বাংলাদেশি পাসপোর্টে বিদেশি ইমিগ্রেশন পার হওয়ার ঝক্কি

আগেও দুইবার থাইল্যান্ড ভ্রমণ করেছেন মাহফুজ। এবার মে মাসে তৃতীয়বারের জন্য সেখানে গিয়ে তিনি অভিজ্ঞতা জানালেন, সবকিছু এবার ভিন্ন ছিল। ইমিগ্রেশন কাউন্টারে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই কর্মকর্তা তার বাংলাদেশি পাসপোর্ট উল্টে দেখার আগেই বললেন, 'অনুগ্রহ করে পাশে দাঁড়ান।'
প্রায় এক ঘণ্টা মাহফুজ একটি সংকীর্ণ ওয়েটিং এলাকায় বসে ছিলেন, সঙ্গে ছিলেন কয়েকজন বাংলাদেশি যাত্রী যারা বিমানের একই ফ্লাইটে থাইল্যান্ড এসেছেন। অন্য দেশের যাত্রীরা তখন সহজেই এগোচ্ছিলেন।
তার পালা আসার পর প্রশ্নগুলো যেন জেরার মতো হয়ে গেল—কেন একাই যাচ্ছেন? কোথায় থাকবেন? কত নগদ টাকা আছে? আর কেন ডেবিট কার্ডে ৫০০ ডলারের বেশি লিমিট নেই?
মাহফুজ জানান, 'আমি তাদের আমার ফেরার টিকেট এবং প্রথম কয়েক দিনের হোটেল বুকিং দেখিয়েছিলাম। তবু তারা সন্দেহের চোখে দেখছিল। তারা জিজ্ঞেস করল কেন পুরো ভ্রমণের জন্য হোটেল আগে থেকে বুক করিনি। আমি বললাম, ব্যাংককের পর কোথায় যাব তা এখনও ঠিক নয়, কিন্তু তারা সন্তুষ্ট হয়নি।'
শেষ পর্যন্ত অভিবাসন কর্মকর্তা তাকে নয়দিনের থাকার জন্য পুরো টাকা দিয়ে হোটেল বুকিং করতে বাধ্য করেন, তারপরই ছাড়েন। মাহফুজ বলেন, 'এই হয়রানির অভিজ্ঞতা ভাষায় বলা যায় না। অন্য যাত্রীদের সামনে আমি লজ্জিত বোধ করছিলাম, যেন আমি কোনো অপরাধী। হোটেল বুকিং করতে হলো, যেখানে অনেকটা সময় আমার থাকা হয়নি—এবং টাকা ফেরত নেওয়ার জন্যও অনেক দেরি হয়ে গিয়েয়েছিল।'
মাহফুজের ঘটনা একমাত্র ঘটনা নয়।
গত এক বছরে বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য ভিসা পাওয়া উল্লেখযোগ্যভাবে কঠিন হয়ে উঠেছে; বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, উপসাগরীয় দেশ, পূর্ব ইউরোপ, এমনকি ভারত ভ্রমণের ক্ষেত্রে। যারা অবশেষে ভিসা পান, তাদের ভোগান্তি কেবল দূতাবাসে শেষ হয় না।
বিদেশের ইমিগ্রেশন চেকপয়েন্টে অনেকেই কঠোর তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হন, যা প্রায়ই প্রবেশ নিষেধাজ্ঞা বা বিমান থেকে নামিয়ে দেওয়ার মতো সমস্যায় পরিণত হয়। ফলে তারা লজ্জিত হন, টাকা হারান এবং ফেরার ব্যবস্থা করতে বিমান সংস্থার ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হন।
এটি দেখায়, ভিসা কেবল একটি ধাপ—জাতীয়তা এখনও বিদেশি বিমানবন্দরে অতিরিক্ত সতর্কতার কারণ হতে পারে।
২৬ বছর বয়সী এনজিও কর্মী ফারজানা প্রথমবার বিদেশ যাচ্ছিলেন। তিনি কলম্বো যাচ্ছিলেন এক সপ্তাহব্যাপী সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য। কলম্বোর ইমিগ্রেশন চেকপয়েন্টে কর্মকর্তা জিজ্ঞেস করলেন, 'আপনি কি থাকার সময় কাজ করবেন?' ফারজানা ভেবেছিলেন প্রশ্নটি হয়তো সম্মেলন সংক্রান্ত, তাই উত্তর দিলেন, 'হ্যাঁ।'
এরপরই সমস্যা শুরু হয়।
ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা বুঝতে পারেননি এবং ধরে নেন যে ফারজানা কলম্বোতে চাকরি খুঁজছেন। সঙ্গে সঙ্গে তাদের আচরণে সতর্কতা দেখা দেয়। ফারজানা বিষয়টি পরিষ্কার করার চেষ্টা করলেও কর্মকর্তা বারবার জিজ্ঞেস করলেন—তার আমন্ত্রণপত্র আছে কি, তার এনজিও কী কাজ করে, কেন তাকে এই যাত্রার জন্য বাছাই করা হয়েছে এবং সম্মেলনের খরচ কে বহন করবে।
