবে আমাদের।'
যা যা পাওয়া যায়
কালু মিয়ার হোটেল সবচেয়ে বিখ্যাত গরুর কালাভুনার জন্য। প্রতিদিনই কালাভুনার জন্য থাকে বিশেষ চাহিদা। ২৫ থেকে ৩০ কেজি গরুর মাংস রান্না করতে হয় প্রতিদিন। সব খাবারই মাটির চুলায় রান্না করা হয় এখানে।
চট্টগ্রামের কালাভুনা আর কালু মিয়ার কালাভুনা এক না। চট্টগ্রামের রান্নায় বিভিন্ন মসলা ব্যবহার করা হয়। কিন্তু কালু মিয়ার হোটেলে দীর্ঘ সময় ধরে উচ্চতাপে মাংস ভুনা করতে করতে তা কালো হয়ে যায়।

প্রতিদিনের নির্দিষ্ট কোনো মেন্যু নেই এখানে। নানা পদের ভর্তা, ভাজি, পাঁচমিশালি সবজি, মুরগি, শুঁটকি, রুই মাছ, কাতল মাছ, ছোট মাছ—এগুলো প্রায় প্রতিদিনই থাকে। এখানে খাবারের দামও হাতের নাগালে। ১০০ থেকে ১৫০ টাকার মাঝে ভরপেট খাওয়া যায়। গরুর কালাভুনা এক প্লেট ২০০ টাকা। আবার আছে বিভিন্ন প্যাকেজ। ভাত, ডাল, তিন পদের ভর্তা-ভাজির সাথে কালাভুনা, মুরগি বা মাছ নেয়া যায় প্যাকেজ হিসেবে। ২০০ থেকে ২৫০ টাকা খরচ হয় প্যাকেজ নিলে।
ক্যাটারিং সেবা নিলে মেন্যুর কোনো বালাই নেই। যা অর্ডার দেয়া হয়, তাই রান্না করে দেন তারা। খিচুড়ি, পোলাও, বিরিয়ানি—এমনকি পান্তা ভাতের অর্ডারও আসে তাদের কাছে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে। শুধু আগের দিন জানিয়ে দিতে হয় ফোন দিয়ে। কয়েকদিন আগে জানালে আরও ভালো!
তারকারা কী খেতে পছন্দ করেন?
টিভি বা সিনেমার পর্দার মানুষেরা কী খায়? অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেলা যাদের বায়ে হাতের কাজ! তারাও কী আমাদের মতো সাধারণ বাঙালিয়ানা খাবার খান? নাকি কোনো বিশেষ খাবার খেয়ে নিজেদের রূপ-গুণ ধরে রাখেন তারা?
এমন প্রশ্নে হেসে উঠলেন কালু মিয়া। কোন নায়ক-নায়িকা কী খেতে পছন্দ করেন, সবই তার জানা আছে। তিনি বলেন, 'তারা আমাদের মতোই সাধারণ খানা খাইতে পছন্দ করেন। বিশেষ কিছুই খান না তারা। আমরা তো তাও ভাজা-পোড়া, হেভি খানা খাই মাঝে মাঝে। তারা তাও খায় না। খুব সহজ খাবার তাদের। নায়িকারা আরও কম খায়, মোটা হয়ে যাবে এই ভয়ে!'

