লক্ষ্মীপুরে মেঘনার তীর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ বন্ধ রেখেছে ৫ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, ভাঙন আতঙ্কে স্থানীয়রা

মেঘনা নদীর পূর্ব পাড়ের লক্ষ্মীপুর জেলার ভাঙন কবলিত উপজেলা কমলনগর ও রামগতি। উপজেলা দুটির তীব্র নদী ভাঙন কবলিত ৩১ কিলোমিটার এলাকায় চলমান বেড়িবাধঁ নিমার্ণ প্রকল্পে অন্তত ৫টি বড় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাজ চলছে না। বিভিন্ন প্যাকেজে তাদের অধীনে রয়েছে ৩৫টি লটের (প্রতি লট ২৫০-৩৫০ মিটার) কয়েক কিলোমিটার কাজ। প্রকল্পের অন্য ১১ কোম্পানির ৬২টি লটের কাজও চলছে ধীরগতিতে।
এসব প্রতিষ্ঠানের কাজ দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় ভাঙন আতঙ্কে রয়েছেন স্থানীয়রা। প্রকল্প এলাকায় ঘুরে ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
প্রায় ৩ হাজার ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড।
লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদ-উজ-জামান খান জানান, কাজে অনুপস্থিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কার্যাদেশ বাতিল করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তারা কাজটি ভালোভাবে শেষ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রকল্পের বেশিরভাগ অংশে জিওব্যাগের ডাম্পিং দৃশ্যমান হলেও বিভিন্ন লটে এখনো গড়ে কাজ হয়েছে ২০ থেকে ৩০ ভাগ। কয়েকটি স্থানে কাজ শুরুই হয়নি।
২০২২ সালের জানুযারি মাসে শুরু হওয়া প্রকল্পটি চলতি বছরের ডিসেম্বর মাসে মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
পাটারিরহাট এলাকার বাসিন্দা মো. নোমান, মাহবুব ও সোলইমান জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন থেকে প্রকল্পের কয়েকটি পয়েন্টে কোনো কাজ চলছে না। কয়েকজন ঠিকাদারের কোনো খোঁজ নেই। এমনকি ঠিকাদারদের কোনো প্রতিনিধিও নেই। কয়েকজন ঠিকাদার শুরু থেকেই কাজ করেননি। এসব ঠিকাদাররা এখন লাপাত্তা। প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।
যেসব এলাকায় কাজ বন্ধ রয়েছে
প্রকল্পটি শুরু হয়েছে রামগতি উপজেলার বড়খেরী এলাকায় এবং শেষ হয়েছে কমলনগর উপজেলার মতিরহাট।
সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রকল্পের শেষ অংশে মতিরহাট বাজার এলাকা থেকে দক্ষিণ দিকে প্রায় দেড় হাজার মিটার এলাকায় ব্যাপক নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে।
মিলন ভান্ডারী ও কবির হোসেন নামের স্থানীয় দুই বাসিন্দা জানান, গত চার বছরওে এখানে কোনো কাজ হয়নি।
লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, চলতি এপ্রিল মাসে এ অংশের কাজের জন্য দুটি প্যাকেজে চারটি লটের দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে।
রামগতি উপজেলার আলেকজান্ডার পৌরসভার নুরিয়া হাজীরহাট সংলগ্ন এলাকায় দেখা গেছে, প্রায় ৬০০ মিটার জায়গায় কিছু জিওব্যাগ এলোমেলো পড়ে রয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা আরিফ হোসেন জানান, ২০২২ সালে সেখানে জিওব্যাগ ফেলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বিশ্বাস বিল্ডার্স। তারপর আজ পর্যন্ত ওই প্রতিষ্ঠানের কোনো খবর নেই। প্রতিষ্ঠানের কোনো কর্মকর্তাও আর সেখানে যাননি।
আরিফ আরও জানান, তারা সবসময়ই নদী ভাঙন নিয়ে আতঙ্কে থাকেন।
একই উপজেলার মুন্সিরহাটের সোনালী গ্রামে ৫-৬টি ও জনতা বাজারের চেংগু মার্কেট এলাকায় একটি লটের কাজ বন্ধ রয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা রিমন রাজু জানান, ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে কমলনগর উপজেলার পাতাবুনিয়া এলাকায় একটি কাজ দিয়ে প্রকল্পের উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধনের সময় কিছু জিওব্যাগ ফেলা হয়েছে। তারপর গত চার বছরে সেখানে কোনো কাজ হয়নি। প্যাকেজের ২৫/১-৩ নম্বর লটের কাজটি পেয়েছিল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এডব্লিউআর।
একই উপজেলার পাটারিরহাট এলাকায় প্রকল্পের ১৯/১ এবং ১৯/২ নম্বর লটে কিছু জিওব্যাগ ফেলার পর আর কাজ হয়নি। চলতি বর্ষা মৌসুমে ভাঙন শুরু হয়েছে। চলতি সপ্তাহে ভাঙন এলাকা পরিদর্শন করেছেন, কমলনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রাহাত উজ জামান।
