‘কিলসুইচ ইঞ্জিনিয়ার’ থেকে ‘চিফ এআই অফিসার’... এআই যুগে নতুন যত পেশা
সম্প্রতি চ্যাটজিপিটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান 'ওপেনএআই'-এর জন্য 'কিলসুইচ ইঞ্জিনিয়ার' বা জরুরি সংযোগ বিচ্ছিন্নকারী চেয়ে একটি ভুয়া চাকরির বিজ্ঞাপন বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। কৌতুকপূর্ণ ওই বিজ্ঞাপনে বলা হয়, সফল প্রার্থীকে সারাদিন সার্ভারের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে এবং 'যদি যন্ত্রটি আমাদের ওপর চড়াও হয়', তবে সঙ্গে সঙ্গে তার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে হবে। এমনকি প্রয়োজনে সার্ভারে 'এক বালতি পানি ঢেলে দেওয়ার' দক্ষতা থাকাও বাঞ্ছনীয় বলে উল্লেখ করা হয়।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআইয়ের উত্থানে চাকরি হারানোর ব্যাপক আশঙ্কা থাকলেও বিষয়টি যে কেবল হাস্যরসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, তা নয়। এই প্রযুক্তি ইতোমধ্যেই নতুন নতুন কাজের সুযোগ তৈরি করছে—যেমন এআই এজেন্টদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাজে তাদের যুক্ত করা এবং তারা ঠিকভাবে কাজ করছে কি না, তা নিশ্চিত করা। এসব কাজের অনেক ক্ষেত্রেই মানুষের বিশেষ মানবিক দক্ষতার প্রয়োজন হচ্ছে।
শুরুটা করা যাক 'ডেটা অ্যানোটেটর' বা তথ্য ব্যাখ্যাকারীদের দিয়ে। এরা এখন আর শুধু ছবি ট্যাগ করার মতো স্বল্প আয়ের কাজেই সীমাবদ্ধ নন। এআই যত উন্নত হচ্ছে, মডেল প্রশিক্ষণের জন্য অর্থনীতি, আইন ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের মতো ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের প্রয়োজন বাড়ছে। 'মারকর' নামের একটি স্টার্টআপ এসব বোদ্ধা বা বিশেষজ্ঞকে নিয়োগ দিয়ে বট তৈরির কাজ করছে, যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় এক হাজার কোটি ডলার। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী ব্রেন্ডন ফুডি জানান, এসব বিশেষজ্ঞ গড়ে ঘণ্টায় ৯০ ডলার পর্যন্ত আয় করেন।
বট বা এআই তৈরি হয়ে গেলে সেগুলোকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাজের সঙ্গে যুক্ত করার জন্য প্রয়োজন হয় 'ফরোয়ার্ড-ডিপ্লয়েড ইঞ্জিনিয়ার' (এফডিই) দলের। সফটওয়্যার জায়ান্ট 'প্যালান্টিয়ার' এই ধারণার প্রবর্তক। তাদের কাজের ধরনে বেশ সাহসিকতার ছাপ রয়েছে। প্যালান্টিয়ারের একজন প্রাক্তন এফডিইর এক ব্লগপোস্টে লেখা ছিল, 'শুরুতে আমরা দুজন ইঞ্জিনিয়ার কান্দাহারের কাছে একটি সামরিক ঘাঁটিতে নামলাম। পালো আল্টো থেকে আমাদের ওপর নির্দেশ ছিল অল্প কথায় স্পষ্ট—সেখানে যাও এবং জয় করে এসো।'
বাস্তবে এই প্রকৌশলীরা একাধারে ডেভেলপার, পরামর্শদাতা ও বিক্রয়কর্মী। তারা সরাসরি ক্লায়েন্টের দপ্তরে গিয়ে এআই টুলগুলোকে প্রয়োজন অনুযায়ী সাজিয়ে দেন এবং চালু করেন। এফডিইদের সংখ্যা এখন দ্রুত বাড়ছে। স্টার্টআপ তৈরির কারখানা হিসেবে পরিচিত 'ওয়াই কম্বিনেটর'-এর প্রধান গ্যারি ট্যান সম্প্রতি জানান, তাদের নতুন কোম্পানিগুলোতে এফডিই পদের জন্য ৬৩টি চাকরির বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে, যেখানে গত বছর এই সংখ্যা ছিল মাত্র চারটি।
