দেশেই কোচ অ্যাসেম্বল করতে তিন কারখানার আধুনিকায়নে ২ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প রেলের

বিদেশনির্ভরতা কাটিয়ে দেশেই ট্রেনের কোচ তৈরি করতে চায় বাংলাদেশ রেলওয়ে। এজন্য সংস্থাটি প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে সৈয়দপুর, পাহাড়তলী ও পার্বতীপুরের তিনটি কারখানাকে আধুনিকায়নের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।
কারখানাগুলোর সক্ষমতা দ্বিগুণ করার পাশাপাশি বছরে অন্তত ৫০টি কোচ অ্যাসেম্বেল [সংযোজন] করার লক্ষ্য নিয়েছে রেলওয়ে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে বিদেশি ঋণের সন্ধান করছে সরকার।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে কারখানাগুলোর সক্ষমতা দ্বিগুণে উন্নতি হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আফজাল হোসেন টিবিএসকে বলেন, 'আমরা রেলের কারখানাগুলোর আধুনিয়ন করতে দুই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্প চেয়েছি। দেশেই কোচ অ্যাসেম্বল করার জন্য প্রয়োজনীয় আধুনিকায়ন করা পরিকল্পনা আছে। কোচ ও ইঞ্জিন মেরামতের সক্ষমতা দ্বিগুনে উন্নতি করার পরিকল্পনা আছে।'
'পাশাপাশি বছরে ৫০টি কোচ অ্যাসেম্বেল করার চিন্তা রয়েছে। এছাড়া জনবলকে প্রশিক্ষিত করার হবে। পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন নির্ভর করছে অর্থায়নের ওপর। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ অর্থায়ন নিয়ে কাজ করছে', যোগ করেন তিনি।
ব্রিটিশ আমল থেকেই সৈয়দপুর ও পাহাড়তলীতে রেল কোচ তৈরি ও মেরামতের কাজ হতো। পাকিস্তান আমলেও সেই ধারাবাহিকতা ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে পুরোপুরি আমদানি নির্ভর হয়ে পড়ে রেলওয়ে। তখন থেকে আর কোচ অ্যাসেম্বলিং হয়নি, তৈরি হয়নি প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবলও। আগের সেই ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে তিনটি কারখানার আধুনিকায়নের উদ্যোগ নিয়েছে সংস্থাটি।
রেলওয়ের তথ্যমতে, সৈয়দপুর ও পাহাড়তলী কারখানা দুটি ব্রিটিশ আমলে স্থাপিত। এখানে কোচ ও ওয়াগন মেরামত করা হয়। স্বাধীনতার পরে, ১৯৯২ সালে দিনাজপুরের পার্বতীপুরে স্থাপন করা হয় লোকোমোটিভ কারখানা, যেখানে ইঞ্জিন মেরামতের কাজ হয়। বর্তমানে এই তিন কারখানায় প্রায় ১২০০ যন্ত্রাংশ রয়েছে, যার অর্ধেকই অকার্যকর বা মেয়াদোত্তীর্ণ। ফলে কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না।
পাশাপাশি তীব্র লোকবল সংকট রয়েছে। সৈয়দপুর কারখানায় মঞ্জুরিকৃত টেকনিক্যাল পদের সংখ্যা প্রায় ২৬০০ ও পাহাড়তলী কারখানায় তা প্রায় ২২০০-এর মতো। অথচ দুটি কারখানায় স্থায়ী জনবল মাত্র ৩০ শতাংশ। আর বাকি ১০ শতাংশ অস্থায়ী (টিএলআর)। অর্থাৎ মঞ্জুরিকৃত পদের মাত্র ৪০ শতাংশ দিয়ে চলছে কারখানা দুটি।
কারখানার সীমিত সক্ষমতার কারণে মেরামতের কাজও ব্যাহত হচ্ছে। সৈয়দপুরে প্রতিদিন গড়ে ৪ ইউনিট (দুটি কোচ) এবং পাহাড়তলীতে গড়ে ৩ ইউনিট (দেড়টি কোচ) মেরামতের সক্ষমতা আছে। কিন্তু বর্তমানে রেলের চাহিদা অনুযায়ী নূন্যতম প্রত্যেকটি কারখানায় দৈনিক গড়ে ছয়টি কোচ মেরামতের সক্ষমতা থাকা প্রয়োজন।
রেলওয়ের পরিবহন ও যন্ত্র প্রকৌশল বিভাগ জানায়, ৫০ শতাংশের বেশি ইঞ্জিন ও কোচের আয়ুষ্কাল শেষ হয়েছে। বর্তমানে রেলে সচল কোচ আছে দুই হাজারের কিছু বেশি এবং সচল ইঞ্জিন প্রায় ২০০টি। কিন্তু ৯৩টি বন্ধ ট্রেন চালাতে প্রয়োজন ৩ হাজার কোচ ও ৩০০ লোকোমোটিভ। মোট ইঞ্জিন-চালিত ট্রেনের প্রায় অর্ধেকই অচল বা মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায়, রেল চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে। পূর্বাঞ্চলে সচল কোচ প্রায় ৮০০টি, ইঞ্জিন ৭২ থেকে ৭৬টি এবং পশ্চিমাঞ্চলে কোচ ৭০০টির মতো ও ইঞ্জিন ১৫৩টি সচল রয়েছে।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের চীফ অপারেটিং সুপারিনটেনডেন্ট (পূর্ব) মো. শহিদুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'রেলের উন্নয়ন করতে হলে কারখানার আধুনিকায়ন জরুরি। কোচ ও ইঞ্জিনগুলো নিয়মিত মেরামত করা গেলে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক রাখা যাবে। সেবার মানও বাড়বে। আর আমদানি প্রক্রিয়ায় থাকা কোচগুলো রেলের বহরে যুক্ত হলে মেরামতের সক্ষমতাও বাড়াতে হবে।'
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান টিবিএসকে বলেন, 'একটি অসম্পূর্ণ প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) জমা পড়েছিল, যেখানে শুধু লোকোমোটিভের কথা ছিল আমি এটি ফেরত পাঠিয়েছি। বলেছি, কোচের বিষয়টিসহ যুক্ত করতে।'
তিনি আরও বলেন, 'আমাদের অগ্রাধিকার— পাহাড়তলী, সৈযদপুর ও পার্বতীপুরের ওয়ার্কশপের সক্ষমতা অ্যাসেম্বেল স্টেজ পর্যন্ত নেওয়া। পাশাপাশি অর্থায়নের বিষয়টিও দেখছি। এডিবিসহ যারা রেলওয়ে খাতে অর্থায়ন করে, তাদের অনানুষ্ঠানিকভাকে বলেছি।"