যুগের পর যুগ পেরিয়ে ঢাকার যে ৫ পুরোনো খাবার হোটেল এখনও জনপ্রিয়!

অবিচল জনপ্রিয়তা ধরে রাখা সহজ কাজ নয়। বিশেষ করে খাবারের ব্যবসায়, যেখানে প্রতিদিন বদলায় রুচি, পছন্দ আর প্রতিযোগিতা।
তবু সবকিছুর পরেও ঢাকার কিছু পুরোনো রেস্টুরেন্ট বছরের পর বছর ধরে রেখেছে তাদের স্বাদ, মান আর আস্থার জায়গা। কেউ টিন-ছাওয়া ছোট দোকান থেকে গড়ে তুলেছে একাধিক শাখা, কেউবা সাধারণ খাবার দিয়েই জয় করেছে নানা শ্রেণির মানুষের মন।
যুগ বদলেছে, শহর বদলেছে, খাবারের ধরনও বদলেছে—তবু বদলায়নি কিছু রেস্টুরেন্টের নাম। এখনও এসবের খাবার মানুষের কাছে সমান জনপ্রিয়। ঢাকার রন্ধন ইতিহাসের অংশ হয়ে উঠেছে তারা।
এসব রেস্টুরেন্টের সাফল্যের কারণ, টিকে থাকার কৌশল, মানুষের সঙ্গে গড়ে ওঠা সম্পর্ক, স্বাদ ও সেবার মান ধরে রাখার গল্প—সব মিলিয়ে আমরা খুঁজে দেখেছি সেই উত্তর: কীভাবে তারা যুগ পেরিয়ে আজও রয়েছে একই জনপ্রিয়তায়? ঢাকার অলিগলি ঘুরে জেনেছি তাদের টিকে থাকার রহস্য।
রাব্বানী হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট, মিরপুর
গোলাম রাব্বানী আশরাফী পাটকলের শ্রমিক ছিলেন। ১৯৭২ সালে চাকরি হারান। জীবিকার প্রয়োজনে বাসার সামনের ফুটপাতে শুরু করেন ফলের ব্যবসা। কিন্তু তাতে সংসার চলছিল না ঠিকমতো। স্ত্রীর রান্নার হাত ভালো ছিল—সেটাই খুলে দেয় নতুন দরজা।
ওপরে টিন, তিন দিকের বাঁশের বেড়া, দুটি টুল আর একটি টেবিল নিয়ে শুরু করেন ছোট্ট এক খাবারের হোটেল। জায়গাটি মিরপুর–১১ নম্বরের নান্নু মার্কেট সংলগ্ন চার রাস্তার মোড়ে।
শুরুতে মূলত বিহারিরাই ছিলেন কাস্টমার। তাদের পছন্দের গরুর গোশত, পরোটা, বট আর চা পরিবেশন হতো সেখানে। ভুনা গরুর গোশতের জন্য দ্রুতই পরিচিতি পায় হোটেলটি।
দিন দিন বাড়তে থাকে কাস্টমার। প্রয়োজন হয় জায়গা বড় করার। কয়েক বছর পর শুভানুধ্যায়ীদের পরামর্শে একই স্থানে আরও বড় পরিসরে হোটেলটি চালু করেন রাব্বানী। মেন্যুতে যুক্ত হয় চিকেন চাপ, শিক কাবাব, টিক্কা কাবাবের মতো আরও কিছু পদ।
রাব্বানী ছিলেন সাদাসিধে, ধীরস্থির মানুষ। দ্রুত এগোতে পছন্দ করতেন না। তাই চাহিদা থাকা সত্ত্বেও নতুন শাখা খোলায় নেন দীর্ঘ সময়। আশির দশকের শুরুতে মিরপুর–১১ নম্বর বাসস্ট্যান্ডে প্রতিষ্ঠা করেন দ্বিতীয় শাখা। সেটিও ছিল টিনের ঘরে।
তখন মিরপুর ছিল মূল ঢাকা শহর থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন। চলাচলের প্রধান রাস্তাটিও ছিল ভাঙাচোরা আর সরু। কাস্টমার ছিলেন মূলত স্থানীয়রাই। তবে হোটেলের সুনামের সঙ্গে বাড়তে থাকে ভিড়। এরশাদ আমলে মিরপুরের প্রধান সড়কটি উন্নত হওয়ার পর ঢাকার অন্যান্য স্থান থেকেও কাস্টমার আসতে শুরু করেন।

পরে ঝুটপট্টিতে খোলা হয় আরও একটি শাখা—টিনের বেড়া ঘেরা, পাকা ভিটিতে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলাতে থাকে রুচি। বাড়ে নতুন ধরনের চাহিদা। সুস্বাদু খাবারের পাশাপাশি স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশও হয়ে ওঠে সময়ের দাবি। তাই দোকান স্থানান্তর করা হয় পাকা ভবনে। বদলায় চেয়ার, টেবিল ও থালা-বাসন। আলদা করে নিয়োগ দেওয়া হয় পরিচ্ছন্নতাকর্মীও।
