নুসরাত, সুমাইয়ারা ছিল কোচিং ক্লাস শুরুর অপেক্ষায়...
নুসরাত এখন আর কারো ডাকে সাড়া দেবে না। বইয়ের ব্যাগ কাঁধে ক্লাসে যাবে না, জানালায় বসে পাখির ছবিও আঁকবে না। দশ বছর বয়স ছোঁয়ার আগেই এক দুর্ঘটনায় থেমে গেল তার জীবনের সব স্বপ্ন।
২১ জুলাই দিয়াবাড়ির মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যখন একটি যুদ্ধবিমান ভেঙে পড়ে, তখনই শেষ হয়ে যায় তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী নুসরাত জাহান আনিকার পৃথিবী। সেদিন দুপুরে স্কুলের কোচিং শুরুর আগেই মা এসে তার হাতে তুলে দিয়েছিলেন তার প্রিয় খাবার—ফ্রাইড রাইস। মিনিট কয়েকের ব্যবধানে আকাশ ফুঁড়ে নামল একটি যুদ্ধবিমান, চারপাশ ভরে গেল আগুন আর ধোঁয়ায়। নিঃশ্বাস নিতে না পেরে চিরতরে থেমে গেল ছোট্ট এক প্রাণ।
দুপুর একটার একটু বেশি। নূরুজ্জামান মিয়া বসেছিলেন চায়ের দোকানে। হঠাৎই বিকট শব্দে তার কানে তালা লেগে যায়। তারপরই দেখতে পান ধোঁয়ার কুন্ডলী। মাঝখানের গোল চত্বরটা কীভাবে পার হয়েছেন, মনে নেই—দৌড়ে ঢুকে পড়েছিলেন মাইলস্টোনের ভেতরে। গিয়ে দেখেন যুদ্ধবিমানটির নাক কেজি ভবনের সিঁড়ির বরাবর ঢুকে গেছে। ভেতরে দাউদাউ করে জ্বলছে আগুন, ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুত। নরম পোড়া হাত মেলে গ্রিলের বাইরে আসতে চাইছে বাচ্চাগুলো, কেউবা ততক্ষণে দমবন্ধ হয়ে ঢলে পড়েছে।
নুসরাতও মারা গেছে ধোঁয়ায় দমবন্ধ হয়ে। সিএমএইচে তার মরদেহ খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল বিকালের আগেই। তার ছবি, নাম, কোড নম্বর দিয়ে ফেসবুকে নিখোঁজ পোস্ট দিয়েছিলেন শাকিল আহমেদ। শাকিলের ছোট শ্যালিকা নুসরাত।
শাকিলের ছেলে জারিফ ছিল নুসরাতের প্রিয় খেলার সাথী। শাকিলের কাছেই ছিল তার যত আবদার। আপন ভাই না থাকায় শাকিলই ছিল তার বড় ভাই। ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার কারণে শাকিল গতকাল শতাধিক ফোন পেয়েছেন দেশ ও দেশের বাইরে থেকে। অধিকাংশই অচেনা। সবাই জানতে চেয়েছে, নুসরাতকে পাওয়া গেছে কিনা। শাকিল বলেছে, হ্যাঁ, পাওয়া গেছে। অনেকেই প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন। পরেরটুকু জানিয়ে শাকিল আর তাদের মর্মাহত করতে চাননি।
মাইলস্টোনের কোচিং বাণিজ্য নিয়ে শাকিল যারপরনাই ক্ষুব্ধ। তিনি জানান, এখানে কোচিং করতে ছাত্রছাত্রীদের বাধ্য করা হয়। যে কোচিং করে না, তাকে কম নম্বর দেওয়া হয়। এজন্য শেষে না পেরে নুসরাতকে গত মাসে কোচিংয়ে ভর্তি করানো হয়েছিল। কোচিং না করলে হয়ত আজও বেঁচে থাকত নুসরাত, কারণ ততক্ষণে স্কুল ছুটি।
স্কুল ছুটির পর যারা কোচিং করত, তাদের জন্য ছিল লাঞ্চব্রেক। সেই বিরতিতে নুসরাতের মা ফ্রাইড রাইস হাতে নিয়ে গিয়ে মেয়ের কাছে পৌঁছে দেন—স্নেহভরা হাতে খাবার তুলে দেন ছোট্ট মেয়ের হাতে। এরপর মাত্র ১০০ গজও এগোতে পারেননি, তখনই ঘটে সেই বিভীষিকাময় দুর্ঘটনা। নুসরাতের মা পাগলের মতো ছুটে ফিরে যান, কিন্তু ততক্ষণে কিছুই করার আর সুযোগ ছিল না।

নুসরাতদের বাসা স্কুল থেকে হাঁটা দূরত্বে। সে টিয়া পাখি আঁকতে ভালোবাসত, বার্গার খেতে ভালোবাসত। ছিল একটা সাইকেলও। নিজের ঘরে দুই বছর বয়সের একটি ছবি বড় করে টাঙানো। তার বইগুলো বুকে চেপে মা নিথর হয়ে বসে আছেন।
গেল ১০ জুন তার পুরো পরিবার কক্সবাজার বেড়াতে গিয়েছিল। খুব আনন্দ পেয়েছিল নুসরাত, পানি থেকে উঠতেই চায়নি। দিনকয়েক আগে আবার শাকিলকে বলেছিল, 'ভাইয়া, আরেকবার কক্সবাজার নিয়ে চলো না!'
