ইউক্রেন ইস্যুতে মূল দাবির প্রশ্নে কোনো আপোস করবেন না পুতিন
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বুধবার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, ইউক্রেনকে ভূখণ্ড ছেড়ে দেওয়ার দাবিতে তিনি কোনো আপস করবেন না—যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ জোরদার করলেও নয়।
একদিকে যখন মার্কিন ও ইউরোপীয় নেতারা একটি শান্তি চুক্তি নিশ্চিত করার জন্য আপ্রাণ কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, ঠিক তখনই এক আক্রমণাত্মক ভাষণে পুতিন ইউক্রেনের ইউরোপীয় মিত্রদের তীব্র সমালোচনা করেছেন এবং ঘোষণা করেছেন যে, প্রয়োজন হলে রাশিয়া বলপ্রয়োগ করেই ভূখণ্ড দখল করবে।
রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক সভায় পুতিন বলেন, 'আমরা কূটনীতির মাধ্যমেই এই সমস্যার সমাধান এবং সংঘাতের মূল কারণগুলো দূর করতে আগ্রহী।'
তিনি আরও বলেন, 'যদি প্রতিপক্ষ দেশ এবং তাদের বিদেশি পৃষ্ঠপোষকরা ফলপ্রসূ আলোচনায় বসতে অস্বীকার করে, তবে রাশিয়া সামরিক পন্থায় তার ঐতিহাসিক ভূমিগুলো পুনরুদ্ধার করবে।'
এখানে তিনি মূলত সেই অঞ্চলগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন যা তিনি ইউক্রেনের কাছ থেকে দাবি করছেন; আর এই বিষয়টিই চলমান শান্তি আলোচনার সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভূখণ্ড সংক্রান্ত এই অমীমাংসিত প্রশ্ন এবং ইউক্রেনের জন্য নিরাপত্তার নিশ্চয়তার বিষয়টি শান্তি আলোচনার সময় সমাধান করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি ইউক্রেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং রাশিয়ার মধ্যকার পরস্পরবিরোধী অগ্রাধিকার বা স্বার্থের বিষয়গুলোকে স্পষ্টভাবে সামনে নিয়ে এসেছে।
রাশিয়া ইউক্রেনের দনবাস অঞ্চলটি অবৈধভাবে নিজেদের সাথে সংযুক্ত করলেও এখন পর্যন্ত এর পুরোটা দখল করতে পারেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক যুদ্ধ পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা 'ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অফ ওয়ার'-এর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, বর্তমান অগ্রগতির হার বজায় থাকলে পুরো দোনবাস অঞ্চলটি কব্জা করতে রাশিয়ার ২০২৭ সালের আগস্ট পর্যন্ত সময় লেগে যাবে।
সোমবার ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেন, পূর্বাঞ্চলীয় দনবাস অঞ্চলের সাময়িকভাবে দখলকৃত অংশকে কিয়েভ আইনগতভাবে বা কার্যত রাশিয়ার অংশ হিসেবে কখনোই স্বীকৃতি দেবে না।
ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট বুধবার রাতে দেওয়া পুতিনের সেই "ঐতিহাসিক ভূমি" সংক্রান্ত মন্তব্যেরও কড়া জবাব দিয়েছেন। জেলেনস্কি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, "ইউরোপে আরও এমন অনেক দেশ আছে যাদেরকে হয়ঁতো একদিন রাশিয়ার কেউ তাদের 'ঐতিহাসিক ভূমি' বলে দাবি করে বসবে। রাশিয়ার এই উন্মাদনাময় ইতিহাস থেকে আমাদের প্রকৃত সুরক্ষা প্রয়োজন।"
শান্তি চুক্তি সম্পাদনের সম্ভাবনার বিষয়ে ট্রাম্প বরাবরই অত্যন্ত আশাবাদী এবং এই সপ্তাহে তিনি বলেছেন যে, "আমরা এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে চুক্তির অনেক কাছাকাছি আছি।"
তবে ইউক্রেনের ইউরোপীয় মিত্ররা তুলনামূলকভাবে বেশি সতর্ক। তারা ইউক্রেনের জন্য শক্তিশালী নিরাপত্তা নিশ্চয়তার ওপর জোর দিচ্ছে।
নিজের ভাষণে এই পার্থক্যটি স্পষ্ট করে তুলতে সচেষ্ট ছিলেন পুতিন। তিনি বলেন, রাশিয়া 'যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সংলাপে রয়েছে', তবে বর্তমান নেতৃত্বের অধীনে ইউরোপের সঙ্গে শান্তি নিয়ে অর্থবহ আলোচনার সম্ভাবনা কম।
পুতিন আরও বলেন, 'আমি আশা করি ইউরোপের সঙ্গেও একই ধরনের সম্পৃক্ততা তৈরি হবে।'
তিনি বলেন, 'বর্তমান রাজনৈতিক অভিজাতদের সঙ্গে এটি সম্ভব হওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে আমরা যত শক্তিশালী হতে থাকব, ততই এটি অনিবার্য হয়ে উঠবে। বর্তমান রাজনীতিকদের সাথে সম্ভব না হলেও, ইউরোপের বর্তমান নেতৃত্বের যখন পরিবর্তন আসবে, তখন এটি অবশ্যই ঘটবে।'
চলতি সপ্তাহে ব্রাসেলসে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, যেখানে ইউক্রেনকে অর্থ সহায়তার জন্য রাশিয়ার জব্দকৃত সম্পদ ব্যবহার করা হবে কি না—তা নিয়ে আলোচনা করবেন ইউরোপীয় নেতারা। পুতিনের এই চ্যালেঞ্জিং বা যুদ্ধংদেহি মন্তব্যগুলো মূলত সেই সম্মেলনের ঠিক আগেই সামনে এল।
বুধবার ইউরোপীয় পার্লামেন্টে দেওয়া এক ভাষণে ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লিয়েন একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর গুরুত্বের ওপর বিশেষভাবে জোর দিয়েছেন। তিনি ইউরোপ মহাদেশকে নিজেদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিজেদের হাতে নেওয়ার এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষায় অর্থায়ন অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়েছেন।
ফন ডার লিয়েন বলেন, "ইউক্রেনের প্রতিরক্ষায় সহায়তা করার চেয়ে ইউরোপীয় প্রতিরক্ষার জন্য আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ হতে পারে না। এটি নিশ্চিত করার জন্য আগামী কয়েক দিন একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে যাচ্ছে। ইউক্রেনের এই লড়াইয়ে আমরা কীভাবে অর্থায়ন করব, তা বেছে নেওয়ার দায়িত্ব আমাদেরই।"
ইউক্রেনকে অর্থায়নের জন্য বর্তমানে দুটি ইউরোপীয় প্রস্তাব আলোচনার টেবিলে রয়েছে—একটি হলো (রাশিয়ার) জব্দকৃত সম্পদ ব্যবহার করা এবং অন্যটি হলো ঋণ গ্রহণ করা।