গোলাম রাব্বানী ছিলেন উদার। ব্যবসার পাশাপাশি সেবাকেও গুরুত্ব দিতেন তিনি। অনেক সময় লোকসান গুনেও খাবারের মান আর পরিবেশের সৌন্দর্য বজায় রেখেছেন। সব সময় নজরে রাখতেন খাবারের দাম—যাতে তা থাকে সাধারণ কাস্টমারের সাধ্যের মধ্যেই।
রাব্বানী হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার মো. সাইফুল্লাহ জানালেন, রাব্বানী সাহেব ছিলেন খুবই মা-ভক্ত। যত কাজই থাকুক, মা ডাকলেই সবকিছু ফেলে ছুটে যেতেন। অনেকেই মনে করেন, এটিও তার সফলতার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।
করোনা মহামারির সময় রাব্বানী সাহেব ইন্তেকাল করেন। তবে সন্তানদের মধ্যে তিনি রেখে গেছেন নিজের আদর্শ ও মূল্যবোধ।
আমরা জানতে চেয়েছিলাম, রাব্বানী হোটেলের উন্নতির পেছনে আর কী কী কারণ কাজ করেছে? সাইফুল্লাহ ধারাবাহিকভাবে উত্তর দিলেন—
ক. রাব্বানী সাহেব স্টাফ ধরে রাখতে পারতেন। তারা যেন ভালো খেতে পারে সে ব্যবস্থাও রাখতেন সবসময়। ব্যবসা খারাপ চললেও কোনো স্টাফের বেতন বকেয়া রাখতেন না। শুরুর দিকের পাঁচজন কর্মী এখনো আছেন হোটেলে। এমনকি কয়েকজন গ্লাস বয় এখন ম্যানেজার পদে আছেন।
খ. খাবারের গুণমানে কখনো আপস করতেন না। দুই টাকা বেশি খরচ হলেও পরিবেশন করতেন ভালো মানের খাবার। ঝলমলে ডেকোরেশনের চেয়ে খাবারের মানকে বেশি গুরুত্ব দিতেন।
গ. কর্মীরা হোটেল না ছাড়ায় দক্ষ রাঁধুনির ঘাটতি হয়নি। ফলে খাবারের স্বাদও বজায় ছিল সবসময়।
ঘ. কেউ যদি খাবার খেতে এসে জানাত, তার পকেটে যথেষ্ট টাকা নেই, তবে তাকেও না খাইয়ে ফেরত দিতেন না।
ঙ. নিজের সন্তানদেরও নিজের মতো করে বড় করেছেন। তারাই এখন বাবার আদর্শ সামনে রেখে হোটেল পরিচালনা করছেন।
এই কথোপকথন হচ্ছিল মিরপুরের ঝুটপট্টি শাখায় বসে। আয়তনে এটি ২,৪০০ বর্গফুটের। এখানে ৫ টনের ৪টি এসি চালু থাকে। খোলা থাকে ভোর থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত। কাছাকাছি আরেকটি শাখা ২৪ ঘণ্টাই খোলা থাকে।
তবে ঝুটপট্টির এই শাখাটিই সবচেয়ে জমজমাট। কারণ, এখানে রয়েছে ভালো পার্কিং সুবিধা। সাইফুল্লাহর মতে, দামি ফিটিংস বা বিলাসী সাজসজ্জা দিয়ে হোটেলের মান বিচার করা যায় না। অনেক নামীদামি চাইনিজ, থাই বা পশ্চিমা ধাঁচের হোটেল উঠে গেছে, কিন্তু 'বাংলা হোটেল' হয়েও রাব্বানী টিকে আছে ধারাবাহিকভাবে।
রাব্বানীর এখন ৫টি শাখা ও ৩টি মিষ্টির দোকান। গরুর ভুনা গোশত ও চা এখানকার সবচেয়ে জনপ্রিয় আইটেম। জানতে চাওয়া হলে সাইফুল্লাহ বলেন, গরুর গোশতে বিশেষ কিছু যোগ করা হয় না, তবে চায়ে তালমিছরি ব্যবহার করা হয়।
রাব্বানী হোটেলগুলোতে মোট ৫০টি পদের খাবার পরিবেশন করা হয়। এর মধ্যে মোরগ পোলাও, কাচ্চি বিরিয়ানি, গরুর তেহারি, মুরগির ঝাল ফ্রাই, ডাল খাসি, চিকেন গ্রিল, কিমা পুরি, ফালুদা, গরুর নেহারি, রুমালি রুটি, খিড়ি কাবাব ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

স্টার হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট
মোজাহের মিয়া এক সময় সোসাইটি হোটেলে চা খেতেন। তখন সেখানে চা খাওয়ার জন্য মানুষ লাইন ধরত। সেই বিখ্যাত চায়ের রেসিপি মীর মমতাজ উদ্দীন শিখে আনেন করাচি থেকে, ১৯৬৪ সালে।
সেবার ঢাকায় এক রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা হয়েছিল। মমতাজ উদ্দীনের মনে সেই ঘটনার গভীর ছাপ ছিল। পরের বছর ঠাটারিবাজারে সোসাইটি হোটেলের বিপরীতে তিনি চালু করেন স্টার হোটেলের প্রথম শাখা। সেখানে প্রথমদিকে গরুর গোশতের কোনো পদ রাখা হয়নি, যাতে সব ধর্মের মানুষ নির্বিঘ্নে খেতে পারেন।
এখন স্টারের ১২টি শাখা ছড়িয়ে আছে সারা ঢাকায়। সুনাম ছড়িয়েছে সর্বত্র। কেন এমন জনপ্রিয়তা পেল স্টার? জানতে গিয়েছিলাম ওয়ারির জয়কালি মন্দির এলাকায়, মমতাজ উদ্দীনের পৈতৃক নিবাসে। তার বাবা বাড়ির নিচতলায় একটি বেকারি চালাতেন। সেখান থেকেই পরিবারের খাবার ব্যবসার সূচনা।
সম্পত্তির ভাগাভাগির জেরে সোসাইটি হোটেল হাতছাড়া হলেও সেটা মমতাজ উদ্দীনের জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসে। কারণ এরপর তিনি নিজের ব্যবসায় মন দেন এবং গড়ে তোলেন আজকের স্টার।
মোজাহের মিয়া বলেন, "মমতাজ উদ্দীন ছিলেন ভালো মানুষ। পরিশ্রমী ও সময়নিষ্ঠ। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে হোটেলে আসতেন, সব পদ নিজে খেয়ে দেখতেন। কোনো খাবার ভালো না লাগলে রান্নার স্টাফদের উন্নয়নের পরামর্শ দিতেন।"
প্রথম দিকের পদগুলোর মধ্যে স্টারের খাসির পা আর তন্দুরি রুটি বিশেষ জনপ্রিয়তা পায়।
ঠাটারিবাজারের পর জয়কালি মন্দিরের বাড়িতেই চালু করেন 'হোটেল সুপার'—যা ছিল আবাসিক ও খাবারের হোটেল, উভয়ই।
মমতাজ উদ্দীনের বিশেষ গুণ ছিল মানুষের প্রতি মমতা। হোটেলে তিনি 'স্টাফ ফুড' চালু করেন—যেখানে সব শ্রেণির মানুষ নামমাত্র মূল্যে খাবার খেতে পারত। এরপর স্টার হয়ে ওঠে কেবল মধ্যবিত্ত বা অভিজাত নয়, বরং সব মানুষের জন্যই খোলা হোটেল।
হোটেল সুপারের পেছনে 'মোজাহের ট্রেডার্স'-এ দেখা হলো মাহমুদ আলীর সঙ্গে, যিনি স্টার মালিকদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। তিনি বলেন, "নতুন কোনো খাবার চালুর আগে এখনো কর্তৃপক্ষ নানা জনকে দিয়ে স্বাদ পরীক্ষা করায়। আমি নিজেও কয়েকবার পরীক্ষক ছিলাম।"
মাহমুদ আলী আরও বলেন, "স্টারের সাফল্যের বড় কারণ হলো পরিচ্ছন্নতা, স্বাস্থ্যসম্মত খাবার আর বিস্তৃত পরিবেশ। আগে মমতাজ উদ্দীন নিজে বাজার করে মাছ-মাংস কিনতেন। এখন নির্ভরযোগ্য সরবরাহকারী আছে, যারা প্রয়োজনমতো উপকরণ সরবরাহ করে।"
স্টারের নিজস্ব খামার আছে নারায়ণগঞ্জের মদনগঞ্জে। শত বিঘার সেই খামারে প্রায় দেড়শ গরু, বড় পুকুর আর সবজির চাষ হয়। ফলে দুধ-সবজি বাইরে থেকে আনতে হয় না।
বনানী, গুলশানের মতো অভিজাত এলাকায় যেমন স্টারের শাখা আছে, তেমনি রয়েছে কারওয়ান বাজার, পুরান ঢাকার জনজন রোড ও ধানমন্ডির ২৭ নম্বর রোডেও। সব শ্রেণির মানুষের রুচির সঙ্গে তারা তাল মিলিয়ে চলেছে বলেই এ জনপ্রিয়তা।
শোনা যায়, প্রতিদিন শুধু বিরিয়ানিই বিক্রি হয় প্রায় ১৫ হাজার প্লেট!
