উশুতে মেডেল পেলে চাকরি মিলবে, তাই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন সান্ত্বনারা

রুবেল অভিনীত প্রথম ছবি লড়াকু মুক্তি পায় ১৯৮৬ সালে। তখন শরিফুল ইসলামের বয়স মাত্র পনেরো। ছবিটিতে রুবেলের মার্শাল আর্টের কসরত মুগ্ধ করে তাকে। বারবার ছবি দেখে ভাবতেন—একজন মানুষ কীভাবে একসঙ্গে পাঁচজনের সঙ্গে লড়াই করে!
মনের ক্যামেরায় বন্দি করতেন অ্যাকশন দৃশ্যগুলো। এরপর নিজে নিজেই শুরু করলেন অনুশীলন—হাড়ি ভাঙা, ইট ভাঙা, মাথার ওপর পা তুলে ধরা, শূন্যে ডিগবাজি খাওয়া। তখনো যমুনা সেতু হয়নি, রাজশাহী থেকে ঢাকায় যাতায়াত ছিল কঠিন, তাই কোনো ওস্তাদের কাছে শেখা হয়নি। তার একমাত্র প্রেরণা ও পরোক্ষ ওস্তাদ হয়ে উঠলেন রুবেল।
রুবেলের ছবি, তার পাঠ্যপুস্তক
রুবেলের নতুন ছবি মানেই ছিল শরিফুলের নতুন পাঠ্যপুস্তক। বীরপুরুষ, মারকশা, বজ্রমুষ্ঠি—এসব ছবি তিনি বহুবার দেখে শিখেছেন। আন্তর্জাতিক ওস্তাদ হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন ব্রুস লি ও জেট লি-কে। ভিসিআরে এন্টার দ্য ড্রাগন, ওয়ে অব ড্রাগন দেখে চোখ ফেরাতে পারতেন না। ব্রুস লির ক্ষিপ্রতা তাকে মনে করাত—এ মানুষ নন, অন্য কিছু। জেট লি'র নামেই যেন গতি—তিনি তাইচিতে ছিলেন পারদর্শী, আর শরিফুলও ধীরে ধীরে সেই বিদ্যায় দক্ষ হয়ে ওঠেন।
রাজশাহীতে মনোয়ার হোসেন বাবুকে ওস্তাদ পেয়েছিলেন, ঢাকায় এসে শিষ্যত্ব নেন নায়ক রুবেলের কাছে। কক্সবাজারে গিয়ে শিখেছেন দীন মহম্মদ রুস্তমের কাছে।
শিখতে ভালোবাসেন
নিজে ওস্তাদ হয়ে গেলেও শেখা থামাননি। ২০১৭ সালে উত্তরায় পরিচয় হয় চাইনিজ নারী শিক্ষক চৌ লাও শি'র সঙ্গে। শিশুদের চাইনিজ ভাষা শেখানোর পাশাপাশি তিনি উশুতেও পারদর্শী। শরিফুল শেখার ইচ্ছা জানালে শি প্রথমে রাজি হননি—"আপনি তো ওস্তাদ, ছোট বাচ্চাদের সঙ্গে আপনাকে মানাবে না।" কিন্তু শরিফুল হাল ছাড়েননি, দিনের পর দিন ক্লাসে গিয়ে বসে থাকতেন। শেষে তার আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে শি তাকে শেখানো শুরু করেন।
২০২২ সালে চীন থেকে আসা এক প্রশিক্ষকের কাছেও একই অভিজ্ঞতা। তিনি বলেন, "আপনি ওস্তাদ, আপনাকে আমি কীভাবে শেখাই?" শরিফুল তখন অনুশীলনের সময় ইচ্ছে করে ভুল করতে থাকেন, যাতে প্রশিক্ষক তা সংশোধন করেন। এভাবেই তিনি শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন। পরে চীনেও গিয়ে প্রশিক্ষণ নেন।

