ঝড়ের সঙ্গে লড়াই করে চট্টগ্রামের উপকূলীয় পাবলিক লাইব্রেরির ১৬ বছরের পথচলা
শীতের কোমল রোদ ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। দুপুরটা এমন এক শান্তিতে মোড়া যে মনে হয় লবণ মাঠের ওপাশের প্রতিটি দৃশ্য যেন ধীর শ্বাস নিচ্ছে। মাঠের শ্রমিকরা নতুন মৌসুমের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত—বালু সমতল করছে, বাঁশ ঠুকছে, কোথাও আবার বালির স্তূপে লবণ শুকোনোর জায়গা তৈরি হচ্ছে।
আর সেই মাঠ পেরিয়ে আঁকাবাঁকা মেঠোপথ ধরে ছুটে আসছে একদল কিশোরী—হাতে বই, চোখে কৌতূহল, মুখে স্বপ্নের দীপ্তি। তাদের পথের শেষ ঠিকানা ছনুয়া ইউনিয়নের এক ছোট্ট পাঠাগার, উপকূলীয় পাবলিক লাইব্রেরি। যে লাইব্রেরির দরজায় পৌঁছাতে প্রতিদিন ৩–৪ কিলোমিটার হাঁটে এই মেয়েরা। কারণ এই একটাই জায়গা তাদের শেখার আলো জ্বেলে রাখে।
এটা শুধু একটি পাঠাগার নয়। উপকূলের নারীদের জন্য এটি আলোর একটি স্থায়ী উৎস—শেখার জায়গা, নিরাপদ পরিবেশ, আর মানসিক শক্তির উৎস।
জলবায়ুর অভিঘাতে প্রতিনিয়ত লড়াই করা উপকূলের নারীদের জন্য এই লাইব্রেরি যেন আশ্রয়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে ১৬ বছর ধরে।
ঝড়-বৃষ্টির মাঝেও টিকে থাকা এক বাতিঘর
চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার দূরে বলি বাজার এলাকার একটি সাইক্লোন সেন্টারের ছোট ঘরে ২০১০ সালে লাইব্রেরির যাত্রা শুরু। শুরুটা ছিল অতি সাধারণ—সাহিত্য বা জ্ঞানচর্চার বিশেষ কোনো কেন্দ্র নয়, বরং একটি সাইক্লোন সেন্টারের ফাঁকা ঘর থেকে পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হওয়া উদ্যোগ। পরে ২০১৭ সালে ২৮ শতাংশ নিজস্ব জমিতে যখন নতুন ভবন তৈরি হয়, তখন এই স্বপ্নের যাত্রা যেন নতুন গতি পায়।
লবণচাষ-নির্ভর এই অঞ্চল বর্ষায় পানিবদ্ধ হয়ে যায় প্রায় পুরো মৌসুমজুড়ে। লোনা বাতাস আর ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতার কারণে অধিকাংশ সামাজিক উদ্যোগ বছর শেষ হওয়ার আগেই ভেঙে পড়ে। সেই বাস্তবতায় একটি পূর্ণাঙ্গ লাইব্রেরি টিকিয়ে রাখা ছিল এক দুঃসাহসী উদ্যোগ। কিন্তু সাংবাদিক সাঈফী আনোয়ারুল আজিম সেই সাহসের দৃষ্টান্তই স্থাপন করেছেন—১৬ বছর ধরে একটানা পথচলায়।
নারীদের জন্য নিরাপদ শিক্ষাস্থান
প্রথম দিকে নানা বাধা ছিল। নারীদের মুক্তভাবে পড়াশোনা করা বা নিয়মিত লাইব্রেরিতে আসা অনেকের চোখে 'সামাজিক বিপদ' হিসেবে দেখা হত। কেউ বলত মেয়েরা 'অতিরিক্ত স্বাধীন' হয়ে যাবে, কেউ বলত বেশি বই পড়লে পরিবারে কথা শুনবে না। স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী মানুষ প্রকাশ্যেই আপত্তি জানিয়েছিলেন। তবুও থেমে থাকেননি সাঈফী আজিম বা লাইব্রেরির প্রথম দিককার পাঠকরা।