মাহমুদ আলী জানালেন, "স্টার কর্তৃপক্ষ কেবল নিজেদের জমির ওপরই শাখা স্থাপন করে। ফলে পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎসহ মৌলিক চাহিদাগুলোর ওপর তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকে। কয়েক বছর হলো তারা যে তেহারি চালু করেছে, তা দুপুর হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যায়। চাইলে বেশি করে রান্না করানো যেত, কিন্তু তাতে মান ধরে রাখা যেত না।"

বর্তমানে স্টার হোটেল পরিচালনার দায়িত্বে আছেন মীর মমতাজ উদ্দীনের ছেলে মীর আখতার উদ্দীন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগ থেকে পড়াশোনা শেষ করেন। প্রথমে বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বাবা রাজি হননি। তাকে নিয়ে আসেন পারিবারিক ব্যবসায়।
প্রথমে আখতার উদ্দীনের হাতে তুলে দেন 'তাজ বেকারি'র দায়িত্ব, পরে 'প্রীতম ভবনের' নিচতলার বেকারিরও। শুরুতে দুমাস তার কাজ পর্যবেক্ষণ করেন মমতাজ উদ্দীন, তারপর মাসিক দুই হাজার টাকা বেতন নির্ধারণ করেন। ধীরে ধীরে আখতার উদ্দীন বেকারি ও রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় দক্ষ হয়ে ওঠেন। ষাট বছরের বেশি সময় ধরে চলা এ প্রতিষ্ঠানে তিনি আজ বাবার মতোই আন্তরিকভাবে জড়িত।
মাহমুদ আলী বলেন, "আখতার উদ্দীনও ভালো মানুষ। আত্মীয়স্বজনের খোঁজ রাখেন, মানুষের প্রতি তার আন্তরিক মমতা আছে।"
স্টারে এখন মোগলাই, বাংলা ও চাইনিজ খাবার মেলে। আছে ফাস্ট ফুড—চিকেন ফ্রাই, বার্গার। কাচ্চি বিরিয়ানি অত্যন্ত জনপ্রিয়। কাবাবের মধ্যে খাসির লেগ রোস্ট, মাটন চাপ, চিকেন টিক্কা, চিকেন তাওয়া কাবাব, রেশমি কাবাব বিশেষ কদর পায়। চাইনিজ খাবারের তালিকায় আছে ফ্রায়েড রাইস, চিলি চিকেন ইত্যাদি।
মাহমুদ আলী বললেন, "মানের তুলনায় স্টারের খাবারের দাম কম। যেমন গ্রিল চিকেন টিক্কা কাবাব (কোয়ার্টার) ১২০ টাকা, চিকেন তাওয়া ঝাল ফ্রাই ২২০ টাকা। দাম নিশ্চয়ই কাস্টমারদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।"
মীর আখতার উদ্দীনের বোনরাও এখন পারিবারিক হোটেল ও বেকারি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। মীর মমতাজ উদ্দীনের একটি প্রশ্নই যেন আজও স্টারকে সমৃদ্ধ করে চলেছে: খাবারের দোকান থেকে ক্ষুধার্ত মানুষ ফিরে যাবে কেন?