আজ তিনি বাংলাদেশ জাতীয় উশু দল ও বাংলাদেশ আর্মি উশু দলের প্রশিক্ষক। ধ্যান-জ্ঞান সবই উশু কেন্দ্রিক। হাঁটতে হাঁটতে নতুন কিক বা পাঞ্চের কৌশল ভাবেন, সবাই ঘুমিয়ে পড়লে আয়নার সামনে বা ছাদে গিয়ে অনুশীলন করেন। তার ভাষায়, "আমার ছাত্র-ছাত্রীরা আমাকে মডেল মনে করে। আমাকে সচল দেখলে তবেই না তাদের আত্মবিশ্বাস জন্মাবে।"
শুরু থেকে আজ পর্যন্ত কতজনকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন—এ প্রশ্নে শরিফুল বলেন, "বারো থেকে চৌদ্দ হাজার জনকে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। আমার ছাত্র-ছাত্রীদের অনেকেই গোল্ড মেডেল জিতেছে। তারা ভালো করলে গর্বে আমার বুক ভরে যায়। এটিই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি।"
চিরিরবন্দরের সান্ত্বনা ও শৈব্যা
উশু শেখানো শরিফুল ইসলামের প্রধান পেশা। তবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে সম্প্রতি তিনি ব্যবসাও শুরু করেছেন। মিরপুরের শহীদ সোহরাওয়ার্দী ইনডোর স্টেডিয়ামে দেখা হলো আরেকজন ওস্তাদ অনিমেষ রায়ের সঙ্গে। তিনি আনসারের সদস্য, কর্মস্থল দিনাজপুর।
বাংলাদেশ উশু ফেডারেশনের আয়োজনে ২৩ থেকে ২৭ জুলাই স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় উশু চ্যাম্পিয়নশিপ ২০২৫। অনিমেষ দিনাজপুরে উশুর প্রসার ঘটাতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। গ্রামে-উপজেলায় ঘুরে ঘুরে ছাত্র-ছাত্রী সংগ্রহ করেন তিনি। মেয়েদের ক্ষেত্রে বেশি বাধার মুখে পড়তে হয়—প্রথমে পরিবারের, পরে প্রতিবেশীদের। তবে কেউ কেউ সাহস দেখিয়ে পরিবারকে রাজি করায়, যেমন চিরিরবন্দরের সান্ত্বনা রানী রায়।
চার বোন এক ভাইয়ের সংসারে সান্ত্বনা দ্বিতীয়। বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে, বাকিরা বাবা-মায়ের ওপর নির্ভরশীল। বাবা-মা চিড়ে কুটে সংসার চালান। এ নিয়ে লজ্জা নেই সান্তনার, কিন্তু কষ্ট পায় বাবা-মায়ের পরিশ্রম দেখে। সংসারে স্বচ্ছলতা আনা এখন তার লক্ষ্য। ছোট বোন শৈব্যাকেও উশু খেলায় এনেছে সে।

সান্ত্বনার বয়স ২০, খেলে ৫২ কেজি ক্যাটাগরিতে, পড়ছে উচ্চমাধ্যমিকে। শৈব্যার বয়স ১৮, খেলে ৪৮ কেজি ক্যাটাগরিতে, পড়ছে দশম শ্রেণিতে।
টার্গেট গোল্ড
২০২১ সালে খেলা শুরু করে অল্প সময়েই উন্নতি করে তারা। ২০২৩ সালের বাংলাদেশ যুব গেমসে সান্ত্বনা জিতেছিল গোল্ড। এবার শৈব্যা পেয়েছে সিলভার, সান্ত্বনা হেরেছে অল্প ব্যবধানে। ওস্তাদের আশা, আগামী বছর তারা দুজনেই জাতীয় প্রতিযোগিতায় গোল্ড জিতবে।
বাবা অভয় চন্দ্র রায় মেয়েকে ডাকেন "বাঘিনী"—মনের দিক থেকে দৃঢ়, ভয়হীন। প্রতিযোগিতার আগে দুই-তিন মাস নিয়মিত অনুশীলন করতে হয়। শক্তি বাড়াতে খেজুর, ছোলা, কাজু, কিশমিশ খায় তারা। এতে প্রতি সপ্তাহে ৫০০-৬০০ টাকা বাড়তি খরচ হয়, যা বাবার জন্য চাপের। তবুও সান্ত্বনা আশা করে, গোল্ড পেলে আনসারে চাকরি হবে, আর সেটিই পরিবারকে কিছুটা স্বস্তি দেবে।
উশুর টুকিটাকি
দিনাজপুরের জয় রায় জানালেন, "উশু দুই ধরনের—সান্দা ও তাউলু। সান্দা দেখতে বক্সিংয়ের মতো, তবে পায়ের ব্যবহারও বৈধ। এতে ফেস কিক, পুশ কিক, থাই কিক, আপার পাঞ্চ, হুক পাঞ্চ করা যায়। গ্লাভস, কিক প্যাড, বক্সিং ব্যাগ পরে প্রতিযোগিতায় নামতে হয়। এটি আত্মরক্ষামূলক খেলা, আগে ডিফেন্স, পরে অ্যাটাক।"

জয়ের বয়স ১৯, সদ্য এসএসসি দিয়েছে। ২০১৯ সালে উশু শুরু করে। দিনাজপুর সদরে আনসার ও ভিডিপির সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে উশু ক্লাব। চিরিরবন্দর থেকে ১৬-১৭ কিলোমিটার দূরের এই ক্লাবে অটোতে করে সান্ত্বনা-শৈব্যারা অনুশীলনে যায়।
জয়ের আদর্শ দুইজন—ওস্তাদ অনিমেষ রায় ও বড় ভাই আনোয়ার জাহিদ শিশির। শিশিরের বয়স ২৪, পড়ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। ২০১৩ সালে বিকেএসপিতে ভর্তি হন তিনি। শুরুতে ক্রিকেটে আগ্রহ থাকলেও ক্ষিপ্রতার জন্য তাকে উশুতে নেওয়া হয়। তিনবার জাতীয় পর্যায়ে গোল্ড জিতেছেন তিনি।
শিশির বলেন, "কারাতে, উশু, তায়কোয়ান্দো—সবই মার্শাল আর্ট। কারাতে জাপানি, নন-কন্টাক্ট; তায়কোয়ান্দো কোরিয়ান, পায়ের ব্যবহার প্রধান; উশু চাইনিজ। উশুর সান্দা অংশটি ফাইটিং, তাউলু অনেকটা জিমন্যাস্টিক্স বা নৃত্যের মতো, যেখানে পোশাক, সংগীত ও বিভিন্ন অস্ত্র যেমন তরবারি, লাঠি বা বর্শার ব্যবহার হয়।"
সম্প্রতি সান্দায় দিনাজপুর ভালো করছে, তাউলুতে বরাবরের মতোই এগিয়ে কক্সবাজার ও রাজশাহী।
রেহানার গোল্ড
কক্সবাজারের মেয়ে রেহানা আক্তার এবারের জাতীয় উশু চ্যাম্পিয়নশিপে তাইছি ও তাইছিজিয়ান ক্যাটাগরিতে জিতেছেন দুটি গোল্ড মেডেল। বয়স আঠারো, পড়ছেন উচ্চমাধ্যমিকের দ্বিতীয় বর্ষে।
রেহানার উশুর গল্প শুরু নবম শ্রেণিতে। স্কুলের এক শিক্ষিকা প্রথম উশুর কথা বলেন—আত্মরক্ষা ও শারীরিক সুস্থতার কার্যকর উপায় হিসেবে। তিনি জানান, নিয়মিত অনুশীলনে হৃদরোগের ঝুঁকি কমে, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে, ডায়াবেটিস থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

পরিবারকে কিছু না জানিয়ে রেহানা ভর্তি হন উশু ক্লাবে। প্রাইভেট পড়তে যাচ্ছেন বলে গোপনে যেতেন অনুশীলনে। খুব দ্রুতই উন্নতি করে ক্লাব প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হন। তখনই দিনমজুর বাবা জানতে পারেন মেয়ের খেলার কথা। খুশি হলেও স্পষ্ট জানিয়ে দেন—খরচ বহন সম্ভব নয়।
এই সময় এগিয়ে আসেন ক্লাবের ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন পাখি। তিনি বিনা বেতনে রেহানাকে প্রশিক্ষণ দেন। আন্তরিকতা ও মনোযোগে রেহানা আরও দক্ষ হয়ে ওঠেন। অবশেষে এবারের জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে গোল্ড জিতে ওস্তাদের সম্মান রাখলেন।
উশু শেখার পেছনে রেহানার লক্ষ্য ছিল খেলোয়াড় কোটায় চাকরি পেয়ে পরিবারে স্বচ্ছলতা আনা। সেই স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে—গোল্ড জয়ের পর সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে তাকে চাকরির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। ওস্তাদ ও পরিবারের সম্মতি পেলে তিনি তা গ্রহণ করবেন।
কে কী জিতল
জাতীয় উশু চ্যাম্পিয়নশিপে দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রেখেছিল বাংলাদেশ আনসার। এবারের আসরে সেই মুকুট ছিনিয়ে নিয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। ২৭টি গোল্ড মেডেলের মধ্যে সেনাবাহিনী জিতেছে ১৬টি, আনসার ৭টি, দিনাজপুর ৩টি এবং বিজিবি ১টি।

প্রতিযোগিতায় সেনাবাহিনী, পুলিশ, আনসার, বিজিবি, বিকেএসপি-সহ মোট ২৮টি দলের ৪১৮ জন ক্রীড়াবিদ, কোচ ও কর্মকর্তা অংশ নেন। প্রতিযোগিতা শেষে বিভিন্ন শ্রেণিতে স্বর্ণ, রৌপ্য ও তাম্র মিলিয়ে ১০৮টি পদক দেওয়া হয়।
স্বর্ণ ও রৌপ্যজয়ীদের নিয়ে ১ আগস্ট থেকে মিরপুর ক্রীড়া পল্লীতে শুরু হয়েছে আবাসিক উশু ট্রেনিং ক্যাম্প, যার লক্ষ্য আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার জন্য প্রতিভাবান খেলোয়াড় তৈরি করা।
ছবি: সালেহ শফিক