নায়ক শাকিব খানের প্রিয় খাবার হলুদ ছাড়া দেশি মুরগি, পাবদা মাছ আর চিংড়ি। ফেরদৌস, রিয়াজ, সাইমন কালু মিয়ার কালাভুনার ভক্ত। বাপ্পি চৌধুরী পছন্দ করেন সবজি। আরেফিন শুভর প্রিয় খাবার ডাল, আলুভাজি আর মাছ।
নায়িকা শাবনুর হাঁসের মাংস খুব পছন্দ করতেন। আর মৌসুমী খেতেন মাছ, দেশী মুরগি আর কালা ভুনা। পূর্ণিমাও কালু মিয়ার কালাভুনার ভক্ত ছিলেন। মাহিয়া মাহি বেশি ঝাল খেতে পছন্দ করেন। মাহির জন্য খাবার গেলে অতিরিক্ত মরিচ দিয়ে রান্না করতে হয়।
হাঁড়ি-পাতিল নিয়ে জেলায় জেলায়
কালু মিয়ার ক্যাটারিং সার্ভিস শুধু আশেপাশের অফিস আর এফডিসির ভেতরে খাবার দেয়া পর্যন্ত না। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নাটক, সিনেমা আর বিজ্ঞাপনের শুটিং হয়। কয়েকদিন থেকে কয়েক মাস পর্যন্ত শুটিং চলে। আর এসব শুটিং দলের খাবারের জন্য ক্যাটারিং সার্ভিস নিয়ে যাওয়া হয় সাথে করে। কালু মিয়া এই সেবাও দিয়ে থাকেন।
শুটিং দলের সঙ্গে আলাদা একটি ছোট মিনি ট্রাকে করে রওনা দিয়ে দেন তারা। সঙ্গে যান একজন হেড বাবুর্চি, কয়েকজন সহকারী বাবুর্চি ও একদল যোগালি [বাবুর্চির সহায়তাকারী] দেয়া হয়। আর সাথে থাকে বড় বড় হাঁড়ি পাতিল, বাজার-সদাই আর জ্বালানি।
সকালের নাস্তা, দুপুরের আগের নাস্তা, দুপুরের খাবার, বিকালের নাস্তা আর রাতের খাবার—মোট পাঁচ বেলার খাবার তৈরি করে দেয়া হয় ক্যাটারিং-এর পক্ষ থেকে। আর সবসময় থাকে গরম চা। নায়ক-নায়িকা বা পরিচালক-প্রযোজকদের জন্য মাঝে মাঝে তৈরি করতে হয় স্পেশাল খাবার। আর অন্যান্যদের জন্য থাকে সাধারণ খাবার।

সকালে দেয়া হয় খিচুড়ি-ডিম, তারপর সিঙ্গাড়া-সমুচা। দুপুরের খাবারে চাহিদা মতো যেকোনো কিছু রান্না করে দেয়া হয়—ভাত বা পোলাও, সাথে দুই-তিন পদ। বিকেলে দেয়া হয় পুরি, মোগলাই, ঝালমুড়ি বা নুডলস। আর রাতে থাকে সাধারণত হালকা খাবার।
ঢাকার বাইরে ক্যাটারিং সেবা নিলে খরচ কেমন পড়ে? জানতে চাইলে কালু মিয়া বলেন, নির্দিষ্ট করে তা বলা সম্ভব না। পরিবহণ খরচ, বাবুর্চিদের মজুরি আর কোন বেলা কী কী খাবার খাওয়া হয়, তার ওপর নির্ভর করে সবকিছু।
শুটিং ছাড়াও, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পিকনিকের জন্যও অনেক দূরদূরান্তে যাওয়া পড়ে তাদের। বিয়ে বা গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানেও তারা কাজ করেন, তবে কম। কালু মিয়া বলেন, 'আমরা শুটিং-এর কাজেই বেশি বাইরে যাই। কয়েকদিন আগেও শাকিব খানের নতুন সিনেমার জন্য উত্তরবঙ্গে যাওয়া পড়ছিল। ওইখানে কয়েক সপ্তাহ থেকে কাজ করে আসছিল আমার লোকেরা। বড় বড় ব্যাংক আর ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির পিকনিকে নিয়মিতই ঢাকার বাইরে যাওয়া লাগে। তারা পয়সাওয়ালা লোক। তিন বেলাই ভালো খাইতে চায়। আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করি।'
ছবি: ফাইয়াজ আহনাফ সামিন/টিবিএস