পঞ্চায়েত নির্বাচনে জয়ী ৬ নারীর পরিবর্তে কেন শপথ নিলেন তাদের স্বামীরা?

যে ভিডিও থেকে বিতর্কের সূত্রপাত, সেটিতে দেখার মতো তেমন কিছুই ছিল না। ভারতের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের ১২ জন পুরুষ গোল হয়ে দাঁড়িয়ে, গলায় উজ্জ্বল মালা পরে নতুন স্থানীয় সরকার গঠনের উদ্দেশ্যে উচ্চস্বরে শপথ বাক্য পাঠ করছেন।
যা নিয়ে বিতর্ক তা হলো, নির্বাচিত ১২ জন প্রতিনিধির মধ্যে ৬ জন ছিলেন নারী। কিন্তু শপথ গ্রহণের সময় তারা অনুপস্থিত ছিলেন, তাদের প্রতিনিধিত্ব করেছে তাদের স্বামীরা।
৩ মার্চের অনুষ্ঠানের পর ভিডিওটি দ্রুত ভাইরাল হয়ে যায় এবং পরবর্তী সপ্তাহে ভারতের জাতীয় সংবাদপত্রের সাংবাদিকরা মধ্য ভারতের ছত্তিশগড় রাজ্যের প্যারাস্বরা গ্রামে চলে আসেন, এমনকি আন্তর্জাতিক নারী দিবসের দিনেও।
নির্বাচিত ৬ নারী প্রতিনিধির এভাবে সরাসরি অনুপস্থিত থাকার ঘটনাটি অবাক করার মতো হলেও, মোটেও অপ্রত্যাশিত কোনো ঘটনা নয়। অনানুষ্ঠানিকভাবে স্ত্রীর পরিবর্তে স্বামীর শপথ নেওয়া গ্রামীণ ভারতে সাধারণ চিত্র, বিশেষত যেখানে সংক্ষিপ্ত মেয়াদের নেতৃত্বস্থানীয় পদগুলো দীর্ঘদিন ধরে নারীদের জন্য সংরক্ষিত ছিল।
১৯৯২ সাল থেকে পঞ্চায়েত বা ঐতিহ্যবাহী গ্রাম পরিষদগুলোর জন্য যে জাতীয় নিয়মাবলি রয়েছে তাতে বলা হয়েছে, যে সব সিটের এক তৃতীয়াংশ এবং কিছু ক্ষেত্রে অর্ধেক নারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। এর উদ্দেশ্য ছিল, নারী নেতৃত্বের একটি প্রজন্মকে সামনের কাতারে নিয়ে আসা এবং পরিষদগুলোকে নারীদের চাহিদার সঙ্গে আরও সামঞ্জস্যপূর্ণ করা।
তবে এই আইনের উদ্দেশ্য প্রায়ই উপেক্ষিত হয়, যদিও শুধু সেটির লিখিত অংশ অনুসরণ করা হয়। যে নারীদের পঞ্চায়েত পদে থাকার কথা, তারা শেষ পর্যন্ত তাদের স্বামীর সহকারী হিসেবে কাজ করেন; যারা নির্বাচিত পুরুষদের সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগি করেন। হিন্দিতে এক পরিচিত শব্দ রয়েছে, 'প্রধান পতি', যা এই 'বস স্বামী' ভূমিকার জন্য ব্যবহার করা হয়।
ভারতকে নারী ক্ষমতায়ন ক্ষেত্রে আরও অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে। সংসদে মাত্র ১৫ শতাংশ সদস্য নারী এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ৩০ সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রিসভায় মাত্র দুইজন নারী সদস্য রয়েছেন। ২০২৩ সালে সরকার একটি সাংবিধানিক সংশোধনী অনুমোদন করেছে, যাতে সংসদের এক তৃতীয়াংশ সিট নারী সদস্যদের জন্য সংরক্ষিত থাকে। তবে এটি কার্যকর হতে অন্তত চার বছর লাগবে।
অনেক নারী জাতীয় রাজনীতিতে পরিচিতি পেয়েছেন। তবে তা পঞ্চায়েত আসনের মাধ্যমে নয়, বরং প্রতিষ্ঠিত পুরুষ রাজনীতিকদের সঙ্গে সম্পর্কের সূত্রে।
প্যারাস্বরা গ্রামে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত পুরুষরা ছয় নারীর অনুপস্থিতি নিয়ে রক্ষণাত্মক অবস্থান নিয়েছেন। তাদের একজন বহল রাম সাহু পরে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, তিনজন নারী অসুস্থ ছিলেন আর বাকি তিনজন সেদিন একটি শেষকৃত্যে অংশ নিতে গিয়েছিলেন। অন্য প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য কিছুটা ভিন্ন ছিল। তবে সবাই সাহুর সঙ্গে একমত ছিলেন, কখনো কখনো স্বামী তার স্ত্রীর জায়গায় দাঁড়ান, এবং 'এতে দোষের কিছু নেই।'