এখন চিত্র পুরোপুরি বদলে গেছে। যে মেয়েরা আগে ঘর থেকে বের হত না, তারা এখন নিয়মিত পাঠক। অনেকে পড়াশোনায় ভালো ফল করছে, কেউ কেউ চাকরির স্বপ্ন দেখছে, আবার কেউ কেউ পরিবারে নিজের মতামত স্পষ্টভাবে প্রকাশ করতে শিখেছে।
লাইব্রেরি তিনজন নারীর কর্মসংস্থানের সুযোগও তৈরি করেছে। তারা একসময় নিয়মিত পাঠক ছিলেন, এখন লাইব্রেরিই তাদের আর্থিক ভরসা।
তাদেরই একজন নাজমা আক্তার, যিনি লাইব্রেরির তিনজন লাইব্রেরিয়ানের একজন। একসময় তিনি নিজেই নিয়মিত পাঠক ছিলেন, আর এখন তিনি বই এবং লাইব্রেরির দৈনন্দিন কার্যক্রম দেখাশোনা করেন।
নাজমা আক্তার বলেন, 'আমি এখানে নিয়মিত পাঠক ছিলাম। এখন আমি লাইব্রেরিয়ান হিসেবে কাজ করি। এখানে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরাই বেশি আসে। আমাদের এখন প্রায় ১০ হাজার বই আছে এবং এই কাজটি আমার নিজের জীবনেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।'
ঘূর্ণিঝড়ের স্মৃতি ধরে রাখার সংগ্রহশালা
১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়—যা চট্টগ্রাম উপকূলের মানুষের জীবনে অবর্ণনীয় দুঃসহ স্মৃতি তৈরি করেছিল—সেই তারিখেই লাইব্রেরির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়।
উদ্দেশ্য ছিল পরিষ্কার- মানুষ যেন তাদের অতীত ভুলে না যায়, বিশেষত যে ইতিহাস জানলে ভবিষ্যতের জন্য সচেতন হওয়া যায়।
লাইব্রেরির এক কোণে সাজানো আছে পুরোনো সংবাদ প্রতিবেদন, ঘূর্ণিঝড়ের ছবি, সেই সময়ের সংগ্রহ করা স্মৃতিচিহ্ন। বইপ্রেমীরা যখন অবসরে এগুলো দেখে, উপকূলের ইতিহাস যেন নিজেরাই কথা বলতে থাকে।
এক টেবিল থেকে ৯ হাজার বইয়ের সমৃদ্ধ ভাণ্ডার
শুরুর দিনগুলোতে ছিল মাত্র এক টেবিল আর দুইটি চেয়ার। আজ সেখানে ১৪টি টেবিল, ১২০টি চেয়ার, ১৮টি বুকশেলফ এবং ৯ হাজারেরও বেশি বই রয়েছে। নিবন্ধিত পাঠক ১৫০ জনের বেশি, যাদের ৯৫ শতাংশই নারী।
প্রতিদিন বিকেল ২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত লাইব্রেরি খোলা থাকে।
লাইব্রেরিয়ান মুবারাকা বেগম বলেন, 'প্রতিদিন ৪০–৪৫ জন পাঠক আসে। অনেকেই হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত, তবুও কেউ ফিরে যায় না। এই জায়গাটি তাদের জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা বোঝা যায় তাদের আগ্রহ দেখলেই।'
গ্রামীণ শিক্ষার্থীদের জন্য বিজ্ঞান ক্লাব ও গাইড বই
গ্রামে বিজ্ঞানচর্চার সুযোগ সীমিত। তাই লাইব্রেরিতে যুক্ত হয়েছে 'উপকূলীয় বিজ্ঞান ক্লাব'।
এখানে আছে ২০০টির বেশি বিজ্ঞানবিষয়ক বই, পরীক্ষানিরীক্ষার কিছু সরঞ্জাম, একটি টেলিস্কোপ—যা গ্রামীণ শিক্ষার্থীদের কাছে অচেনা হলেও রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা তৈরি করেছে।