নুসরাত ছিল মিষ্টি আর চঞ্চল। লুকোচুরি ছিল তার সবচেয়ে প্রিয় খেলা। পাশের ভবনে থাকত স্কুলের বড় ভাই তানভীর। মাঝেমধ্যেই সেখানে ছুটে যেত সে। তানভীর টেবিলে বসে পড়া শুরু করলেই পিঠে দুমদুম কিল মেরে হেসে পালাত নুসরাত।
এইসব স্মৃতির ভেতর হারিয়ে গিয়ে হঠাৎ কেঁদে ফেলল তানভীর। নুসরাতদের বাসার পরিবেশ এতটাই ভারী হয়ে উঠেছিল, যেন নিঃশ্বাস নেওয়াটাও কষ্টকর।
মাইলস্টোনের দিকে কিছুটা এগোতেই দেখা হলো সুমাইয়া অন্বেষার মা ও বাবার সঙ্গে। তারা থাকেন টঙ্গীতে।
সুমাইয়া অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী, প্রতিদিন যাওয়া-আসা করে স্কুলের গাড়িতে। দুর্ঘটনার খবর পাওয়া মাত্র সুমাইয়ার মা অস্থির হয়ে যান, স্বামীকে ফোনে ঘটনাটা জানান। সুমাইয়ার বাবা পাগলের মতো ছুটে আসেন মেয়ের খোঁজে। এদিক-ওদিক ছুটোছুটি করে শেষ পর্যন্ত মেয়েকে খুঁজে পান—দেখেন আতঙ্কে কাঁপছে সে। অল্পের জন্য বেঁচে গেছে সুমাইয়া।
সেদিন একটায় ছুটি হয়ে যাওয়ার পর তৃষ্ণা মেটাতে গেটের বাইরে এসে একটা পানীয় কিনতে যায়—আর ঠিক তখনই ঘটে দুর্ঘটনা। আর তাতেই জীবন বেঁচে যায় তার।
সুমাইয়ার বাবা ওয়ালিউর রহমান বলছিলেন, 'মেয়েটা আমার খুবই মেধাবী। সব সময় ভালো রেজাল্ট করে। মাইলস্টোনে ভর্তি করিয়েছিলাম, কারণ এখানে খেলার মাঠ আছে। তবে এরা চাপে রাখে অত্যধিক। কোচিংয়ের জন্য জোরাজুরিও করে। এখন আর মেয়েকে এ স্কুলে রাখব না।'
সুমাইয়া সেদিন রাতে আর ঘুমোতে পারেনি। বাচ্চাগুলোর চেহারা তার চোখে ভেসে উঠছিল বারবার। কেঁপে কেঁপে জেগে উঠেছে, আর বলেছে, 'ওরা আমার ভাইবোনের মতো ছিল। দেখা হলেই বলত, আপু কেমন আছো।' সুমাইয়া কবে এ শোক কাটিয়ে উঠবে বলা মুশকিল। হয়ত মাইলস্টোনে আর পড়বে না। কিন্তু তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণির নিষ্পাপ, কোমলমতি বাচ্চাগুলোর কথা ভুলে যাওয়া তার জন্য সত্যিই কঠিন হবে। মেয়েকে বাসায় রেখে আজ সুমাইয়ার বাবা-মা এসেছেন যারা এখনও সন্তানের খোঁজ পাননি তাদের প্রতি সহমর্মিতা জানাতে।


আরও কিছুক্ষণ পরে দেখা হলো তানভীর আহমেদের সঙ্গে। এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে সে। মাইলস্টোনের হোস্টেলে থাকে। ঘটনা যখন ঘটে তখন সে নিজের কক্ষে ঘুমাচ্ছিল। ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসার কথা ছিল। ঘুম ভাঙে ঠিকই, তবে বিকট এক শব্দে। ধড়ফড়িয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে দেখে ধোঁয়ার কুন্ডলী।
রুমমেটদের সঙ্গে তাড়াতাড়ি নিচে নেমে এসে দেখে যেন নরকের দরজা খুলে গেছে। প্রথমে এক শিক্ষিকাকে দোতলায় গ্রিলের এমাথা থেকে ওমাথায় ছোটাছুটি করতে দেখে, যিনি বের হওয়ার পথ খুঁজছিলেন। পরের দৃশ্য তানভীরের দেখা হয়নি, তবে তিনি নিশ্চিত যে শিক্ষিকা সেই পথ খুঁজে পাননি, কারণ সিঁড়ি ছিল মাত্র একটিই, আর বিমানটি সেখান দিয়েই ঢুকে পড়েছিল কেজি ভবনে।