এআই এজেন্টের ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নির্মাতাদের বুঝতে হচ্ছে সেই মানবিক প্রেক্ষাপট, যেখানে তাদের পণ্যগুলো কাজ করবে। উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক, কোনো কোম্পানি যদি কাস্টমার সার্ভিস এজেন্ট তৈরি করে, তবে তাদের বুঝতে হবে কেন একজন হতাশ গ্রাহক স্বয়ংক্রিয় সেবা এড়িয়ে 'জিরো' ডায়াল করেন—শুধু একজন রক্তমাংসের মানুষের সঙ্গে কথা বলার, এমনকি চিৎকার করার সুযোগ পেতে।
দক্ষতা উন্নয়নবিষয়ক প্রতিষ্ঠান 'কর্নারস্টোন অনডিম্যান্ড'-এর প্রধান নির্বাহী হিমাংশু পালসুল চালকবিহীন গাড়ি বা রোবট্যাক্সি সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান 'ওয়েমো'-র উদাহরণ দিয়ে কাজের এই বিবর্তন ব্যাখ্যা করেন। ওয়েমোর গাড়িগুলো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নিজেই চলে। কিন্তু মাঝপথে যদি গাড়ি বিকল হয়ে যায় এবং যাত্রীরা ভেতরে আটকা পড়েন, তখন প্রয়োজন হয় 'গাই ইন দ্য স্কাই'—দূর থেকে নিয়ন্ত্রণকারী একজন মানুষের। তার শুধু প্রযুক্তিগত জ্ঞান থাকলেই চলবে না; আতঙ্কিত যাত্রীদের সামলানোর কৌশলও জানতে হবে।
পালসুল বলেন, আগে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারদের কদর ছিল তাদের কোডিং বা প্রোগ্রামিং দক্ষতার জন্য, তাদের ব্যবহারিক সক্ষমতার জন্য নয়। কিন্তু সময় বদলেছে। এখন অ্যালগরিদম দিয়েই কোড লেখা যায়। তাই তাঁর ভাষায়, 'আপনার ব্যক্তিত্বই এখন আপনার বাড়তি যোগ্যতা।
এরপর আসে নিয়মকানুন নির্ধারণের কাজ, যাতে এআই এজেন্টরা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে। নেটওয়ার্কিং সরঞ্জাম নির্মাতা সিসকোর নেতৃত্বাধীন গবেষণা দল 'এআই ওয়ার্কফোর্স কনসোর্টিয়াম' সম্প্রতি ধনী দেশগুলোর ৫০টি আইটি পেশা নিয়ে একটি জরিপ চালিয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, এআই প্রোগ্রামারদের চেয়েও দ্রুত বাড়ছে 'এআই ঝুঁকি ও শাসন' (এআই রিস্ক এন্ড গভার্নেন্স) বিশেষজ্ঞদের চাহিদা। এসব বিশেষজ্ঞের কাজ হলো বটগুলো যেন তথ্য ফাঁস না করে বা কোম্পানির কার্যক্রমে ব্যাঘাত না ঘটায়, তা নিশ্চিত করা।
সবশেষে এসব বিষয়কে এক সুতোয় গাঁথার দায়িত্ব পালন করেন 'চিফ এআই অফিসার'। করপোরেট দুনিয়ার শীর্ষ পদগুলোর মধ্যে এটি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এই পদে থাকা ব্যক্তির প্রযুক্তিগত দক্ষতার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট শিল্প সম্পর্কে গভীর জ্ঞান থাকতে হয় এবং করপোরেট প্রক্রিয়া ঢেলে সাজানোর অভিজ্ঞতাও প্রয়োজন। এটি মোটেও দুর্বল চিত্তের মানুষের কাজ নয়। প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আইবিএম-এর তথ্যমতে, একটি সাধারণ বড় কোম্পানি গড়ে প্রায় ১১টি জেনারেটিভ এআই মডেল ব্যবহার করে। এর ওপর বিক্রেতারা প্রতিনিয়ত নতুন নতুন এআই টুল গছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। এমন চাপের মধ্যে দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের হয়তো মাঝে মাঝেই সেই 'কিলসুইচ' বা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার বোতামটি খুঁজে নিতে ইচ্ছে করে।