ফারজানা সব কাগজপত্র দেখিয়েছিলেন, তবু সন্দেহ কাটছিল না। শেষ পর্যন্ত তিনি স্বস্তি পেলেন, যখন একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করা সহকর্মীরা সেখানে উপস্থিত হলেন।
ফারজানা বলেন, 'ছাড়পত্র পাওয়ার আগে আমার প্রথম ভ্রমণের উত্তেজনা শেষ হয়ে গেছে। মনে হয় তারা ইচ্ছাকৃতভাবে আমাকে জটিল পরিস্থিতিতে ফেলার চেষ্টা করেছে, কারণ আমার পাসপোর্ট বাংলাদেশের ছিল—অন্যান্য দেশের নাগরিকদের সঙ্গে আমি একই আচরণ করতে দেখিনি।'
তিনি আরও বলেন, 'আমি ভাগ্যবান যে ইংরেজিতে ব্যাখ্যা দিতে পারছিলাম। কিন্তু অনেক বাংলাদেশি যাদের ইংরেজি ভালো না, তাদের জন্য এই ঝামেলা অনেক দীর্ঘ হয়।'
প্রবাসী বাংলাদেশি রেজা মধ্যপ্রাচ্যে পাঁচ বছরের বেশি সময় বসবাস করছেন। সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে ফেরার সময় তাকে ইমিগ্রেশনে আটকানো হয় এবং তিনি কঠোর প্রশ্নের সম্মুখীন হন।
রেজা বলেন, 'কর্মকর্তারা আমার চাকরি, বেতন ও পারিবারিক পরিস্থিতি নিয়ে ব্যাপকভাবে জিজ্ঞেস করেছিল। বৈধ রেসিডেন্সি কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও, তারা আমার সঙ্গে প্রথমবারের ভ্রমণকারীর মতো আচরণ করেছে, শুধুমাত্র আমার পাসপোর্ট বাংলাদেশের হওয়ায়।'
রেজা অন্তত তার গন্তব্যে প্রবেশ করতে পেরেছেন, কিন্তু অনেক বাংলাদেশি প্রবাসী ও পর্যটক আরও কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন।
সাম্প্রতিক উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৩ আগস্ট কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মালয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষ ভ্রমণের উদ্দেশ্য স্পষ্ট করতে না পারা এবং অসঙ্গতিপূর্ণ কাগজপত্র থাকায় ২০৪ জন বাংলাদেশিকে প্রবেশের অনুমতি দেননি। এর আগে ১১ জুলাই ৯৬ জন, ২৪ জুলাই ১২৩ জন, ২৫ জুলাই ৮০ জন এবং ৭ আগস্ট ২৬ জনকে একই ধরনের কারণে ফেরত পাঠানো হয়।
শ্রমিক অভিবাসন ও চলাচল বিশেষজ্ঞ ড. মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন শিকদার বলেন, 'সম্প্রতি বিদেশি অভিবাসন চেকপয়েন্টে বাংলাদেশিদের সঙ্গে যে হয়রানির ঘটনা ঘটছে, তার একটি অংশ সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া ও তুরস্কের মতো দেশগুলোর অতিরিক্ত সতর্কতার সঙ্গে সম্পর্কিত।'
তিনি বলেন, 'মালয়েশিয়ার ঘটনা বিশেষ কিছু। সম্প্রতি সেখানে কিছু বাংলাদেশিকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার সন্দেহে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমরা এখনও নিশ্চিত নই তারা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মালয়েশিয়ার নাগরিক না কি বাংলাদেশি কর্মী। তবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যেন আমরা শুধু সন্ত্রাসী পাঠাই মালয়েশিয়ায়।'
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের গণ-অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্রের পরিবর্তনের কারণে অনেক অপরাধী ভুয়া পরিচয়ে বিদেশে পালানোর চেষ্টা করছেন, ফলে বাংলাদেশের যাত্রীদের প্রতি বিদেশি কর্তৃপক্ষের নজর আরও সতর্ক হয়েছে।
বাংলাদেশ আউটবাউন্ড ট্যুর অপারেটরস ফোরামের (বিওটিওএফ) সভাপতি চৌধুরী হাসানুজ্জামান রনি বলেন, 'বাংলাদেশিদের বিদেশি ইমিগ্রেশনে হয়রানি ও ফেরত পাঠানো নতুন নয়। অতীতে অনেক দেশে আমাদের জন্য উন্মুক্ত ভিসা নীতি ছিল, তাই ঘটনা কম ঘটত। এখন বেশিরভাগ দেশে এটি বন্ধ, ফলে সমস্যা আরও দৃশ্যমান হয়েছে।'