তানভীর, তার অন্যান্য বন্ধুদের মতোই, দাবি জানাচ্ছে শিগগিরই নিহতের প্রকৃত সংখ্যা প্রকাশ করা হোক।
সন্তানের খোঁজে এখনও অনেক বাবা-মা ঢাকা মেডিকেল কলেজ, বার্ন ইনস্টিটিউট, সিএমএইচ, শহীদ মনসুর আলী হাসপাতাল, উত্তরা আধুনিক হাসপাতালে ঘুরছেন।
মেডিকেল কলেজের ভেতরে ঢুকে শত সহস্র বিক্ষুব্ধ ছাত্র-ছাত্রীকে দেখতে পেলাম। মাইলস্টোনের উত্তরা ও মোহাম্মদপুর শাখা থেকেও এসেছে অনেকে। যোগ দিয়েছে ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি ও বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজির ছাত্র-ছাত্রীরাও।
শোকের স্থান দখল করেছে ক্ষোভ ও হতাশা। কোনো এক শক্তি যেন সত্য ঢাকতে চাইছে। ছাত্র-ছাত্রীরা তাই জানতে চাইছে—কার স্বার্থে সত্য গোপন করছে কর্তৃপক্ষ? তাদের ধারণা, কম করেও একশ শিক্ষার্থী দুর্ঘটনায় মারা গেছে, অথচ কর্তৃপক্ষ সংখ্যাটি আটকে রাখতে চাইছে ত্রিশের মধ্যে।
শিক্ষার্থীদের যুক্তি—কেজি ভবনের (প্রাইমারি সেকশন) চারটি ক্লাসে ৫০ জন করে হলেও ২০০ শিক্ষার্থী ছিল। হাজিরা খাতা দেখলেই তার প্রমাণ মিলবে।
স্কুল মাঠের ভেতরে দুইজন রোভার স্কাউট ছাত্রের সঙ্গে দেখা হলো। তারা উদ্ধারকারী হিসেবেও কাজ করেছে। তাদের একজন, মোহাম্মদ খালেদ মাহমুদ তার মর্মস্পর্শী অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, 'অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে যাওয়ার সময় কারো কারো চামড়া খসে পড়তেও দেখেছি। অনেককে স্পর্শ করা যাচ্ছিল না। যাদের ৬০ বা ৭০ ভাগ পুড়ে গিয়েছিল, তাদের দিকে তাকানো যাচ্ছিল না। এমনও হয়েছে, এক গাড়িতে আমরা ৭-৮ জনকে তুলে দিয়েছি, যাদের মুখ বিকৃত হয়ে গেছে বা চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে।'


তবে তিনি সেনাবাহিনী ও দমকলকর্মীদের তৎপরতার প্রশংসা করেছেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তারা ঘটনাস্থলে এসে কাজ শুরু করেন। তাদের কেউ কেউ মারাত্মকভাবে আহতও হয়েছেন।
২২ জুলাই মাইলস্টোনের ভেতরে দেখা গেল অনেক তৎপরতা। কয়েকজনকে দেখা গেল প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। একটিতে লেখা ছিল—'শরীরের মৃত্যু ঘটে, সুন্দরের নয়।'
স্বীকার করতেই হয়, মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ক্যাম্পাসটি সুন্দর। বড় একটি সবুজ মাঠ আছে। ভবনগুলোও সুন্দর। কিন্তু ২১ জুলাই এটি এক মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। সারাদেশ শোকে বিহ্বল।
তবু এমন কঠিন সময়েও প্রশ্নগুলো থেকেই যাচ্ছে—কবে থামবে এই কোচিং বাণিজ্য? কেন জনবহুল এলাকায় উড়ানো হয় প্রশিক্ষণ বিমান? কেন এমন স্থানে স্কুল গড়ে উঠলো, যার ছাদ ছুঁয়ে প্লেন ওঠানামা করে? প্রভাবশালীরা আর কতদিন কত জীবনকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেবেন? এসব প্রশ্নের উত্তর কে দেবে? যদি মেলে, তবে হয়ত আগামীর অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব হবে।