স্থানীয় বাসিন্দা মোশাররফ হোসেন জানিয়েছেন, কাদির পন্ডিতের হাটে ৩টি, লুধুয়া বাজার এলাকায় একটি করে কাজের ১ থেকে ২ ভাগ শেষ হয়েছে। এরপর গত ২ বছর ধরে এসব জায়গায় আর কাজ হয়নি।
যেসব ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের কাজ দীর্ঘদিন বন্ধ
কোন কোন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাজ বন্ধ রয়েছে, সে বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা বিস্তারিত জানাতে চাননি।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের তিনজন প্রকৌশলী জানিয়েছেন, প্রকল্পের কার্যাদেশ প্রাপ্ত ৯৭টি লটের মধ্যে ৩৫টি লটে কোনো কাজ হচ্ছে না।
এদের মধ্যে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান এসএসইসিএল-এর ৭টি লটে ২ থেকে ৩ ভাগ, এডব্লিউআর এর ৫টি লটে ২ ভাগ, বিশ্বাস বিল্ডার্সের ৬টি লটে ২ ভাগ, ইলেক্ট্রো গ্রুপের ১টি লটে ৫ ভাগ শেষ হওয়ার পর থেকে প্রকল্পের কাজ বন্ধ রয়েছে।
অন্যদিকে ওয়ের্স্টান ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ১৫টি লটে প্রায় ৪০ ভাগ শেষ হওয়ার পর থেকে দীর্ঘদিন ধরে কাজ বন্ধ।
ওয়ের্স্টান ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রজেক্ট ম্যানেজার মাসুদ রানা বলেন, 'ঈদের (ঈদুল ফিতর) পর থেকে কয়েকটি কাজ চালু করার চেষ্টা করছি।'
তবে কী কারণে কাজ বন্ধ রয়েছে, সে বিষয়ে কিছু জানাননি তিনি।
প্রকল্পের দৃশ্যমান কাজ যেখানে
কমলনগর উপজেলার মাতব্বরহাট বাজারের দক্ষিণ পাশে ৩টি লটের কাজ প্রায় শেষের দিকে। সেখানেই এ প্রকল্পের প্রথম দৃশ্যমান বেড়িবাঁধ হয়েছে। নতুন নির্মিত বাঁধটি দেখতে প্রতিদিন বহু মানুষ আসছেন।
প্রকল্প এলাকায় দেখা যায়, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জামিল ইকবাল গ্রুপের ৭টি, ন্যাশনটেকের ৭টি, রহমান ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ৩টি, কে কে এন্টারপ্রাইজের ৫টি, এসএবি'র ১৭টি, নিয়াজ এন্টারপ্রাইজের ৪টি, এফএসএসের ২টি, বিজে টেক্সটাইলের ৫টি, হাসান ব্রার্দাস এবং শহীদ ট্রেডার্সের কাজ চলছে। এসব প্রতিষ্ঠানের কোনো কোনটিতে মোট কাজের ২০ থেকে ৪০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে।
পুরো প্রকল্পে কাজের সমান্তরাল অগ্রগতি নেই কেন?
মেঘনা নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ নিমার্ণ দাবি নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে আন্দোলনরত সামাজিক সংগঠন 'কমলনগর-রামগতি বাঁচাও মঞ্চ'।
সংগঠনটির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট আবদুস সাত্তার পালোয়ান অভিযোগ করেন, 'শুরু থেকেই প্রকল্পটিতে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ ছিল না। দীর্ঘদিন বালু সংকটের অজুহাত দেখিয়ে সঠিক সময়ে সঠিক কাজ হয়নি।'
তিনি অভিযোগ করে বলেন, 'পাঁচ বছরের প্রকল্পটিতে প্রতি অর্থবছরে গড়ে ৬০০ কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ দেওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে সে রকম বরাদ্দ দেওয়া হয়নি।
পরিকল্পনা কমিশন ও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) তালিকা থেকে জানা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে মাত্র ৫০ কোটি, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৫০ কোটি, ২০২৩-২৪ অর্থবছর ১২০ কোটি এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৪০০ কোটি টাকার বরাদ্দ রাখা হয়। ৪টি অর্থবছরে মোট বরাদ্দ হয় ৭২০ কোটি টাকা।
এ আইনজীবী বলেন, 'শুরু থেকেই স্থানীয়দের দাবি ছিল সেনাবাহিনীর মাধ্যমে কাজটি বাস্তবায়নের। তবে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে কাজটি বাস্তবায়ন হয়নি। তাই প্রকল্পের প্রতিটি লটে কাজে সমান্তরাল অগ্রগতি নেই। কোথাও জিওব্যাগের ডাম্পিং হচ্ছে, আবার কোথাও ব্লক ডাম্পিং হচ্ছে এবং কোথাও এখনো কাজ শুরুই হয়নি।'
স্থানীয় বাসিন্দা রাকিব হোসেন জানান, প্রকল্প শুরুর কয়েক দিনের মধ্যে বালুর সংকট দেখিয়ে বিভিন্ন পয়েন্টে দীর্ঘদিন কাজ বন্ধ ছিল।
কয়েকজন ঠিকাদার দাবি করেন, মূলত প্রথম দিকে অর্থ বরাদ্দ ছিল কম। সেজন্য দ্রুতগতিতে কাজ শুরু করা যায়নি।
কতটি প্রতিষ্ঠান কাজ পেয়েছে?
