বছরজুড়ে নিজেদের শক্তির প্রমাণ দিল চীন; আর তাতে নিজের অজান্তেই ‘সাহায্য’ করলেন ট্রাম্প
২০২৫ সালজুড়েই বিশ্বরাজনীতির মাঠ গরম রেখেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। একের পর এক নির্বাহী আদেশ, ইলন মাস্ককে অল্প সময়ের জন্য পাশে নিয়ে মার্কিন আমলাতন্ত্র ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ কিংবা বাণিজ্যের নিয়ম বদলে ফেলার ঘোষণা—সব মিলিয়ে বছরজুড়েই ছিল তার দাপট। বিশ্বজুড়ে কোথাও তিনি শান্তির বার্তা দিয়েছেন, আবার কোথাও যুদ্ধের হুমকি।
তবে এত সব তোড়জোড়ের মধ্যেও দিন শেষে সুবিধাজনক অবস্থানে পৌঁছে গেছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিন পিং। শুল্ক বা ট্যারিফ দিয়ে চীনকে চাপে ফেলার যে কৌশল ট্রাম্প নিয়েছিলেন, তা খুব একটা কাজে আসেনি। উল্টো শি চিন পিং বুঝিয়ে দিয়েছেন, ট্রাম্পের নীতি বাস্তবায়নে যুক্তরাষ্ট্র আসলে চীনের ওপর কতটা নির্ভরশীল। একুশ শতকের শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে এবারের রাউন্ডে তাই চীনের পাল্লাই ভারী।
বিদায়ী বছরে চীনের শিল্প খাতের দাপট ছিল চোখে পড়ার মতো। বৈশ্বিক উৎপাদনের এক-তৃতীয়াংশই এখন চীনের দখলে। এই সক্ষমতা দিয়ে তারা চাইলেই চোখের পলকে বিশ্ববাজারের 'সাপ্লাই চেইন' অচল করে দিতে পারে। সৌরবিদ্যুৎ, বায়ুশক্তি কিংবা বৈদ্যুতিক গাড়ির মতো সবুজ প্রযুক্তির ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ উপকরণ ও তৈরি পণ্যই আসে চীন থেকে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই খাতে যুক্তরাষ্ট্র অনেক বাধা সৃষ্টি করলেও 'ডিপসিক' (DeepSeek)-এর মাধ্যমে নিজেদের সক্ষমতা প্রমাণ করেছে বেইজিং। ওষুধশিল্পেও তারা পিছিয়ে নেই। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের সংখ্যায় চীনা কোম্পানিগুলো এখন যুক্তরাষ্ট্রের সমকক্ষ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে গতিতে তাদের চেয়ে এগিয়েও। দুই দশক আগেও পশ্চিমা কোম্পানিগুলো স্বল্পমূল্যের শ্রমের আশায় চীনে যেত। আর এখন পরিস্থিতি বদলেছে—তারা এখন চীনে যাচ্ছে গবেষণাগার তৈরি করতে।
আধিপত্য যখন 'অস্ত্র'
২০২৫ সালে এসে শি চিন পিং বুঝিয়ে দিয়েছেন, চীনের এই দাপট শুধু সম্পদ বাড়ানোর জন্য নয়, বরং ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্যও। অন্য দেশগুলোর নির্ভরতাকে বেইজিং কীভাবে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারে, তার বড় উদাহরণ হলো বিরল খনিজ রপ্তানিতে তাদের নিষেধাজ্ঞা।
অস্ট্রেলিয়ান স্ট্র্যাটেজিক পলিসি ইনস্টিটিউটের চলতি মাসের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ৭৪টি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা খাতের মধ্যে ৬৬টিতেই চীন এগিয়ে। এর মধ্যে কম্পিউটার ভিশন ও গ্রিড ইন্টিগ্রেশনের মতো দুই ডজনেরও বেশি খাতে চীনের একচ্ছত্র আধিপত্য রয়েছে।
সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, ট্রাম্প দেশে ও বিদেশে যেসব তোড়জোড় দেখিয়েছেন, তা নিজের অজান্তেই শি চিন পিংয়ের জন্য সুবিধাজনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। চীনকে ঘায়েল করতে তিনি দ্বিপক্ষীয় শুল্ক আরোপের যে পথ বেছে নিয়েছিলেন, তা ছিল ভুল সিদ্ধান্ত। কারণ, চীনের কোম্পানিগুলো কঠিন পরিস্থিতি সামলে নিতে অভ্যস্ত। তাছাড়া গণতান্ত্রিক দেশ না হওয়ায় অর্থনৈতিক ধকল সয়ে নেওয়ার সক্ষমতাও যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে চীনের বেশি।
ট্রাম্প চাইলে মিত্র দেশগুলোকে সঙ্গে নিয়ে চীনকে বাণিজ্যের জালে আটকাতে পারতেন। কিন্তু তিনি উল্টো শুল্ক বসিয়ে মিত্রদেরও দূরে ঠেলে দিয়েছেন।
বিজ্ঞানের ওপর ট্রাম্পের আক্রমণ যুক্তরাষ্ট্রের উদ্ভাবনী শক্তিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে। 'অদক্ষতা' ও 'ওক' (woke) মতাদর্শ দূর করার দোহাই দিয়ে তিনি গবেষকদের ওপর চড়াও হয়েছেন, পছন্দসই নয় এমন প্রতিষ্ঠানগুলোর হাজার কোটি ডলারের অনুদান আটকে দিয়েছেন।