হোটেল আল রাজ্জাক, বংশাল
হোসেন মোল্লা ছিলেন ঢাকার ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও একসময় ভারপ্রাপ্ত মেয়র। নব্বইয়ের দশকে যখন তিনি হোটেল খোলার পরিকল্পনা করেন, তখন মূল উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে তৃপ্তির সঙ্গে খাওয়ানো, মুনাফা নয়।
সে সময় বংশালে ভালো কোনো হোটেল ছিল না। নাজিরাবাজার আজকের মতো জমে ওঠেনি, রায়সাবাজার ও কলতাবাজারও ছিল প্রায় ফাঁকা। অথচ আশপাশের প্লেইন শিটের আড়ৎগুলোয় বাণিজ্যিক কারণে প্রতিদিন আসত অনেক লোক। মূলত তাদের কথা ভেবেই তিনি প্রতিষ্ঠা করেন হোটেল—পিতার নামে নাম রাখেন আল রাজ্জাক।
খুব অল্প সময়েই সাড়া ফেলে দেয় হোটেলটি। কাচ্চি ও খাসির গ্লাসির জন্য খ্যাতি অর্জন করে। বিশেষ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এখানকার চা।
হোটেলে প্রবেশমুখেই চোখে পড়ে 'নো বিফ' লেখা স্টিকার। সুপারভাইজার জামির হোসেন সৌরভ বলেন, "মোল্লা সাহেব চেয়েছিলেন সব ধর্মের মানুষের জন্য হোটেলটি উন্মুক্ত রাখতে। তিনি ছিলেন ধার্মিক এবং উদার।"
তিনি আরও জানান, শুরু থেকেই হোটেলটির পরিধি ছিল মোটামুটি বড়—২০টি টেবিল, ৮০টি চেয়ার, ৪টি মহিলা কেবিন ও ১টি লম্বা টেবিল। আলাদা কেবিন রাখা হয়েছিল পর্দানশীন নারীদের কথা মাথায় রেখে।
আল রাজ্জাকের বড় সম্পদ ছিলেন ওহাব বাবুর্চি। কাচ্চি রান্নায় তিনি ছিলেন দুর্দান্ত। কোন তাপে কতক্ষণ জ্বাল দিলে স্বাদ নিখুঁত হবে, তা আন্দাজ করতে পারতেন অনায়াসে—যখন তাপমাত্রা মাপার যন্ত্রও ছিল না।
ওহাব বাবুর্চি এখন প্রয়াত, তবে তার শাগরেদরা আছেন। তার মেয়ের জামাই এখন রাজ্জাকের প্রধান বাবুর্চিদের একজন। সে কারণে এখনো স্বাদে কমতি নেই।

রাজ্জাকে রান্না হয় লাকড়ির চুলায়—এটিও স্বাদের অন্যতম রহস্য। এখানে পাওয়া যায় আনাম বা আস্ত খাসি, যা পুরান ঢাকার বিয়েবাড়িতে বেশ জনপ্রিয়, সামাজিক মর্যাদার অংশ হিসেবেই ব্যবহৃত হয়।
রাজ্জাকের আরেকটি জনপ্রিয় আইটেম হলো স্যুপ। মিটফোর্ড হাসপাতাল, ন্যাশনাল হাসপাতাল ও মাতৃসদনের রোগীরা রাজ্জাকের স্যুপ বেশ পছন্দ করেন।
সৌরভ বলেন, রাজ্জাকের সাফল্যের পেছনে রয়েছে—বড় পরিসর, তাজা খাবার, মানসম্পন্ন উপকরণ এবং সাশ্রয়ী মূল্য। তিনি জানান, আল রাজ্জাকই ঢাকায় প্রথম সেহেরির খাবার চালু করে। রাতভর যারা নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত থাকেন, তাদের কথা ভেবেই চালু হয়েছিল এটি। পরে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। সব শ্রেণিপেশার মানুষ সেহেরিতে রাজ্জাকে ভরসা করতে শুরু করে, এবং ধীরে ধীরে অন্যান্য হোটেলেও সেহেরি চালু হয়।
রাজ্জাকের কিছু বিদেশি কাস্টমারও আছেন—বিশেষ করে স্প্যানিশ ও সুইডিশ। তারা ব্যবসা বা ভ্রমণে এলেও একবার অন্তত রাজ্জাকে খেতে আসেন। তাদের প্রিয় পদ: রাজ্জাকের খাসির গ্লাসি।