প্রকল্পের কয়েকটি নথি থেকে জানা গেছে, ২০২১ সালের আগস্ট থেকে চলতি বছরের এপ্রিল মাস পর্যন্ত ১৯৬টি দরপত্র নোটিশ করা হয়। এতে ৩৪টি প্যাকেজে ৯৭টি লটের কাজ পায় ১৬টি বড় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। চলতি বছরের এপ্রিলে মাসে আরো ৪টি লটের দরপত্র আহ্বান করা হয়।
বাঁধের পরিকল্পনায় কী রয়েছে?
প্রকল্পের পরিকল্পনাপত্র সূত্রে জানা গেছে, ভাঙনরোধে প্রথমে জিওব্যাগে বালু ভর্তি করে মেঘনা নদী থেকে তীরের দিকে ৫০ মিটার অংশে বস্তা ফেলে ভাঙনের গতি রোধ করা হবে। এটাকে বলা হয় ডাম্পিং। পরে জিওব্যাগের ওপর পাথরের তৈরি সিসি ব্লক ফেলা হয়। এটাকে বলা হয় ব্লক ডাম্পিং। এরপর ব্লক প্লেসিং, গাইড ওয়াল নির্মাণ। জিওব্যাগ এবং পাথরের ব্লকের পরে মাটির উচু বেড়িবাঁধ তৈরি করা হবে। এ সময় ৩১ কিলোমিটার এলাকায় ১৮টি রেগুলেটর নির্মাণ করা হবে। শেষে বেড়িবাধেঁর ওপর গাছের চারা রোপণ করা হবে।
বাঁধ নির্মাণের পর
প্রকল্পের কাজ শেষ হলে দুই উপজেলার ৮ লাখ মানুষ নদী ভাঙন থেকে রক্ষা পাবে। প্রকল্প এলাকার কাজ শেষের পর ৩৭ কিলোমিটার লম্বা একটি মেরিন ড্রাইভ তৈরি হবে। এতে একদিনে যেমন যোগাযোগ সহজ হবে, অন্যদিকে এটি পর্যটকদেরও আকর্ষণ করবে।
যে কারণে বাঁধটি ঘিরে স্থানীয়দের অনেক স্বপ্ন
১৯৮১ সালের এবং ২০১১ সালের আদমশুমারি তথ্য থেকে জানা গেছে, মেঘনা নদীর অব্যাহত ভাঙনে ৩০ বছরে রামগতি ও কমলনগর এলাকার অন্তত ২৪০ বর্গকিলোমিটার নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এ সময় মেঘনা নদীতে ঘরবাড়ি হারিয়েছে অন্তত দেড় লাখ মানুষ।
অব্যাহত নদী ভাঙন, নদীর জোয়ার এবং প্রতি বছরের ঘূর্ণিঝড়ে ১৯৬০ সালে নির্মিত বন্যা নিয়ন্ত্রণকারী বাঁধ ৫৯/২ নম্বর পোল্ডারটি পুরোপুরি বিলীন হয়ে যায়। এতে ৮ লাখ মানুষের দুটি উপজেলা পুরোপুরি অরক্ষিত হয়ে পড়ে।
এসব অঞ্চলের প্রতি ১০০ জনের মধ্যে প্রায় ৮০জনই নদী ভাঙনের শিকার হয়। প্রতি বছর হাজার হাজার একর জমির ফসল এবং মানুষের ঘর বাড়ি নদীর পানিতে ভেসে যায়।
এ নিয়ে নদী ভাঙন কবলিত এসব মানুষ দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছিলেন। পরে রামগতি ও কমলনগরকে রক্ষার জন্য ২০২১ সালের জুন মাসে একনেকের সভায় ৩ হাজার ৮৯ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রকল্পটি মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে কাজের উদ্বোধন হয়।
কাজ না করা প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে স্থানীয়রা যা বলছেন
বাঁধ নির্মাণ নিয়ে সোচ্চার অ্যাডভোকেট আবদুস সাত্তার পালোয়ান ও ইমরান হোসেন শাকিলসহ এলাকাবাসীর দাবি, যেসব ঠিকাদার কাজ করছেন না, তাদের বাতিল করে নতুন ঠিকাদারদের কাজ দেওয়া হোক। পাশাপাশি বর্ষা মৌসুমে যাতে নদীর তীর না ভাঙে, সেজন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা।
জানতে চাইলে লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদ-উজ-জামান খান বলেন, 'যেকোনো পরিস্থিতিতে মেঘনা নদীর বাঁধ তৈরির কাজটি ভালোভাবে শেষ করতে চাই। যেসব ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে কাজ ফেলে রাখার অভিযোগ এসেছে, তাদের কাজ বাতিল করে নতুন ঠিকাদার নিয়োগ করা হবে।'
অন্যদিকে প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ হচ্ছে বলেও জানান তিনি।