বিদেশি, বিশেষ করে চীনা বংশোদ্ভূত বিজ্ঞানীদের প্রতি ট্রাম্পের বৈরী আচরণ মেধাবীদের যুক্তরাষ্ট্র বিমুখ করছে। অনেক মেধাবী বিজ্ঞানী যুক্তরাষ্ট্র ছাড়ছেন অথবা দেশটিতে যাওয়ার পরিকল্পনা বাদ দিচ্ছেন। আর এর সরাসরি সুফল ঘরে তুলছে চীন।
এখন প্রশ্ন হলো, দুই পরাশক্তির এই লড়াই কোন দিকে মোড় নিচ্ছে? স্বল্প মেয়াদে চীন যে এগিয়ে আছে, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। যুক্তরাষ্ট্র বা তার মিত্ররা চাইলেই রাতারাতি চীনের এই 'কৌশলগত আধিপত্য' বা 'সাপ্লাই চেইন'-এর নিয়ন্ত্রণ ভাঙতে পারবে না।
শি চিন পিং যদি তাইওয়ানের ওপর চড়াও হন, তবে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিয়ে তাকে থামানোর চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু এতে হিতে বিপরীত হওয়ার শঙ্কাই বেশি। চীনের পাল্টা পদক্ষেপে যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প খাত ও সাধারণ মানুষ যে পরিমাণ ক্ষতির মুখে পড়বে, তা সামাল দেওয়া কঠিন হতে পারে। আর এমনটা হলে পূর্ব এশিয়ার নিরাপত্তা এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়বে।
দীর্ঘ মেয়াদে চীনও কি স্বস্তিতে থাকবে?
স্বল্প মেয়াদে চীন এগিয়ে থাকলেও দীর্ঘ মেয়াদে দেশটির কঠোর রাজনৈতিক কাঠামোর কারণে সেই গতি থমকে যেতে পারে। অর্থনীতির দিকে তাকালেই বিপদের আঁচ পাওয়া যায়। গত নভেম্বরে চীনের কারখানার পণ্যের দাম আগের বছরের চেয়ে ২ দশমিক ২ শতাংশ কমেছে। এ নিয়ে টানা ৩৮ মাস দেশটিতে পণ্যের দাম কমল। আবাসন খাতেও ধস নেমেছে, সেকেন্ডারি মার্কেটে বাড়ির দাম শীর্ষাবস্থান থেকে ২০ শতাংশের নিচে এবং তা আরও কমছে।
সরকার অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ানোর কথা বললেও আদতে সেই উৎপাদন খাতেই জোর দিচ্ছে, যা তাদের অতিরিক্ত উৎপাদন সক্ষমতার সংকটে ফেলেছে।
২০২৬ সাল শেষ হওয়ার আগেই চীনের বর্তমান দাপটকে 'অহংকার' মনে হতে পারে। প্রদেশ ও শহরগুলো ঋণের ভারে জর্জরিত। জাপানের সেই 'হারানো দশক' বা দীর্ঘমেয়াদি স্থবিরতার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে চীনেও। অন্য দেশগুলো সস্তা চীনা পণ্য বর্জন করলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। অথচ ২০২৭ সালে চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আসার প্রস্তুতি নিচ্ছেন শি চিন পিং। তার ভুল ধরিয়ে দেওয়ার মতো কেউ নেই। চীনে ভুল যত বড় হয়, শাসকগোষ্ঠীর তা শুধরানোর ইচ্ছা তত কমে।
আমেরিকার আসল সংকট কোথায়?
চীনের বিপরীতে আমেরিকার ব্যবস্থায় পরিবর্তনের সুযোগ সবসময় থাকে। জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবাইকে আপন করে নেওয়ার 'সার্বজনীন মূল্যবোধ' আমেরিকার বড় শক্তি। এটিই বিশ্বজুড়ে মেধাবীদের টানে এবং আমেরিকার প্রভাব বজায় রাখে।
কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প এই মূল্যবোধকে দুর্বলতা মনে করেন। তিনি 'লৌহমানব' বা কঠোর শাসকদের পছন্দ করেন। তাঁর 'মাগা' (MAGA) নীতি জাতিগত ও ধর্মীয় বৈচিত্র্যকে শক্তি নয়, বরং হুমকি হিসেবে দেখে। আমেরিকাও যদি রাশিয়া বা চীনের মতো উগ্র জাতীয়তাবাদী পথে হাঁটে, তবে তারা নিজেদের সবচেয়ে বড় সুবিধাটিই হারাবে।
আগামী গ্রীষ্মে আমেরিকা তার স্বাধীনতার ২৫০ বছর উদযাপন করবে। দেশটির অর্থনীতি এবং পুঁজি ও মেধার সংস্থান এখনো বিশ্বের ঈর্ষার কারণ। কিন্তু ট্রাম্পের প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনীতি, কংগ্রেসকে খাটো করার প্রবণতা এবং দুর্নীতির অভিযোগ আমেরিকার এই উজ্জ্বল সম্ভাবনাকে কতটা ম্লান করবে, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। আর বেইজিং থেকে শি চিন পিং নিশ্চয়ই এই সবকিছুর ওপর কড়া নজর রাখছেন।
