বাণিজ্যে ট্রাম্পের আক্রমণের শিকার কোন দেশ কী করছে

বিশ্ব বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু হতে চেয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আমদানির ওপর শুল্ক আরোপ করে প্রভাব ফেলতে চেয়েছিল বিশ্ব বাণিজ্যের ওপর। আমেরিকার ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ জামিসন গ্রিয়ারও তাই মনে করেন। তিনি বলেন, 'ট্রাম্প রাউন্ড' নামে পরিচিত বাণিজ্য আলোচনার রাউন্ডটি মূলত আমেরিকাকে বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে পুনঃস্থাপনের উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল।
আমেরিকার এ ইচ্ছার প্রমাণ মেলে ট্রাম্পের উপদেষ্টা পিটার নাভরোর কথায়ও। তিনি মনে করেন, ট্রাম্প দেখিয়েছেন বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাজার কিভাবে বৈশ্বিক বাণিজ্যকে তার ইচ্ছায় প্রভাবিত করতে পারেন এবং এর জন্য তাকে অর্থনীতি নোবেল পুরস্কার দেওয়ারও দাবি জানান। হোয়াইট হাউস বিশ্বাস করে, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডাব্লিউটিও) পুরোনো ব্যবস্থা ভেঙে নতুন ব্যবস্থা চালু করা সম্ভব আর এর কেন্দ্রবিন্দু হবে আমেরিকা।
তবে বাস্তবে বিশ্ব বাণিজ্যে আমেরিকার প্রভাব কমতে শুরু করেছে। ২১ শতকের শুরুতে আমেরিকা যেখানে বৈশ্বিক আমদানি বাণিজ্যের ২০ শতাংশ দখল করে ছিল। সেখানে এখন মাত্র তারা ১২.৫ শতাংশ দখল করে আছে। আমেরিকার বর্ধিত শুল্কের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে তারা ও বাণিজ্য জারি রাখতে তারা ট্রাম্পের সঙ্গে শুল্প চুক্তিতে যাচ্ছে, তারপরও তারা এর বিকল্প পথও খুঁজছে।
এ বিষয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার এক কর্মকর্তা বলেন, 'প্রথম ধাপ হলো আমেরিকাকে ছাড় দেওয়া। দ্বিতীয় ধাপ হলো অন্যত্র দেখা।'
বিশ্বজুড়ে দেশগুলো পুরো অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থেকে মুক্তি পেতে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করছে। কয়েকটি দেশ নিজেদের অভ্যন্তরীণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভূর্তকি ও সুরক্ষামূলক বিভিন্ন নীতির মাধ্যমে সমর্থন দেওয়ার চেষ্টা করছে। আবার কেউ কেউ নতুন বাজার খুঁজছে। আর সবচেয়ে সাহসী দেশগুলো আমেরিকার প্রভাব মোকাবেলায় জোট তৈরি করছে। অনেক দেশের জন্য বিকল্পটি ওয়াশিংটনের প্রতি আনুগত্য না করা বা সম্পূর্ণ নিজের মতো চলা নয়। বরং স্বল্পমেয়াদী সমাধান বনাম দীর্ঘমেয়াদী বিকল্পের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেওয়া।
ট্রাম্পের শুল্ক নীতি ও করের দীর্ঘস্থায়ী প্রকৃতির কারণে, বাণিজ্যযুদ্ধের ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য অর্থ অপচয় ও বাজারের বিকৃতি ঘটতে পারে।
ব্রাজিল ইতোমধ্যেই ৬ বিলিয়ন ডলারের ক্রেডিট প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এ প্যাকেজের মধ্যে কর ছাড় ও ক্রয় নিশ্চয়তা উভয়ই নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু জনস্বাস্থ্য বাজেট চাপে থাকায় বিনিয়োগকারীরা শঙ্কিত।
কানাডা প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দিয়ে কাঠ শিল্পকে সহায়তা করার জন্য প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় রপ্তানিকারীদের শিপিং খরচ সমন্বয় ও যৌথ অবকাঠামো নির্মাণের নীতি প্রস্তাব করেছে। এটি অ্যান্টিট্রাস্ট নিয়ম অতিক্রম করলেও করা হচ্ছে।
অন্যান্য দেশ আরও সরাসরি পদক্ষেপ নিচ্ছে। কানাডা ও জাপান নতুন শুল্ক আরোপ করছে ধাতু আমদানি উপর। একদিকে, ভারত তার 'মেড ইন ইন্ডিয়া' কর্মসূচিতে জোর দিচ্ছে। ১৫ আগস্ট দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আত্মনির্ভরশীল হওয়ার কথা বলেছেন। তিনি জ্বালানি থেকে যুদ্ধবিমান পর্যন্ত সব ক্ষেত্রে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার কথা বলেছেন। তিনি ঘোষণা দেন, 'যদি আমরা স্থানীয় পণ্যের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকি, আমরা সমৃদ্ধি অর্জন করব।'
যদিও এখন পর্যন্ত ট্রাম্পের বিরুদ্ধে কেউ তেমন কোনো প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ নেয়নি। তবে ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে, সবাই সুরক্ষাবাদ অনুকরণ করা শুরু করলে সবার জন্যই খরচ বাড়বে।
এদিকে নতুন বাজার খোঁজার প্রচেষ্টা আরও আশাব্যঞ্জক। এশিয়া থেকে আফ্রিকা পর্যন্ত দেশগুলো তাদের কোম্পানিগুলোকে বিদেশে পাঠানোর জন্য রপ্তানি তহবিল ও প্রণোদনা দিয়ে উৎসাহিত করছে। উদাহরণস্বরূপ, সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ কোরিয়া ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোকে অর্থায়ন করছে যাতে তারা দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও মেক্সিকোতে ব্যবসায়িক সুযোগ খুঁজে বের করতে পারে।
কিছু দেশ ইতিমধ্যেই তাদের বাণিজ্য পুনঃনির্দেশিত করছে। দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষকরা চীনে আরও বেশি পণ্য পাঠাচ্ছে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নকে তার সাইট্রাস-স্বাস্থ্য নীতি সহজ করতে চাপ দিচ্ছে। লেসোথোর গার্মেন্টস প্রস্তুতকারকরা—যারা আগে গ্যাপ ও লেভির মতো আমেরিকান প্রতিষ্ঠানের জন্য তৈরি হতো—এখন আঞ্চলিক ক্রেতাদের দিকে নজর দিচ্ছে এবং এশিয়ায় চাহিদা যাচাই করছে। ব্রাজিলের কফি রপ্তানিকারীরা, যাদের উপর ৫০ শতাংশ আমেরিকান শুল্ক আরোপিত হয়েছে, উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে চালান বাড়াচ্ছে, যেখানে গত বছর বিক্রির পরিমাণ তিন-পঞ্চমাংশ বেড়েছে।
তবে এমন বৈচিত্র্যের মধ্যেও আমেরিকার বিকল্প তৈরি করা সহজ নয়; ব্রাজিলের কফির এখনও ১৬ শতাংশ আমেরিকায় যাচ্ছে, তাই সম্পূর্ণ পরিবর্তন করতে সময় লাগবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো নতুন জোট। আমেরিকার দুই প্রতিবেশী ও ইউএস-মেক্সিকো-কানাডা চুক্তির (ইউএসএমসিএ) অংশীদার কানাডা ও মেক্সিকো ধীরে ধীরে আরও ঘনিষ্ঠ হচ্ছে, কারণ আমেরিকা কম নির্ভরযোগ্য হয়ে উঠেছে। আগামী মাসে কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি মেক্সিকো সফরে যাবেন, যেখানে তিনি সরবরাহ চেইনের স্থিতিশীলতা, বন্দর থেকে বন্দরে বাণিজ্য এবং জ্বালানি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা খাতে যৌথ উদ্যোগ নিয়ে আলোচনা করবেন। আগামী বছরে ইউএসএমসিএ চুক্তি পর্যালোচনার সময় এ দুই দেশ এমন সমন্বয় করতে চাচ্ছে যা তারা ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনা করার সময় ব্যবহার করতে পারবে।
ব্রিকসের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলো ট্রাম্পের শুল্কের লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে। সর্বশেষ ট্রাম্প ব্রাজিল ও ভারতের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা (লুলা) জোটগঠনের জন্য সক্রিয়ভাবে যোগাযোগ করছেন। ৭ আগস্ট তিনি এবং মোদি আরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে ডিজিটাল পেমেন্ট সংযোগ, যা আমেরিকান ব্যাংকের প্রভাব কমাতে সাহায্য করবে। এর চার দিন পরে লুলা চীনের প্রধানমন্ত্রী শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বাণিজ্য সম্প্রসারণ নিয়ে কথা বলেন। শি ঘোষণা করেন, ব্রাজিলের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক "ইতিহাসের সর্বোত্তম পর্যায়ে" আছে।
বাণিজ্যের ক্ষেত্রে, ব্রিকসের দেশগুলো আমেরিকার উপর খুব বেশি নির্ভরশীল নয়। আমেরিকা ভারতীয় পণ্যের মাত্র এক-ষষ্ঠাংশ এবং ব্রাজিলীয় পণ্যের এক-সপ্তাংশ কিনে, যা দুই দশক আগে এক চতুর্থাংশ ছিল। একটি গোষ্ঠী হিসেবে, ব্রিকসের সদস্যরা এখন একে অপরের সঙ্গে আমেরিকার চেয়ে বেশি পণ্য বাণিজ্য করছে এবং ফাঁক আরও বাড়ছে। থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামসহ এক ডজনের বেশি এর অংশ হওয়ার জন্য আবেদন করেছে।
নতুন জোট থেকে সবচেয়ে বড় লাভবান হতে পারে চীন। ২০১৫ সাল থেকে চীনের বৈশ্বিক রপ্তানি দক্ষিণে দ্বিগুণ হয়েছে—এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, লাতিন আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে এটি আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপের তুলনায় বেশি বিক্রি করছে। জুলাইয়ে আমেরিকায় রপ্তানি ধসে গেলেও, মোট রপ্তানি গত বছরের তুলনায় ৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
ট্রাম্পের শুল্ক এই সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করেছে। জুনে শি জিনপিং আফ্রিকা থেকে আমদানি প্রায় সব শুল্ক প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি দেন এবং লাতিন আমেরিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নেতাদের সঙ্গে শীর্ষ বৈঠকে অংশ নিচ্ছেন। চীন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া দেশের সমিতি (আসিয়ান)—যেখানে বিশ্বের এক চতুর্থাংশ মানুষ এবং মোট জিডিপির এক-পঞ্চমাংশ রয়েছে—তাদের মুক্ত-বাণিজ্য চুক্তি পুনর্গঠন করছে, যা বছরের শেষের মধ্যে অনুমোদিত হবে। এদিকে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কও শিথিল হচ্ছে। ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুললো চীনা অংশীদারদের সঙ্গে বৈদ্যুতিক যানবাহন ও ব্যাটারিতে যৌথ প্রকল্প চালুর বিষয়ে অনুসন্ধান চালাচ্ছে। এই মাসে মোদি সাত বছর পরে প্রথমবার চীনে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
ট্রাম্প চাইছিলেন আমেরিকা বিশ্ব বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু হোক। কিন্তু বিষয়গুলো পরিকল্পনা অনুযায়ী হচ্ছে না।