এই মৃত শহর আঁকড়েই বেঁচে থাকার চেষ্টা করছি আমরা

'এই শহর জানে আমার প্রথম সবকিছু। পালাতে চাই যত, সে আসে আমার পিছু পিছু'- কবীর সুমনের এই গান যেন অনেকেরই জীবনে সত্য। এ রকমই এক পচে যাওয়া, ক্ষয়িষ্ণু নগরীর প্রেমে পড়ে আছি। বিভিন্ন কারণে বিরক্ত এ নগরীর ওপর, কিন্তু ছেড়ে যেতেও কষ্ট হয়। বিশ্বের সুন্দরতম নগরে গিয়েও কয়দিন পর এই ধ্বসে পড়া নগরের জন্য পরাণ কাঁদে।
হ্যাঁ, আমাদের ঢাকা শহরের কথাই বলছি, যে শহর 'গ্লোবাল লিভেবিলিটি ইনডেক্স ২০২৫' অনুযায়ী বিশ্বের তৃতীয় বসবাসের অযোগ্য শহর হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে।
পরিকল্পনা, সচেতনতা ও শিক্ষার অভাব, অতিরিক্ত জনসংখ্যা, দুর্নীতি এবং সর্বোপরি শহরের প্রতি ভালোবাসাহীনতায় একটি সুন্দর শহর দিনে দিনে নরকে পরিণত হয়েছে। এখানে আমরা সবাই বসবাস করি, কিন্তু কেউ শহরটির প্রতি দয়িত্ব পালন করি না, যত্ন করি না, ভালোবাসি না।
এ শহরের অধিবাসীদের বড় একটা অংশ এখানে উদ্বাস্তুর মতো জীবনযাপন করেন। বাকি যারা ভবন নির্মাণ করে বাস করেন বা ভাড়া বাসায় থাকেন, তারাও খুব স্বার্থপরের মতো জীবনযাপন করেন। শহরের বা প্রতিবেশির ভালোর দিকে তাদের দৃষ্টি নাই, শুধু নিজের ঘরে গুছিয়ে থাকতে পারলেই হয়।
এ শহরে আমরা প্রায় সবাই অভিবাসী। কারো দাদা এসেছেন, কারো বাবা বা কেউ নিজেই এসেছেন শিকড় ছেড়ে। ঢাকার আদি মানুষ, অর্থাৎ ঢাকাইয়া জনগোষ্ঠীর সংখ্যা এখন কম, নন-ঢাকাইয়া মানুষ বেশি।
ঢাকার প্রধান সমস্যাগুলোর মধ্যে আছে অতিরিক্ত মানুষ, দূষিত পানি, নোংরা পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, দুর্বল স্বাস্থ্যসেবা, বস্তি, অতিরিক্ত জ্যাম, ভাঙাচোড়া গণপরিবহন, জলাবদ্ধতা, খানাখন্দ, নদীর পানিতে বিষাক্ত বর্জ্য, উন্মুক্ত ভাগাড়, মারাত্মক শব্দদূষণ, ধুলোবালিসহ নগর পরিকল্পনার চরম অভাব।
তাই যখন ইকোনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের ২০২৫ সালের রিপোর্টে বিশ্বের বসবাসযোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকা তিন ধাপ পিছিয়ে ১৭১ তম অবস্থানে রয়েছে, তখন অবাক হইনি। ঢাকার আগে রয়েছে শুধু যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক ও লিবিয়ার ত্রিপোলি।
পাঁচটি প্রধান মানদণ্ডে বিশ্বের ১৭৩টি শহরের মূল্যায়ন করা হয়। এগুলো হলো স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসেবা, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষা এবং অবকাঠামো। এর কোনটিতেই আমাদের ঢাকা টিকতে পারে নাই, ভবিষ্যতেও টিকতে পারবে বলে মনে হয় না। কারণ গত বছরই বিশ্লেষকেরা বলছেন, ঢাকাকে বসবাসের আদর্শ শহর করার আর কোনো উপায় নেই। তবে কিছুটা স্বস্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
অন্যদিকে, এবারের তালিকায় সবচেয়ে বাসযোগ্য শহরের শীর্ষে উঠে এসেছে ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেন। সব মিলিয়ে শহরটির মোট স্কোর দাঁড়িয়েছে ৯৮। এর আগে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা টানা তিন বছরের শীর্ষ অবস্থানে ছিল। উল্লেখ এই গ্লোবাল লিভেবিলিটি ইনডেক্সকে বিশ্বের বড় শহরগুলোর জীবনমান পরিমাপের একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড হিসেবে ধরা হয়।
ঢাকা শহরকেন্দ্রীক উন্নয়ন ব্যবস্থাই ঢাকার পিঠে ছুরিকাঘাত করেছে। ভালো পড়াশোনা কোথায়, চাকরি কোথায়, ছোট ব্যবসা-বড় ব্যবসা কোথায়, যেকোনো কাজের সুরাহা কোথায়, তদবির কোথায় সবকিছুতেই ঢাকা। নানান কাজে মানুষ ঢাকায় আসতে থাকে বানের মতো। যারা একবার এসে কোনো সুযোগ পেয়ে যান, তারা আর এ শহর ছেড়ে যেতে চান না, মাটি কামড়ে পড়ে থাকেন।