দিনে হাজারেরও বেশি কাস্টমার সেবা পান আল রাজ্জাকে। সৌরভ বলেন, "রাজ্জাকের খাবারের মান যে উন্নত, এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো এর 'রিপিট কাস্টমার'—যারা বারবার ফিরে আসেন।"
তবে এখন গুলিস্তানের যানজট রাজ্জাকের জন্য কিছুটা সমস্যা তৈরি করেছে। নতুন ঢাকার অনেকের জন্য এখানে আসা কষ্টকর হয়ে পড়েছে। রাজ্জাক এখনো কোনো ফুড ডেলিভারি অ্যাপ বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়নি।
হোসেন মোল্লা মারা যাওয়ার পর তার সন্তান যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে হোটেলের দায়িত্ব নিয়েছেন। চটকদার কিছু করার বদলে, মান ধরে রাখার দিকেই তিনি সবচেয়ে বেশি মনোযোগী।
জান্নাত হোটেল, মোহাম্মদপুর
বাবুল হোসেন (৫৮) সৌদি আরবে ছিলেন ১৭ বছর। এর বড় একটি সময় তিনি একটি আরবি হোটেলের কাবাব সেকশনে কাজ করেছেন। দেশে ফেরেন ২০১০ সালে। তখন তার ফুপাতো ভাই হাজী মো. ইউনুসের ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় 'জান্নাত' নামে হোটেল ছিল। দেশে ফিরে বাবুল তার সঙ্গে যুক্ত হন এবং মোহাম্মদপুর টাউন হল শাখার দায়িত্ব পান।
ততদিনে জান্নাত ঢাকার একটি নামকরা হোটেলে পরিণত হয়েছে। প্রথম শাখাটি চালু হয় ২০০২ সালে। হাজী ইউনুস তাকে হাতে ধরে হোটেল ব্যবস্থাপনার খুঁটিনাটি শেখান।
বাবুল হোসেন বলেন, "হোটেল ব্যবস্থাপনা সহজ কাজ না, সবাই পারে না। খাবার ভালো হতে পারে, কিন্তু ব্যবস্থাপনা ভালো না হলে হোটেল টিকবে না। ভালো খাবার কাস্টমার টানে, আর ভালো ব্যবস্থাপনা ধরে রাখে। ভাইয়ের (হাজী ইউনুস) কাছ থেকে আমি এটাই শিখেছি।"
জান্নাত কীভাবে একটি ভালো হোটেলে পরিণত হলো? জানতে চাইলে বাবুল বলেন, "আমার ভাই খুব পরিশ্রমী আর ধার্মিক মানুষ। তিনি বিশ্বাস করেন, মানুষকে ভালো খাওয়ালে সওয়াব হয়। ইউনুস ভাইকে আমি ওস্তাদ মানি।"
হোটেল জান্নাতে প্রতিদিন ৫০টিরও বেশি পদ রান্না হয়। সকাল ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত খোলা থাকে। রাত ১২টার আগে হোটেল বন্ধ করার আগে স্যাভলন দিয়ে পরিষ্কার করা হয়।
সকালে রুটি, পরোটা, ভাজি, নিহারি, স্যুপ; দুপুরে ভাত-মাছ-গোশত-বিরিয়ানি; বিকেলে রেশমি কাবাব, আফগানি কাবাব, বিফ চাপ, মুরগির ঝাল ফ্রাই, তন্দুরি রুটি; রাতে আবার ভাত-মাছ-গোশত—এভাবেই চলে হোটেলের কার্যক্রম।
কাঁচাবাজার করা হয় কারওয়ান বাজার থেকে, মাছ-মুরগি-গোশত আনা হয় মোহাম্মদপুর টাউন হল এলাকা থেকে। বেশি পরিমাণ হলে মসলা আনা হয় মৌলভীবাজার থেকে।

হোটেলে ১৫টি টেবিল ঘিরে ৬০টি চেয়ার রয়েছে। বিকেলে এসব টেবিল খালি পাওয়া কঠিন। বাবুল জানান, তাদের কাবাবের চাহিদা সবচেয়ে বেশি, এরপর তন্দুরি রুটি। হালিমের চাহিদাও অনেক।