গত ১৫ বছরে সাহুর স্ত্রী রাম বাই তিনবার প্যারাস্বরার পঞ্চায়েতে নির্বাচিত হয়েছেন এবং একবার প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে সাহু বলেন, 'স্বামী হিসেবে আমি সবসময় তার পাশে থাকি।' তিনি জানান, স্ত্রীকে সব বিষয়ে পরামর্শ দেন এবং যখনই তিনি অনুপস্থিত থাকেন, তখন তার হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন।
নারীর ক্ষমতাপ্রাপ্ত স্বামীর প্রতিনিধি হয়ে ওঠার বিষয়টি কল্পকাহিনীতেও জায়গা পেয়েছে। জনপ্রিয় আমাজন প্রাইম সিরিজ পঞ্চায়েত-এ দেখা যায়, এক গ্রামের স্থানীয় প্রধান খাটিয়ায় বসে থেকে সব সিদ্ধান্ত দেন। অথচ তার স্ত্রী শুধু নামমাত্র দায়িত্ব পালন করেন।
এই সমস্যাটির কথা দেশটির সরকারও স্বীকার করেছে। ২০২৩ সালে সরকার এক প্রতিবেদন তৈরির নির্দেশ দেয়, যার উদ্দেশ্য ছিল 'প্রতিনিধিত্বমূলক অংশগ্রহণ বন্ধ করা'। গত মাসে এটি এমন স্বামীদের বিরুদ্ধে 'দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি' প্রস্তাব করেছে, যারা তাদের স্ত্রীর ভূমিকা দখল করে নেন।
এমনকি পঞ্চায়েত সিরিজও এই পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছে। কাহিনি এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখা যায়, স্ত্রী আসলে বুদ্ধিমান ও সক্ষম এবং আইনি ক্ষমতা প্রয়োগের উপায় খুঁজে নেন। এখন শো-এর নির্মাতারা সরকারের সঙ্গে মিলে একটি নতুন পর্বের পরিকল্পনা করছেন, যার শিরোনাম 'আসল বস কে?'— যেখানে দেখা যাবে, শেষ পর্যন্ত নারীর হাতেই ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ।
ভারতের অন্য অঞ্চলেও বাস্তব জীবনে উৎসাহজনক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। পাঞ্জাব রাজ্যে শেশানদ্বীপ কউর সিধু মাত্র ২২ বছর বয়সে তার গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান হন। বর্তমানে ২৯ বছর বয়সী সিধু রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন এবং গ্রামের জন্য কিছু করার দৃঢ় সংকল্প নিয়েছেন।
নারীদের জন্য সংরক্ষিত একটি আসনে জয়ের পর, তিনি শিক্ষা ও স্যানিটেশন সমস্যাগুলোর সমাধানের দিকে নজর দেন। তবে তিনি প্রতিরোধের মুখে পড়েন। স্মৃতিচারণ করে বলেন, "আমি তখন খুবই ছোট ছিলাম, আর সবাই ভাবত– এই মেয়ে আর কী করতে পারবে?'"
সিধুর বিশ্বাস, ভারতের প্রতিটি পঞ্চায়েতে নির্বাচিত প্রতিটি নারীর নিজের এবং অন্যান্য নারীদের জন্য দৃঢ়ভাবে দাঁড়ানো উচিত এবং রাজ্য যে ক্ষমতা তাদের দিয়েছে, তা যথাযথভাবে ব্যবহার করা উচিত। তার মতে, নারীদের 'অবিচল থাকতে হবে' এবং 'নিজেদের মতামত স্বামীদের কাছে স্পষ্টভাবে তুলে ধরতে হবে।'
তিনি বলেন, 'আমাকে বলা হয়েছিল, রাজনীতি মেয়েদের জন্য ভালো কিছু নয়।' তাই তিনি প্রতীকীভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে মনস্থির করেন।
গ্রামে যেসব পরিবারের প্রধান নারী, তিনি সেসব বাড়ির বাইরে নামফলক টানানোর ব্যবস্থা করেন। আগে এসব বাড়ি শুধু বাবা, ভাই বা স্বামীর মতো পুরুষ আত্মীয়দের নামেই পরিচিত ছিল, এমনকি তারা মৃত হলেও। এখন প্রতিটি বাড়ির সামনে প্রকৃত নারী প্রধানের নাম শোভা পাচ্ছে।
অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়