তিনি সমস্যাটিকে মানব পাচার ও বিদেশে অবৈধভাবে কর্মসংস্থানের সঙ্গে যুক্ত করেন। তিনি বলেন, 'এই নেতিবাচক সুনামের কারণে আসল পর্যটকরাও সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। পাচারকারীরা প্রায়ই বাংলাদেশিদের পর্যটক ভিসায় পাঠায়, তাই বিদেশি ইমিগ্রেশন পুলিশ এখন অতিরিক্ত সতর্ক।'
তিনি জোর দিয়ে বলেন, 'অসাধু এজেন্সিগুলো মূল অপরাধী, যারা মানুষকে বিভ্রান্ত করে এবং ভুয়া কথা বলে বিদেশ পাঠায়। আসল পর্যটক সাধারণত প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও নগদ টাকা সঙ্গে রাখেন, তাদের গন্তব্য ও থাকার জায়গা জানা থাকে। কিন্তু যারা পর্যটকের ছদ্মবেশে আসে, তাদের জানা থাকে না। ফলে প্রতিটি বাংলাদেশিকে সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে।'
তিনি আরও বলেন, 'বৈধ অভিবাসী ও পর্যটকদের মধ্যেও সচেতনতার অভাব থাকে। বিভিন্ন সংস্থা ভুল তথ্য দেয়, নকল কাগজপত্র ব্যবহারের প্রলুব্ধ করে, আর সরকার সচেতনতা বাড়াতে উদ্যোগী নয়। যদি তা পরিবর্তন না হয়, বিদেশে বাংলাদেশিরা হতাশার মুখোমুখি হবেন।'
ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম ও ইয়ুথ প্ল্যাটফর্মের সহ-পরিচালক শরিফুল হাসান বলেন, 'অবৈধ অভিবাসনের ভূমিকা থাকলেও, গত এক বছরে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মূল কারণ হলো বাড়তে থাকা বিচারহীন সহিংসতা, টার্গেট করা হত্যাকাণ্ড এবং আইনশৃঙ্খলার অবনতি।'
ফলে বৈধ মার্কিন বা ইউরোপীয় ভিসা থাকা ব্যক্তিদেরও শুধু বাংলাদেশি পাসপোর্ট থাকার কারণে বারবার আটকানো হচ্ছে।
তিনি কিছু বাংলাদেশির অযত্নশীল আচরণের কথাও উল্লেখ করেন—পর্যটক ভিসায় প্রবেশ করা, সীমাবদ্ধ অঞ্চলে ভ্রমণ করা, যথাযথ নথি ছাড়া চলাচল করা; যা দেশের সুনাম ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
হাসান বলেন, 'দেখুন, যারা অবৈধভাবে ভূমধ্যসাগর অতিক্রমের চেষ্টা করছে, তাদের মধ্যে বাংলাদেশিরা প্রথম স্থানে রয়েছেন। এবং কিছু নাগরিক রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধে যোগ দিয়েছে। তাই বিদেশিরা বাংলাদেশিদের প্রতি কম বিশ্বাস রাখে। শুধু সরকারের কার্যকারিতা, অর্থনীতি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার উন্নতি এই পরিস্থিতি বদলাতে পারে।'
তিনি উল্লেখ করেন, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুসের আন্তর্জাতিক খ্যাতি ভ্রমণ সহজ করবে বলে যে আশা করা হয়েছিল, তা সফল হয়নি। 'পরিস্থিতি এখন আগের চেয়ে আরও খারাপ,' যোগ করেন তিনি।
ড. শিকদার বলেন, বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ঠিক করার জন্য গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা অত্যাবশ্যক। তিনি বলেন, 'যদি সুষ্ঠু নির্বাচন হয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা ভালো ধারণা পায়, তখনই বাংলাদেশ পুনরায় শক্ত অবস্থানে আসতে পারবে।' তিনি উল্লেখ করেন, নির্বাচিত নয় এমন সরকার আন্তর্জাতিক সূচকে ভালো ফলাফল পায় না—আর তাদের নাগরিক বিদেশে তার মূল্য ভোগ করে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: পরিচয় রক্ষার জন্য কিছু নাম পরিবর্তন করা হয়েছে।