হালিম ও তন্দুরি রুটি খাচ্ছিলেন দুই বন্ধু মাজেদুল ইসলাম ও শহীদুল হক। দুজনেরই বয়স ৬০-এর বেশি। তারা জানান, সপ্তাহে অন্তত দুই দিন জান্নাত হোটেলে বিকেলের নাস্তা সারেন।
শহীদুল বলেন, "হোটেলটা নাম করেছে তার কর্মগুণে। এই যে দেখেন রুটিটা—অন্য হোটেলে এক কেজি আটায় ১৫-১৬টা রুটি বানায়, এখানে বানায় ১০-১১টা। অথচ দাম বেশি না। ভাজিতে টাটকা সবজি দেয়। তাই আর কোথাও যাই না।"
বাবুল হোসেন বলেন, "ভালো হোটেল চিনবেন কীভাবে? ঢুকেই সালাদের দিকে খেয়াল করবেন—শসা দেশি না হাইব্রিড, কাঁচা মরিচ কেমন, লেবু পাকা না কাঁচা। আমরা ভেজাল দিই না। যেমন পেপে ত্রিশ টাকায়ও পাওয়া যায়, আবার পঞ্চাশ টাকাতেও। আমরা পঞ্চাশ টাকারটাই কিনি। এতে দামের খুব হেরফের হয় না। যেমন মোগলাই পরোটা অন্যরা বিক্রি করে ৯০ টাকা, আমরা করি ১০০ টাকায়।"
হোটেল পরিচালনায় অনেক দিকে খেয়াল রাখতে হয়—কোন টেবিলে ঝুটা খাবার পড়ে আছে, কোথায় গ্লাস নেই, কোথায় ময়লা জমেছে, কোন তাওয়ায় কত গোশত চাপানো হয়েছে ইত্যাদি।
আরেকটি অভিজ্ঞতার কথা জানালেন বাবুল, "ক্যাশে কাস্টমাররা একদমই সময় দিতে চায় না। চেঞ্জ নিয়ে তাড়াতাড়ি চলে যেতে চায়। এতে ভুল হওয়ার ঝুঁকি থাকে। চাইনিজ হোটেলে কাস্টমার খুব শান্ত থাকে, নিজেদের ভদ্র হিসেবে উপস্থাপন করতে চায়। কিন্তু বাংলা হোটেলে এসে তাদের অস্থিরতা বেড়ে যায়। তাই এ ব্যবসায় সবাই ধৈর্য রাখতে পারে না।"
বাবুল হোসেনের বাবা ছিলেন কৃষক। কিশোরকাল পর্যন্ত বাবুল বাবার সঙ্গে জমিতে কাজ করেছেন। বড় হয়ে সৌদি আরবে যেতে চান, কিন্তু পাসপোর্ট করার ৮০০ টাকা জোগাড় করতে পারেননি। শেষে এক আত্মীয় ১,০০০ টাকা দিয়ে সাহায্য করেন। সেই টাকায়ই বাবুল সৌদি আরবে পাড়ি জমান। পরে তিনি শতাধিক লোককে সৌদি আরবে নিয়ে গেছেন।
প্রায় ছয় বছর হলো, তিনি জান্নাত হোটেলের পুরো দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। মাঝে মাঝে হাজী ইউনুস এসে হোটেল পরিদর্শন করেন। বাবুলের পরিচালনায় তিনি সন্তুষ্ট। বাবুলের বাবা দেড় বছর আগে মারা গেছেন। ছেলের উন্নতিতে খুশিতে কেঁদে ফেলতেন প্রায়ই। মা এখনো বেঁচে আছেন। বাবুল মাঝে মাঝে তাকে জান্নাতে নিয়ে আসেন, যা খেতে চান তা-ই খাওয়ান।
তিনি বলেন, "আমাদের পরিবারের সবাই জান্নাত হোটেলে খেতে পছন্দ করে, কারণ আমরা এখানে কখনো ভেজাল দিই না।"

তাঁতীবাজারের জগন্নাথ ভোজনালয়
পুরান ঢাকার তাঁতীবাজারের ১১০ নম্বর ভবনের দোতলায় অবস্থিত 'জগন্নাথ ভোজনালয়' আজও একই সাদামাটা পরিবেশে টিকে আছে। তবে মালিকানা বদল হয়েছে বছর দুই আগে। পুরাতন মালিক নেই, দায়িত্বে নতুন লোক। তবে খাবারের স্বাদে কোনো পরিবর্তন আসেনি—আগের মতোই চলে রেসিপির পুরোনো ধারা।
