দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর রাজধানীর পথেই থাকার অধিকার পেল ভারতের ১০ লাখ বেওয়ারিশ কুকুর

ভাত আর ডাল দিয়ে তৈরি খিচুড়ির দুটি বড় ব্যাগ হাতে নিয়ে নয়াদিল্লির এক মহল্লায় হাজির হন হিমাংশী ভার্মা। ভারতের রাজধানীর কোলাহলের মাঝে শুরু হয় তার প্রতি সন্ধ্যার চেনা রুটিন।
খিচুড়ির সেই চেনা গন্ধে একে একে ঘুম ভাঙে পায়ে সামান্য খোঁড়া ভাব নিয়ে উদ্যমী 'ধলু'র, পাকা চুলে বয়সের ছাপ স্পষ্ট 'ওল্ডি'র, পেটে আলতো আদর বুলিয়ে দেওয়া যার বড্ড পছন্দের; আর সোনালী চোখের 'স্নুপি', যে ধৈর্যের সঙ্গে নিজের ভাগের জন্য অপেক্ষা করে।
এভাবেই দীর্ঘ সাত বছর ধরে এই শহরের বেওয়ারিশ কুকুরদের খাইয়ে আসছেন হিমাংশী। এই যাত্রার শুরু হয়েছিল তার নিজের বাড়ির সিঁড়ির নিচে জন্ম নেওয়া একটি কুকুরছানাকে দত্তক নেওয়ার পর থেকে।
নিজের জমানো টাকা খরচ করে তিনি ৫০০টিরও বেশি প্রাণীকে স্টেরিলাইজ (বন্ধ্যাকরণ) করিয়েছেন এবং আরও শত শত কুকুরের জন্য বাড়ির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।
তবে একটা সময় ছিল, যখন হিমাংশীর এই প্রতিদিনের ভালোবাসার কাজে নেমে এসেছিল হতাশার ছায়া।
গত ১২ই আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের একটি আদেশে বলা হয়, নয়াদিল্লির রাস্তা আর বেওয়ারিশ কুকুরদের অবাধ বিচরণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে না। শিশুদের কামড়ে মেরে ফেলার মতো কিছু উদ্বেগজনক ঘটনার রিপোর্টের পর আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে এই বিষয়টি আমলে নেয়।
আদেশে বলা হয়েছিল, রাজধানীর সমস্ত বেওয়ারিশ কুকুরকে আট সপ্তাহের মধ্যে ধরে নিয়ে গিয়ে স্থায়ীভাবে আশ্রয়কেন্দ্রে আটকে রাখতে হবে।

এই ঘোষণায় পশুপ্রেমী এবং প্রাণী কল্যাণ সংস্থাগুলোর মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তারা যুক্তি দেখান, শহরের প্রায় ১০ লক্ষ বেওয়ারিশ কুকুরকে আশ্রয় দেওয়ার মতো পরিকাঠামো দিল্লির নেই।
কিন্তু গেল শুক্রবার তারা খানিকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। একটি বিশেষ তিন বিচারপতির বেঞ্চ পর্যালোচনার পর আদালত তার আগের নির্দেশের ওপর স্থগিতাদেশ জারি করে এবং একটি সংশোধিত রায় দেয়।
নতুন রায়ে স্পষ্ট করে বলা হয়, কর্তৃপক্ষ প্রথমে বেওয়ারিশ কুকুরদের ধরে নিয়ে গিয়ে স্টেরিলাইজ ও টিকা দেবে এবং তারপর যে এলাকা থেকে তাদের ধরা হয়েছে, সেখানেই আবার ছেড়ে দেবে। শুধুমাত্র জলাতঙ্কগ্রস্ত বা অতিরিক্ত আক্রমণাত্মক বলে প্রমাণিত প্রাণীদেরই রাস্তা থেকে সরানো হবে।
আদালত জানিয়েছে, এই রায় সমগ্র ভারতের জন্য প্রযোজ্য হবে। একই সঙ্গে, প্রকাশ্যে কুকুরকে খাবার বিতরণের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে এবং তাদের খাওয়ানোর জন্য নির্দিষ্ট এলাকা তৈরির আহ্বান জানানো হয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০২৩ সালে হায়দ্রাবাদে চার বছর বয়সী একটি শিশুকে একদল কুকুর নির্মমভাবে আক্রমণ করে মেরে ফেলার পর কুকুরের আক্রমণ নিয়ে ভয়াবহ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সিসিটিভিতে ধারণ করা সেই দৃশ্য সারা দেশকে নাড়িয়ে দেয় এবং গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক মহলে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি করে।
২০২৩ সালেই ভারতে প্রায় সাড়ে ৩০ লক্ষ কুকুর কামড়ানোর ঘটনা ঘটে, যার ফলে ২৮৬ জনের মৃত্যু হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, মানুষের জলাতঙ্ক-জনিত মৃত্যুর বেশিরভাগই কুকুরের মাধ্যমে ঘটে থাকে এবং মানুষের মধ্যে প্রায় ৯৯ শতাংশ সংক্রমণই কুকুরদের দ্বারা হয়। সংস্থাটি আরও জানায়, বিশ্বে এই রোগে মোট মৃত্যুর ৩৬ শতাংশ ভারতেই ঘটে।