অপরিকল্পিত প্রকল্পে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের অপচয় ৬৫ কোটি টাকা; চারটিই এখন পরিত্যক্ত

পাহাড় ক্ষয় ও ভূমিধস রোধে বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত বিন্না ঘাস ২০১৮ সালে থাইল্যান্ড থেকে আনা হয় চট্টগ্রাম নগরীতে। প্রায় ২৮ লাখ টাকা ব্যয়ে নগরীর টাইগারপাস সড়কের মিঠাপাহাড়ে এ ঘাস রোপণ করে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন।
প্রকল্পটির উদ্বোধন করেন থাই রাজকন্যা মহাচক্রি শিরীন ধরন। লক্ষ্য ছিল, নগরীর অন্যান্য পাহাড়েও এই ঘাস ছড়িয়ে দেওয়া। তবে প্রকল্পটি আর এগোয়নি। জমকালো উদ্বোধনের পরও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন আর কোনো আগ্রহ দেখায়নি।
একপর্যায়ে অর্থ সংকটে বন্ধ হয়ে যায় প্রকল্পের কার্যক্রম। বর্তমানে সেই মিঠাপাহাড়ে ঘাসের বদলে কেবল ঝোপঝাড় আর একটি পরিত্যক্ত ভবনই দেখা যায়।
তবে শুধু বিন্না ঘাস প্রকল্পই নয়, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ঢাকঢোল পিটিয়ে এমন অন্তত চারটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল—কিন্তু একটিরও বাস্তবায়ন হয়নি।
এসব প্রকল্পে মোট প্রায় ৬৫ কোটি টাকা অপচয় হয়েছে, যার কোনো সুফল জনগণ পায়নি। একের পর এক এভাবে জনসাধারণের অর্থ নষ্ট হলেও কারও বিরুদ্ধে নেওয়া হয়নি কোনো ব্যবস্থা। কোটি কোটি টাকার এই অপচয়ের দায়ে এখনও পর্যন্ত কাউকে জবাবদিহির আওতায় আনা হয়নি।
বিন্না ঘাস রোপণ প্রকল্প ছাড়াও আলো না দেখা প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে— নগরীর বহদ্দারহাট থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত মেরিনার্স বাইপাস সড়ক, জাতিসংঘ পার্কে সুইমিং পুল ও জিমনেশিয়াম, এবং জাকির হোসেন রোডে চলন্ত সিঁড়িযুক্ত ফুট ওভারব্রিজ। এর মধ্যে দুটি প্রকল্পের অবকাঠামো কখনও ব্যবহারই হয়নি, আর বাকি দুটি এখন কার্যত পরিত্যক্ত।
পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহ-সভাপতি প্রকৌশলী সুবাস বড়ুয়া দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'এইসব প্রকল্পে জড়িত প্রকৌশলী বা আমলাদের বিরুদ্ধে সরাসরি ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো বিধান নেই। আমলা ও রাজনীতিবিদদের সঙ্গে কিছু পেশাজীবীরাও এতে জড়িত।'
তিনি বলেন, 'কোনো প্রকল্প জনগণের কাজে লাগবে কি না, তা দেখার সময় তাদের নেই—পকেটে টাকা এলেই হলো। ২০২৪ সালের আন্দোলনে এত রক্ত দেওয়ার পরও জবাবদিহি নিশ্চিত করা হচ্ছে না। যতদিন না এই সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসা যাবে, ততদিন মুক্তি নেই। জড়িতদের জবাবদিহির আওতায় আনতেই হবে এবং জনগণকে এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হবে।'
মেরিনার্স সড়কে নেই কোনো যানবাহন
২০১০ সালে একনেকে অনুমোদিত 'মেরিনার্স বাইপাস সড়ক' প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল নগরীর জলাবদ্ধতা ও যানজট নিরসন। ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫৭ কোটি টাকার বেশি। পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্মিত হওয়ার কথা ছিল ৩ দশমিক ২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাজ শেষ হয় মাত্র দেড় কিলোমিটার পর্যন্ত। বহদ্দারহাট মোড় থেকে শুরু হয়ে সড়কটি গিয়ে থেমেছে বারইপাড়ার কাছে একটি ভবনের পেছনে। কোনো মূল সড়কের সঙ্গে সংযোগ না থাকায় এটি দিয়ে কোনো যানবাহন চলাচল করে না।
৪ কোটি টাকার সুইমিং পুল এখন আবার পার্ক
২০১২ সালে জাতিসংঘ পার্কের (বর্তমান জুলাই স্মৃতি উদ্যান) একাংশে চার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয় সুইমিং পুল ও জিমনেশিয়াম। তবে একদিনের জন্যও ব্যবহার হয়নি এগুলো। ২০১৫ সালের জুনে নির্মাণকাজ শেষ হয়। দুটি সুইমিং পুলের প্রতিটির দৈর্ঘ্য ১২০ ফুট এবং প্রস্থ ৫০ ফুট। ৭ হাজার বর্গফুট জায়গার ওপর নির্মিত জিমনেশিয়াম ভবনে ছিল না কোনো ব্যায়ামের সরঞ্জাম।
শুরু থেকেই এলাকাবাসী এই প্রকল্পের বিরোধিতা করে আসছিলেন। তারা বলেন, সুইমিং পুলটি অপরিকল্পিতভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। ২০১৬ সালে তৎকালীন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন এটি ২৫ বছরের জন্য 'এলিট পার্ক লিমিটেড' নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে ইজারা দেওয়ার উদ্যোগ নেন। তবে তৎকালীন গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন ও পাঁচলাইশ আবাসিক সমিতির বাধার মুখে তা আর সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে উচ্চ আদালতে রিট হলে বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণের প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়।
চার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সুইমিং পুল ও জিমনেশিয়াম ব্যবহার না করেই 'অনুপযোগী' ঘোষণা করা হয়। পরে স্থাপনাগুলো ভেঙে ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে সেখানে গড়ে তোলা হয় সবুজ উদ্যান।
পরিত্যক্ত ৪ কোটি টাকার ফুটওভারব্রিজ
২০২০ সালে চার কোটি টাকা ব্যয়ে জাকির হোসেন রোডে নির্মিত হয় চলন্ত সিঁড়িযুক্ত ফুট ওভারব্রিজ। চালুর সময় জানানো হয়, এটি সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। দু'দিকে ছিল চলন্ত সিঁড়ি, তবে নিচে নামার জন্য ব্যবহার করতে হতো সাধারণ সিঁড়ি।
নির্মাণের পর মাত্র দুই মাস চালু ছিল ওভারব্রিজটি। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, এর বিভিন্ন যন্ত্রাংশ খুলে পড়েছে, মরিচা ধরেছে বহু জায়গায়। সিঁড়িতে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রয়েছে আবর্জনা। পুরো ওভারব্রিজটি এখন একেবারেই পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'এখন হয়তো এসব প্রকল্প অপরিকল্পিত মনে হচ্ছে। কী বিবেচনায় তখন এই প্রকল্পগুলো নেওয়া হয়েছিল, তা আমরা এখন বলতে পারছি না। তবে এটা আমাদের জন্য শিক্ষা। এমন জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প অবশ্যই স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করে গবেষণার ভিত্তিতে গ্রহণ করা উচিত, অন্যথায় সুফল পাওয়া যায় না।'
এসব বিষয়ে জানতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নগর পরিকল্পনাবিদ আবদুল্লাহ আল ওমর এবং প্রধান প্রকৌশলী মো. আনিসুর রহমান সোহেলের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তাদের পাওয়া যায়নি।