নিরামিষভোজীদের প্রিয় এই হোটেলটিতে নেই বাহারি সাজসজ্জা, নেই ঝকঝকে সাইনবোর্ড। সরু অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয় দোতলায়। দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়েছে, ভবনও জীর্ণ। তবু খ্যাতির ছাপ ছড়িয়ে আছে ঢাকাজুড়ে।
প্রবাদ আছে, 'চেনা বামুনের পৈতা লাগে না'। জগন্নাথ ভোজনালয়ের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। জীর্ণ দেওয়ালের মাঝে এই ছোট্ট নিরামিষ হোটেলটি গুণে-মানে উচ্চ। দূরদূরান্ত থেকে খদ্দের এসে ভিড় করেন, শুধু ঘরোয়া স্বাদের নিরামিষ খাবারের জন্য।
প্রায় দুই দশক ধরে মান বজায় রেখে চলছে এই ভাতের হোটেল। ২০০৫ সালে যাত্রা শুরু। উদ্দেশ্য ছিল সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জন্য নির্ভরযোগ্য নিরামিষ খাবারের ব্যবস্থা করা। শুরুতে কেবল সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জন্য হলেও সময়ের সঙ্গে অন্য ধর্মের মানুষরাও এখানকার নিয়মিত গ্রাহক হয়ে ওঠেন।
হোটেলের প্রতিষ্ঠাতা শ্যামল অধিকারীর পর মালিকানা গিয়েছে নিতাই পালের হাতে, পরে অশোক কবিরাজের কাছে। সর্বশেষ, ২৫ বছর বয়সি গোবিন্দ কৃষ্ণ দাস এখন হাল ধরেছেন। ১০ বছর বয়স থেকে রান্নার হাতে খড়ি তার। গুরুদেবের হাত ধরে ভোজনালয়ে এসেছিলেন, গুরুভাই অশোকের তত্ত্বাবধানে বড় হয়েছেন—এখন তিনি নিজেই মালিক।
গোবিন্দ এখন শুধু রাঁধেন না, হোটেলও চালান দক্ষ হাতে। বিবর্ণ দেওয়ালে কিছুটা রঙের ছোঁয়া দিয়েছেন, সাজসজ্জায় এনেছেন হালকা পরিবর্তন। কিন্তু খাবারের স্বাদ ও মান এখনো অটুট। তাই গ্রাহকদের উপস্থিতিও আগের মতোই।

গোবিন্দ বলেন, "আমরা বুঝে রান্না করি, প্রয়োজনে কম করি, কিন্তু বাসি রাখি না। কিছু থেকে গেলে দরিদ্র কাউকে দিয়ে দিই।"
এই ভোজনালয়ে প্রতিদিন রান্না হয় ২০ রকমের নিরামিষ পদ—ডাল, ভর্তা, ছানা, শাক, ভাজি, পনির, ভেজি সয়া, ধোকা, বড়া, রসা ইত্যাদি। সবচেয়ে জনপ্রিয় পদগুলোর মধ্যে আছে ডাল, ভেজি সয়া আর সয়া পনির। ভেজি সয়ার স্বাদ এতটাই ভালো যে চোখ বেঁধে খেলে অনেকেই বলবে—মাংস খাচ্ছে! এটি আমদানি হয় ভারত থেকে, দামও বেশি।
কোনো পদেই পেঁয়াজ-রসুন ব্যবহৃত হয় না। রান্নার শেষে স্টিলের বাটিতে খাবার সাজিয়ে রাখা হয় টেবিলে, যাতে গ্রাহক নিজের মতো করে বেছে নিতে পারেন।
এখানে কেউ চাইলে ৩০ টাকা, ৪০ টাকা কিংবা ১০০ টাকায়ও খেতে পারেন। যার যেমন সামর্থ্য, তার জন্য তেমন খাবার। প্রতিদিন ২৫০-৩০০ জন মানুষ খেতে আসেন। তাদের মধ্যে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বেশি।
ঢাকার মতো ব্যস্ত ও ভেজালভরা শহরে নির্ভেজাল, তাজা নিরামিষ খাবার খুঁজে পাওয়া কঠিন। জগন্নাথ ভোজনালয় সেই দিক থেকে যেন এক শান্তির ডেরা—যেখানে পেট যেমন ভরে, মনও তেমনি শান্ত হয়।