যারা পড়তে আসেন, তারা এখানে থেকেই চাকরি খোঁজেন। পেয়ে গেলে এখানেই স্থায়ী হন। আমার পরিচিত একজন বলেছিলেন, ঢাকা শহর যেন বটবৃক্ষ। যেকোনো শাখা ধরেই ঝুলে থাকা যায়।
এভাবেই মানুষ, আবাসন ও পরিবহন-গণপরিবহন এত বেড়েছে যে বিশ্লেষকরা বলছেন, ঢাকাকে বসবাসের আদর্শ শহর করার জন্য পরিকল্পনামাফিক নগর উন্নয়ন করা দরকার, দরকার সুশাসন। ঢাকা এখন জনসংখ্যার আধিক্যে ধুঁকছে। সেই সংখ্যা না কমে বরং প্রতিদিনই বাড়ছে।
সবশেষ জনশুমারি অনুযায়ী, দেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার ৯১১ জন। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে রয়েছে চার কোটি ৫৬ লাখ ৪৩ হাজার ৯৯৫ জন। যা মোট জনসংখ্যার ২৬.৮৮ শতাংশ। আর ঢাকা শহরের জনসংখ্যা দুই কোটির বেশি। প্রতি বর্গ কিলোমিটারে বাস করেন চার লাখের বেশি মানুষ।
এই যে ঢাকাকে ভালোবেসে বছরের পর বছর কাটিয়ে দিলাম, কিন্তু ঢাকাকে নিয়ে ভেবেছি কি ঠিকমতো? এত নেতিবাচকতা নিয়ে কী হবে ঢাকা শহরের?
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) মনে করে, ঢাকায় সেবা দেওয়ার সঙ্গে জড়িত সংস্থাগুলোর নজরদারি ও জবাবদিহি দুর্বল। যার যখন খুশি তখন কাজ করছে, যখন খুশি রাস্তা ভাঙছে, গড়ছে। ঢাকার যেকোনো জলাশয় মশার প্রজননক্ষেত্র। পানিতে ময়লার ভাগার, কারখানার বর্জ্য।
নগর উন্নয়ন পরিকল্পনাবিদরা বলেন, ঢাকার উন্নয়ন পরিকল্পনা করা হয়েছে এলোমেলোভাবে। আর তাই উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হলেও বাসযোগ্যতায় ঢাকা পিছিয়েই থাকছে। ঢাকায় নাগরিক সুবিধা যা আছে, ঢাকাবাসী মানুষ আছে তার চাইতে অনেক বেশি। ঢাকা বর্ধিত হয়েছে আয়তনে কিন্তু অবকাঠামোগত ও ভৌত সুবিধা আনুপাতিকহারে বাড়েনি।
৭০ থেকে ৯০ দশক অব্দি এ শহরের প্রতিটি রাস্তা, অলিগলি ছিল পরিচিত। শহরে বেবি আইসক্রিমের গাড়ি কবে চলতে শুরু করল, কোণ আইসক্রিম কবে এল, মস্কো সুজের দোকান কোথায় ছিল, গুলিস্তানে মীরজুমলার কামান, প্রথম চাইনিজ রেঁস্তোরা সব জানা ছিল।
ঢাকা আমার সেই শহর, যে শহরে আমার জন্ম ও বেড়ে উঠা। চোখের সামনে কেমন করে একটি শহরের বাড়িঘর, প্রকৃতি, নদীনালা, খালবিল, ব্যবসা-বাণিজ্য, উৎসব এবং সর্বোপরি মানুষগুলো বদলে গেল।
পাড়া-মহল্লাভিত্তিক ঢাকা শহর ছিল গাছ-গাছালিতে ভরপুর। আমরা গাছ কেটে ভবন ও রাস্তা নির্মাণ করেছি। গাছ না কেটেও কীভাবে ভবন তৈরি করা যায় বা রাস্তা বড় করা যায়, এটা নিয়ে আমাদের চর্চা নেই।
এ দেশে অবশ্য উন্নয়নের কোপ প্রথমেই গাছের ও মাঠের ওপরে পড়ে। ঢাকা শহরের এই উন্নয়নের জেরে ধ্বংস হয়েছে প্রকৃতি
একদিকে মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, অন্যদিকে মানুষের জন্যই অ-বসবাসযোগ্য হয়ে উঠেছে ঢাকা শহর। এ শহরে এখন কোনো জলাশয় নেই, নেই জলাশয়কে কেন্দ্র করে নিঃশ্বাস নেওয়ার স্থান। যেটুকু জলাধার আছে যা তাতেও পচা পানির গন্ধ ও মশা।
শৈশব-কৈশোরে বৃষ্টির জমে থাকা পানিতে পা ভিজিয়ে ঘুরে বেড়াতাম পাড়ায়। ছেলে-মেয়েরা পানিতে ভেসে আসা মাছ ধরত। বৃষ্টির পরের দিন মাঠে ঘাসের হলুদ পাতা জমে যেত। সবচেয়ে মজার ব্যাপার ছিল কোথায় থেকে যেন ঝাঁকেঝাঁকে হলুদ ব্যাঙ এসে ঘ্যাংর-ঘ্যাং করে ডাক ছাড়ত প্রতি বর্ষায়।
ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসে। শহরের বাতাসে ধোঁয়া বাড়তে থাকে এবং যতদিন যেতে থাকে, ততই পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকে। শহরের মানুষগুলো প্রথমে লক্ষ্য করল যে তারা ঘর থেকে বের হলে দম নিতে পারছে না। কারণ, বাতাসে এমন কিছু ছিল যা তাদের শ্বাস-প্রশ্বাসকে আটকে দিচ্ছিল।
বড় হতে হতে শহরটাই ক্রমে অচেনা হতে শুরু করে। কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই শহর বড় হতে থাকে। গাছ কেটে ভবন বানানো হলো, নদী-নালা, খাল-বিল ভরাট করে শপিং কমপ্লেক্স, গার্মেন্টস, অফিস বানানো হলো। ঢাকার জনসংখ্যা বাড়তে শুরু করল জ্যামিতিক হারে।
কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই ঢাকার চারিদিকে হু হু করে গড়ে উঠছে বহু অট্টালিকা, ছোট কারখানা, হাউজিং প্রকল্প, শপিং কমপ্লেক্স, অফিস, ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। যে অবকাঠামোগুলো গড়া হচ্ছে, সেগুলোও যথেষ্ট মানসম্মত নয়। আর সেইসাথে প্রায় সবক্ষেত্রেই আছে দুর্নীতি ও সুশাসনের অভাব।
খেলার মাঠ, পার্ক, বিনোদনের জায়গা কিছু নেই শহরটাতে। ঢাকাকে বস্তির শহরও বলা যায়। এ শহরে ৩০ ভাগ মানুষ বস্তিতে বসবাস করেন। এসব বস্তি এলাকার বসবাসের পরিবেশ, নিরাপত্তা, পানি, স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা সবই খারাপ। শিশুদের জন্য নেই শিক্ষার ব্যবস্থা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আকতার মাহমুদ গণমাধ্যমকে বলেছেন, 'ঢাকার ওপর মানুষের চাপ কমাতে হবে সবার আগে। কিন্তু তার কোনো পরিকল্পনা নাই। দেশের অন্যান্য শহরের যদি উন্নয়ন করা হয়। সেখানে যদি কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষার ভালো ব্যবস্থা করা যায় তাহলে রাজধানীর ওপর চাপ কমবে। এত লোকের নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করা ঢাকা শহরের পক্ষে সম্ভব নয়। তারপরও যদি ঢাকার জনসংখ্যা আরো বাড়তে থাকে তাহলে এটা পুরোপুরি বসবাসের অযোগ্য শহরে পরিণত হবে। ঢাকা শহরকে বিকেন্দ্রায়ন করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।'
ঢাকার অর্থনৈতিক সুযোগ, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা, দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ এবং হাসপাতালের অবস্থান, উচ্চশিক্ষা ও উন্নত চিকিৎসার সুযোগ, খাবারের বৈচিত্র, গতি, যোগাযোগ ব্যবস্থা, একদিকে ঢাকাকে যেমন আকর্ষণীয় করেছে, অন্যদিকে ঢাকায় জনসংখ্যা আধিক্যের জন্য এটাই দায়ী। জীবনযাপন ও আয়ের উৎস থাকার জন্য ঢাকা অনেকের প্রথম পছন্দ।
একটি শহরকে অ-বাসযোগ্য বলা হয়, যখন এটি বসবাসের জন্য প্রয়োজনীয় মৌলিক সুযোগ-সুবিধা, নিরাপত্তা, এবং জীবনযাত্রার মান দিতে পারে না। আমাদের স্বপ্নের ঢাকা ঠিক এমনই একটি মৃত শহর। এই মৃত শহরে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী বেঁচে আছে ঠিকই, কিন্তু মৃতদের মতো।
অনেক দুর্ভোগ আর অশান্তির পরও রাজধানী 'ঢাকা' মানুষের প্রাণ। জীবনের এমন কোনো বিষয় নেই, মাত্রা নেই, যার সঙ্গে ঢাকা প্রসঙ্গ জড়িত নয়। একটি গোছানো ও পরিকল্পিত শহর ক্রমশ বিশ্বের নিকৃষ্টতম শহরে পরিণত হলো। আমার ভালোবাসার শহরটাকে আর খুঁজে পাই না। ৬০, ৭০ ও ৮০-র দশকে আমরা যারা এ শহরে বেড়ে উঠেছি, ৯০-এ এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি, চাকরি জীবন শুরু করেছি, তারা এখন এ শহর ছেড়ে পালাতে চাইছি, কিন্তু পারছি না। এখনো এই মৃত শহর আঁকড়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছি।
লেখক- যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক