১৯৫২ সালে ওয়াশিংটনের আকাশে ইউএফও-র পিছু নিয়েছিল যুদ্ধবিমান; ৭০ বছরেও অমীমাংসিত যে রহস্য
সময়টা ১৯৫২ সাল। যুক্তরাষ্ট্রের ডেলাওয়্যারের নিউ ক্যাসল এয়ার ফোর্স বেসের সেই রাতটি ছিল গুমোট ও উষ্ণ। পাইলটদের সার্বক্ষণিক প্রস্তুত থাকার রুটিন অনুযায়ী, ১৪২তম ফাইটার ইন্টারসেপ্টর স্কোয়াড্রনের লেফটেন্যান্ট উইলিয়াম এল. প্যাটারসন রানওয়ের একেবারে কাছেই অবস্থান করছিলেন। নিয়ম ছিল, ইঞ্জিন সব সময় গরম রাখা—যাতে নির্দেশ পাওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই আকাশে ওড়া যায়। মধ্য-আটলান্টিক উপকূলে সোভিয়েত বোমারু বিমান ঢুকে পড়তে পারে—এই সামান্যতম আশঙ্কাকেও মাথায় রেখেই তারা সতর্ক অবস্থায় ছিলেন।
হঠাৎই নির্দেশ আসে—হোয়াইট হাউস ও পেন্টাগনের ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া কয়েকটি অজানা বস্তু আটকাতে হবে। ওয়াশিংটন ন্যাশনাল এয়ারপোর্ট এবং অ্যান্ড্রুস এয়ার ফোর্স বেসের রাডার স্ক্রিনে এমন কিছু লক্ষ্যবস্তু ধরা পড়ছিল, যেগুলো কেউ শনাক্ত করতে পারছিল না। সেই রহস্যময় বস্তুগুলো নিষিদ্ধ আকাশসীমায় অবাধে বিচরণ করে যেন প্রকাশ্যেই এক ধরনের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছিল।
সে সময় পুরো যুক্তরাষ্ট্রে মানুষের দৃষ্টি ছিল আকাশের দিকে। একদিকে কমিউনিজমের আতঙ্ক, অন্যদিকে দীর্ঘস্থায়ী কোরীয় যুদ্ধ—সোভিয়েত হামলার ভয় মানুষের মনে গভীরভাবে বাসা বেঁধেছিল। ১৯৫২ সালে দেশটিতে ইউএফও দেখার ঘটনা আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়, যা আকাশপথে হামলার আশঙ্কাকে আরও উসকে দেয়। ঠিক এক সপ্তাহ আগেই রাডার অপারেটর ও বাণিজ্যিক বিমানের পাইলটরা দেশের রাজধানীর আকাশে এমন কিছু অদ্ভুত বস্তু দেখার কথা জানান, যেগুলোর গতিবিধি ছিল সে সময়ের যেকোনো বিমানের তুলনায় অনেক বেশি উন্নত ও রহস্যময়।
দীর্ঘ কয়েক প্রজন্ম ধরে এসব ঘটনাকে মূলত স্নায়ুযুদ্ধকালীন এক ধরনের ভৌতিক গল্প হিসেবেই দেখা হয়েছে। তবে ২০২৫ সাল যখন শেষের পথে, তখন মার্কিন আকাশে আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশিসংখ্যক পাইলট এমন রহস্যময় অভিজ্ঞতার কথা জানাচ্ছেন। 'আমেরিকানস ফর সেফ অ্যারোস্পেস' নামের একটি অলাভজনক সংস্থা পাইলটদের এসব অভিজ্ঞতা গোপনে জানানোর সুযোগ করে দিচ্ছে।
বর্তমানে রহস্যময় বস্তু দেখার এই নতুন হিড়িক আবারও সামনে নিয়ে এসেছে সেই একই অমীমাংসিত প্রশ্নগুলো, যা সত্তর বছরেরও বেশি সময় আগে এক অন্ধকার রাতে প্যাটারসনকে হঠাৎ ঝড়ের বেগে আকাশে উড়তে বাধ্য করেছিল।
চারদিক থেকে ঘেরা
১৯৫২ সালের ২৬ জুলাই রাতের শেষ প্রহর। প্যাটারসন এবং তার সহকর্মী পাইলট ক্যাপ্টেন জন ম্যাকহুগো—যাদের সাংকেতিক নাম ছিল 'শার্লি রেড ১' ও 'শার্লি রেড ২'—এফ-৯৪ জেট বিমান নিয়ে অন্ধকারের বুক চিরে উড্ডয়ন করেন। রানওয়েতে ইঞ্জিনের সাদা শিখা জ্বালিয়ে তারা অজানার উদ্দেশে দক্ষিণমুখী হন।
ঠিক এক সপ্তাহ আগের ঘটনার মতোই, ডিসি এয়ারপোর্টের কন্ট্রোলাররা রাডার স্ক্রিনে ১০০ মাইলজুড়ে কয়েক ঘণ্টা ধরে লক্ষ্য করছিলেন কিছু অজানা বস্তু—যেগুলো কখনো নিচে নামছে, কখনো থেমে যাচ্ছে, আবার কখনো অদৃশ্য হয়ে ফিরে আসছে। অ্যান্ড্রুস এয়ার ফোর্স বেসের সহকর্মীরাও নিশ্চিত করেন, তারাও একই বস্তু লক্ষ্য করছেন।
অপারেটরদের ভাষ্য অনুযায়ী, বিন্দুগুলো দেখতে বিমানের মতো হলেও ওই এলাকায় সে সময় কোনো পরিচিত বিমানের উড্ডয়নের তথ্য ছিল না।
২০ হাজার ফুট উচ্চতায় উড়ে ন্যাশনাল এয়ারপোর্টের কাছে পৌঁছালে কন্ট্রোলাররা প্যাটারসনকে অ্যান্ড্রুসের কাছাকাছি অবস্থান করা লক্ষ্যবস্তুগুলোর দিকে যেতে নির্দেশ দেন। সামনে ছিল ঘুটঘুটে অন্ধকার। প্যাটারসন কেবল বিমানের যন্ত্রপাতির আবছা আলো আর দিগন্তের ঝাপসা সীমারেখা দেখতে পাচ্ছিলেন।
হঠাৎই তিনি সেগুলো দেখতে পান। তার সামনে প্রায় ১০ মাইল দূরে, কিছুটা ওপরে, চারটি উজ্জ্বল আলো জ্বলে ওঠে। তবে সাধারণ বিমানের আলোর মতো সেগুলো মিটমিট করছিল না; বরং যেন স্থির হয়ে অপেক্ষা করছিল।
প্যাটারসন কন্ট্রোলারদের তার দেখা দৃশ্য জানিয়ে বিমানের গতি বাড়ান। তখন তার যুদ্ধবিমানটি ঘণ্টায় প্রায় ৬০০ মাইল বেগে ছুটছিল।
রাডার স্ক্রিনে কন্ট্রোলাররা দেখতে পাচ্ছিলেন, প্যাটারসন যতই এগোচ্ছেন, রহস্যময় বস্তুগুলো ততই তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। পরিচিত কোনো বিমানের পক্ষে অসম্ভব—এমন সব অদ্ভুত কৌশল প্রদর্শন করছিল সেগুলো। মুহূর্তের মধ্যেই পেছনে ফিরে আসা, শূন্যে স্থির হয়ে থাকা, হঠাৎ ৯০ ডিগ্রি কোণে মোড় নেওয়া এবং অবিশ্বাস্য গতিতে চোখের আড়ালে মিলিয়ে যাওয়ার দৃশ্য রাডারে ধরা পড়ছিল।
প্যাটারসন কাছে পৌঁছানোর আগেই আলোগুলো তাদের বিন্যাস ভেঙে ফেলে তার বিমানের চারপাশ ঘিরে ধরতে শুরু করে। টাওয়ারের রাডার স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছিল, লক্ষ্যবস্তুগুলো প্যাটারসনের অবস্থানের একেবারে কাছাকাছি চলে এসেছে। ককপিটের ভেতরে 'শার্লি রেড ১' হঠাৎই এক অন্ধ করা তীব্র আলোয় ঢেকে যায়।
'ওরা আমাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরছে,' আতঙ্কিত কণ্ঠে রেডিওতে কন্ট্রোলারদের জানান তিনি। 'আমি এখন কী করব?'
কোরীয় যুদ্ধের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এই পাইলট আসলে জানতে চাইছিলেন—তার বিমান ঘিরে ধরা ওই আলোগুলোর দিকে তিনি গুলি চালাবেন কি না।
কিন্তু ওপাশ থেকে তাৎক্ষণিক কোনো জবাব আসেনি। বিভিন্ন বর্ণনা অনুযায়ী, টাওয়ারে উপস্থিত কন্ট্রোলার ও সামরিক কর্মকর্তারা বিস্ময়ে তখন কার্যত নির্বাক হয়ে গিয়েছিলেন।
দমবন্ধ করা সেই মুহূর্তে প্যাটারসন একাই ছিলেন ওই আলোগুলোর মাঝে। এরপর যেমন হঠাৎ তারা এসেছিল, তেমনি হুট করেই সেগুলো রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে যায় এবং কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই রাডার থেকে উধাও হয়ে যায়।
প্যাটারসনকে এরপর রাজধানীর আকাশসীমায় থাকা আরও কয়েকটি লক্ষ্যবস্তুর পিছু নিতে বলা হলেও, তিনি পৌঁছানোর আগেই সেগুলো অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিল। টানা এক ঘণ্টা উড্ডয়নের পর জ্বালানি কমে এলে তিনি ঘাঁটিতে ফিরে আসেন। অন্য একটি সেক্টরে অবস্থান করা ম্যাকহুগো চোখে তেমন কিছু দেখতে পাননি এবং তিনিও কিছু সময় পর নিউ ক্যাসলে ফিরে যান।
অপারেটরদের জোর দাবি, তারা কঠিন ধাতব বস্তু শনাক্ত করেছিলেন
এক সপ্তাহ আগে, ১৯ জুলাই ন্যাশনাল এয়ারপোর্টের কন্ট্রোলাররা রাডারে কিছু রহস্যময় বিন্দু শনাক্ত করেন। একই সময়ে অ্যান্ড্রুস ও বলিং এয়ার ফোর্স বেসের পাশাপাশি একটি বাণিজ্যিক বিমানের পাইলটও আকাশে উজ্জ্বল আলোর উপস্থিতি দেখেন। তবে সে যাত্রায় ইন্টারসেপ্টর জেটগুলো কিছুই দেখতে পায়নি, আর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সংবাদমাধ্যমে বিষয়টিকে আবহাওয়াজনিত গোলযোগ বলে উড়িয়ে দেন।
কর্মকর্তাদের দাবি ছিল, বায়ুমণ্ডলের ওপরের স্তরে তাপমাত্রার হঠাৎ পরিবর্তনের ফলে রাডার তরঙ্গ বেঁকে গিয়ে এমন ভ্রান্ত সংকেত তৈরি হয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় সপ্তাহের ঘটনায় সেই আত্মবিশ্বাসে চির ধরে।
সরকারের ইউএফও তদন্তকারী দল 'প্রজেক্ট ব্লু বুক'-এর পরিচালক ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ড রুপেল্ট ২৬ জুলাই রাতে প্রথম জানতে পারেন যে ওয়াশিংটনের আকাশে রহস্যময় বস্তুগুলো আবার ফিরে এসেছে। তদন্তের জন্য পেন্টাগন থেকে নৌবাহিনীর রাডার বিশেষজ্ঞ লেফটেন্যান্ট জন হোলকম্ব ও মেজর ডিউয়ি ফোরনেটকে দ্রুত ন্যাশনাল এয়ারপোর্টের কন্ট্রোল টাওয়ারে পাঠানো হয়।
সেখানে গিয়ে তারা রাডার স্ক্রিনে ডজনেরও বেশি রহস্যময় লক্ষ্যবস্তু ভেসে থাকতে দেখেন। সেই রাতেই তারা নিজের চোখে দেখেন, প্যাটারসনের মতো পাইলটরা কীভাবে ওই অদ্ভুত বস্তুগুলোর পিছু নিচ্ছেন। রাডার বিশেষজ্ঞ হোলকম্ব আবহাওয়া দপ্তরের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হন—সেখানে সামান্য তাপমাত্রার তারতম্য ছিল বটে, কিন্তু তা রাডারে এত শক্তিশালী ও স্পষ্ট সংকেত তৈরি করার মতো যথেষ্ট ছিল না। টাওয়ারের অপারেটররা জোর দিয়ে বলেন, তারা কোনো আবহাওয়াজনিত গোলযোগ নয়; বরং দৃশ্যমান কোনো শক্ত ধাতব বস্তুর গতিবিধি লক্ষ্য করছিলেন।
সংবাদপত্রে উসকে ওঠে গণউন্মাদনা
সোমবার সকালে রুপেল্ট যখন ওয়াশিংটনে পৌঁছান, তখন প্রতিটি বড় সংবাদপত্রের শিরোনাম জুড়ে ছিল 'উড়ন্ত সসার' বা রহস্যময় মহাকাশযান। হোটেলের লবিতেই সাংবাদিকদের প্রশ্নের বন্যায় পড়েন তিনি। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে তথ্য চেয়ে পেন্টাগনে একের পর এক টেলিগ্রাম ও ফোন আসতে থাকে। পেন্টাগন এই জল্পনা থামানোর চেষ্টা করলেও সংবাদপত্রগুলো ভিনগ্রহের প্রাণী নিয়ে চাঞ্চল্যকর প্রতিবেদন ছাপাতে থাকে।
এমনকি আলবার্ট আইনস্টাইনও এ বিষয়ে মত দেন। ১৯৫২ সালের ৩০ জুলাই 'টাইমস হেরাল্ড'-এ প্রকাশিত তার মন্তব্য ছিল, 'ওই মানুষেরা নিশ্চয়ই কিছু দেখেছে। সেটা কী, আমি জানি না; আর তা জানার আগ্রহও আমার নেই।'
টানা দুই সপ্তাহান্তের এই ঘটনাগুলো পরে 'ওয়াশিংটন ফ্ল্যাপ' নামে পরিচিতি পায়। রহস্য নিয়ে জনমনে উত্তেজনা এতটাই তীব্র ছিল যে, সে সময়ের আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কিংবা অলিম্পিক গেমসের খবরও পত্রিকার প্রথম পাতা থেকে প্রায় উধাও হয়ে যায়।
পরদিন পাইলট প্যাটারসন নিজেও সাংবাদিকদের কাছে তার অভিজ্ঞতার কথা জানান। তিনি বলেন, 'আমি বেশ কয়েকটি উজ্জ্বল আলো দেখেছি। বিমানের সর্বোচ্চ গতিতে থাকার পরও সেগুলোর কাছাকাছি পৌঁছাতে পারছিলাম না।'
জনসাধারণের এই চাপ শেষ পর্যন্ত হোয়াইট হাউস পর্যন্ত পৌঁছায়। প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যানের সহকারী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রবার্ট ল্যান্ড্রি রুপেল্টকে ফোন করে ঘটনার বিস্তারিত জানতে চান। পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে এয়ার ফোর্স ইন্টেলিজেন্সের ডিরেক্টর মেজর জেনারেল জন স্যামফোর্ড দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় সংবাদ সম্মেলন ডাকেন।
পেন্টাগনের সেই সম্মেলনে স্যামফোর্ড দাবি করেন, রাডার স্ক্রিনে দেখা বিন্দুগুলো তাপমাত্রার পার্থক্যের কারণেও হতে পারে—সম্ভাবনা 'পঞ্চাশ-পঞ্চাশ'। এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্ন এড়িয়ে যান এবং কিছু গোপন করার অভিযোগ অস্বীকার করেন। তবে লক্ষণীয় বিষয় ছিল, রাডার টাওয়ারে ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী হোলকম্ব ও ফোরনেট ওই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন না।
রহস্য থেকেই যাচ্ছে
এয়ার ফোর্সের আত্মবিশ্বাসী বক্তব্য সে সময় সংবাদমাধ্যমকে কিছুটা শান্ত করতে পেরেছিল। যদিও কর্মকর্তারা প্রকৃতপক্ষে কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। তখনকার সংবাদপত্রগুলো পাঠকদের আশ্বস্ত করেছিল যে, রাডারে ধরা পড়া রহস্যময় বিন্দুগুলো আবহাওয়াজনিত বিভ্রান্তি ছাড়া আর কিছু নয়।
তবে এয়ার ফোর্সের নিজস্ব নথিপত্র ভিন্ন চিত্র তুলে ধরে। পরবর্তী তদন্তে দেখা যায়, ১৯৫২ সালের সেই গ্রীষ্মে ওয়াশিংটনে প্রায় প্রতি রাতেই তাপমাত্রার তারতম্য ঘটত। অথচ রাডারে ওই ব্যাখ্যাতীত সংকেতগুলো মাত্র কয়েকবারই দেখা গিয়েছিল।
প্রজেক্ট ব্লু বুকের পরিচালক রুপেল্ট আরও লক্ষ্য করেন, কিছু পাইলট এগুলোকে আলোর প্রতিফলন বলে মনে করলেও অভিজ্ঞ রাডার অপারেটররা তা মানতে নারাজ ছিলেন। তারা জানতেন, রাডারের ভুতুড়ে সংকেত আর চলমান ও শক্ত ধাতব বস্তুর মধ্যে পার্থক্য কী। তিনটি উন্নত রাডার কেন্দ্র একই লক্ষ্যবস্তুকে একযোগে ট্র্যাক করেছিল এবং প্যাটারসনের মতো পাইলটদের পাঠানোর আগেই তারা নিশ্চিত হয়েছিলেন যে, তাদের যন্ত্রপাতি সঠিকভাবেই কাজ করছে।
শেষ পর্যন্ত, ওয়াশিংটনের সেই ঘটনাগুলোকে এয়ার ফোর্সের প্রজেক্ট ব্লু বুকের নথিতে 'অজানা' হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়। ৭০ বছর পেরিয়েও ওই অদ্ভুত ও দ্রুতগতির আলোগুলোর কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি, বদলায়নি তাদের শ্রেণিবিভাগও। এমনকি ইউএফও গবেষকদের মধ্যেও এ নিয়ে কোনো ঐকমত্য নেই।
প্রখ্যাত ইউএফও গবেষক ও অবসরপ্রাপ্ত সামরিক পাইলট কেভিন র্যান্ডল বলেন, 'আকাশে কিছু একটা ছিলই এবং সেটি কেবল তাপমাত্রার পরিবর্তন ছিল না।' ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত প্রজেক্ট ব্লু বুক ১২,৬১৮টি ইউএফও দেখার ঘটনা তদন্ত করে, যার মধ্যে ৭০১টি আজও অমীমাংসিত—এর অন্যতম ১৯৫২ সালের ওয়াশিংটনের এই ঘটনা।
বর্তমানে পেন্টাগনের 'অল-ডোমেইন অ্যানোমালি রেজোলিউশন অফিস' (এএআরও) এ ধরনের রহস্যময় ঘটনাগুলো নিয়ে আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গবেষণা চালাচ্ছে।
'এটি এমন কোনও সমস্যা নয় যা চলে যাচ্ছে'
আমেরিকানস ফর সেফ অ্যারোস্পেস-এর প্রতিষ্ঠাতা রায়ান গ্রেভস জানান, আজও মার্কিন আকাশে পাইলটরা প্রতিদিন রহস্যময় বস্তু বা ইউএপি দেখতে পান। গ্রেভস বলেন, 'প্যাটারসন সেদিন নিশ্চিত ছিলেন যে তিনি কোনো কিছুর পিছু নিচ্ছেন। তবে আকাশের সেই নিঃসঙ্গ পরিবেশে তার মধ্যে যে মানসিক বিভ্রান্তি ও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল, তা আমি কল্পনা করতে পারি।'
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আজও পাইলটরা একই ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। আধুনিক যন্ত্রপাতি থাকা সত্ত্বেও তারা বুঝতে পারছেন না, এসব রহস্যময় বস্তু আসলে কী। ২০২৫ সালে এই সংস্থাটি ৭০০টিরও বেশি এমন প্রতিবেদন পেয়েছে, যা ২০২৪ সালের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। গ্রেভসের লক্ষ্য, ২০২৬ সালের মধ্যে এ ধরনের ঘটনাগুলো রিপোর্ট করার জন্য একটি আন্তর্জাতিক মানদণ্ড তৈরি করা।
যদিও অনেক সমালোচক এসব ঘটনার পেছনে ড্রোন বা আবহাওয়াজনিত কারণকে দায়ী করেন, এয়ার ফোর্স এখন বলছে—কেউ যদি আকাশে এমন ব্যাখ্যাতীত কিছু দেখতে পান, তবে স্থানীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করা উচিত।
সেদিনের সেই রাত এবং পরবর্তী দিনগুলোতে ঠিক কী ঘটেছিল—তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ পাওয়া গেছে মার্কিন সরকারের অবমুক্ত করা গোপন নথি, আর্কাইভে সংরক্ষিত সংবাদপত্রের প্রতিবেদন, বই এবং গবেষকদের সাক্ষাৎকারভিত্তিক ঐতিহাসিক পর্যালোচনা থেকে।