এ ছাড়া দরিদ্র শিক্ষার্থীদের গাইড বই কেনার সামর্থ্য না থাকায় ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত প্রতিটি ক্লাসের জন্য দুটি করে গাইড রাখা আছে। প্রয়োজন হলে আর্থিক সহায়তাও দেওয়া হয়।
নারীরাও বাড়িতে বই নিয়ে যান। নভেম্বর মাসে ১০ জন নারী বই ধার নিয়েছেন—সংখ্যাটি হয়ত ছোট, কিন্তু বাস্তবে এটি উপকূলের সামাজিক পরিবর্তনের একটি বড় চিহ্ন।
ঝড় সামলে বারবার উঠে দাঁড়ানো
টিন আর বেড়ার দুইতলা ভবনটি বহুবার ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২০২২ সালের ঘূর্ণিঝড়ে কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায় কয়েক সপ্তাহের জন্য। ২০২৩ সালের ঘূর্ণিঝড় হামুন ভবনটির বিশাল অংশ ধ্বংস করে দেয়। অধিকাংশ বইও নষ্ট হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে। তবুও সাঈফী আজিম থামেননি। তিনি বলেন, 'শখের বসে শুরু করেছিলাম। পরে বুঝলাম, এটা মানুষের ভবিষ্যৎ বদলে দিচ্ছে। সবচেয়ে বড় বাধা দুর্যোগ। একটি স্থায়ী ভবনের স্বপ্ন দেখি—যেখানে ঝড়ে বই নষ্ট হওয়ার ভয় থাকবে না।'
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে কিছু সহায়তা এলেও তা পর্যাপ্ত নয়। তাই ভবিষ্যতে লাইব্রেরির পাশেই সবজিক্ষেতের প্রকল্প চালু করে কিছু খরচ জোগানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
নারীদের স্বাবলম্বী হওয়ার পাঠ
ছনুয়ার নারীরা বহু বছর ধরে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপদ পানি, প্রজনন স্বাস্থ্য—সব দিক থেকেই পিছিয়ে ছিল। এই লাইব্রেরি তাদের চোখে নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। মেয়েরা এখানে এসে বই পড়ে, আলোচনা করে, আত্মরক্ষার বিষয়ে জানতে পারে, জলবায়ু দুর্যোগের সময় করণীয় শেখে।
লাইব্রেরিতে কর্মরত নাজমা আক্তার বলেন, 'আগে ভাবতেই পারিনি গ্রামের মধ্যে এমন লাইব্রেরিতে কাজ করতে পারব। পরিবারকে সাহায্য করতে পারছি। বর্ষায় এলাকা পানিবদ্ধ থাকে, তখন কাজ বন্ধ থাকে—তবু যতদিন পারি এখানেই থাকতে চাই।'
বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ জামশেদুল আলম বলেন, প্রশাসন সহায়তা দিয়েছে এবং স্থায়ী কাঠামো নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হলে আরও সহায়তা দেওয়া হবে।
উপকূলীয় পাবলিক লাইব্রেরি আজ শুধু একটি লাইব্রেরি নয়। এটি উপকূলের মানুষের চোখে দৃঢ়তা, শেখার ইচ্ছা, পরিবর্তনের প্রতীক। ১৬ বছর ধরে ঘূর্ণিঝড়, লোনা বাতাস, জলাবদ্ধতা, সামাজিক বাধা—সবকিছুর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এই আলোকশিখা জ্বালিয়ে রেখেছে।
একটি স্থায়ী ভবন পেলে এই আলো আরও দূরে যাবে—আরও অনেক মেয়েকে, আরও অনেক পরিবারকে নতুন পথে হাঁটার সাহস দেবে।
