দুষিত বাতাস, আবর্জনার স্তূপ… যেসব কারণে ভারতের বড় শহরগুলো বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে
'জয়পুরের রাজকীয় সৌন্দর্য উপভোগ করতে চান? তবে এখানে আসবেন না, বরং একটা পোস্টকার্ড কিনে নিন'—সম্প্রতি উত্তর-পশ্চিম ভারতের এই শহরটি মিয়ে বিদ্রুপের সুরে এভাবেই কথা বলছিলেন এক স্থানীয় ট্যাক্সিচালক।
রাজস্থানের এই রাজধানী শহরটি তার জমকালো প্রাসাদ আর দুর্গের আকর্ষণে পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও কেন এত জরাজীর্ণ দেখাচ্ছে—এমন প্রশ্নের উত্তরেই চালকের কণ্ঠে ফুটে উঠেছিল এক গভীর হতাশা। এই চিত্র কেবল জয়পুরের নয়, বরং ভারতের অনেক শহরেরই চরম বাস্তব। যানজটে স্থবিরতা, বিষাক্ত বাতাস আর যত্রতত্র আবর্জনার স্তূপের পাশাপাশি নিজেদের গৌরবময় ঐতিহ্যের প্রতি চরম উদাসীনতা এখন ভারতের শহরগুলোর সাধারণ বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জয়পুরে কয়েকশ বছরের পুরোনো চমৎকার সব স্থাপত্যের গায়ে যেমন পানের পিকের দাগ দেখা যায়, তেমনি অনেক ঐতিহাসিক স্থাপনার গা ঘেঁষেই গড়ে উঠেছে গাড়ির মেরামতের দোকান।
পুরো দেশজুড়ে আধুনিক অবকাঠামো তৈরির পেছনে কোটি কোটি টাকা খরচ করার পরেও ভারতের শহরগুলো কেন বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ছে, তা নিয়ে বড় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। গত কয়েক বছরে মোদি সরকারের উদ্যোগে ঝকঝকে বিমানবন্দর, অত্যাধুনিক জাতীয় সড়ক এবং মেট্রোরেল নেটওয়ার্ক তৈরি হলেও বসবাসের মানদণ্ডে অনেক শহরই একদম পেছনের সারিতে রয়েছে। গত এক বছরে সাধারণ মানুষের এই ক্ষোভ চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে।
তথ্যপ্রযুক্তির কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত বেঙ্গালুরুতে যানজট আর আবর্জনার স্তূপে অতিষ্ঠ হয়ে সাধারণ নাগরিক থেকে শুরু করে বিশিষ্ট ব্যবসায়ীরাও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। অন্যদিকে, মুম্বাইয়ের নাগরিকরা রাস্তার বেহাল দশা আর গর্তের প্রতিবাদে বিরল আন্দোলনে নামেন। বর্ষাকালে সেখানে নর্দমা উপচে পড়া আবর্জনা আর জলাবদ্ধতা শহরবাসীর জীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে।
প্রতি বছরের মতো এবারও শীতকালে দিল্লিতে বিষাক্ত ধোঁয়াশা দেখা দিয়েছে, যার ফলে শিশু ও বৃদ্ধরা শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে চিকিৎসকরা অনেককে সাময়িকভাবে শহর ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। এমনকি চলতি মাসে ফুটবল তারকা লিওনেল মেসির সফরের সময়ও শহরের দূষিত বাতাসের বিরুদ্ধে ভক্তদের প্রতিবাদ করতে দেখা গেছে।
চীনের মতো দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতি হলেও ভারতের জরাজীর্ণ শহরগুলোর চেহারা কেন বদলানো যাচ্ছে না—এই প্রশ্নটি দিন দিন আরও প্রকট হয়ে উঠছে। উদাহরণ হিসেবে মুম্বাইয়ের কথাই ধরা যায়। নব্বইয়ের দশকে মুম্বাইকে 'সাংহাই' বানানোর যে স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল, তা কেন আজও অধরাই রয়ে গেল?
বিশিষ্ট অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ বিনায়ক চট্টোপাধ্যায় বিবিসিকে বলেন, এর মূল কারণটি ঐতিহাসিক। তার মতে, ভারতের শহরগুলোর জন্য কোনো শক্তিশালী ও নির্ভরযোগ্য শাসন কাঠামো গড়ে ওঠেনি।
তিনি ব্যাখ্যা করেন, ভারতের সংবিধান রচনার সময় কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টনের কথা ভাবা হয়েছিল। কিন্তু শহরগুলো একসময় যে এত বিশাল আকার ধারণ করবে এবং সেগুলো পরিচালনার জন্য আলাদা ও শক্তিশালী প্রশাসনিক কাঠামোর প্রয়োজন হবে—তা তখন কল্পনায়ও আসেনি।
বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে ভারতের প্রায় ৫০ কোটি মানুষ, অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ শহরাঞ্চলে বসবাস করে। ১৯৬০ সালে এই সংখ্যা ছিল মাত্র ৭ কোটি। শহরের জনসংখ্যা যেভাবে বেড়েছে, প্রশাসনিক ব্যবস্থার উন্নয়ন সেভাবে হয়নি।
১৯৯২ সালে সংবিধানের ৭৪তম সংশোধনীর মাধ্যমে শহরগুলোর হাতে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের ক্ষমতা তুলে দেওয়ার একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এর মাধ্যমে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলোকে সাংবিধানিক মর্যাদা দেওয়া হয়।
তবে বিনায়ক চট্টোপাধ্যায়ের মতে, সংশোধনীর অনেক বিধান আজও পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। তাঁর ধারণা, উচ্চপর্যায়ের আমলা ও প্রভাবশালী মহলের অনীহার কারণেই স্থানীয় সংস্থাগুলোর হাতে প্রকৃত ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব পৌঁছায়নি।
এই ক্ষেত্রে চীনের মডেল ভারতের তুলনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন। চীনের শহরগুলোর মেয়রদের হাতে নগর পরিকল্পনা, পরিকাঠামো উন্নয়ন এমনকি বিনিয়োগ অনুমোদনের মতো বিস্তৃত নির্বাহী ক্ষমতা থাকে।
থিংক ট্যাংক 'অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন'-এর রামানাথ ঝা বলেন, চীনে কেন্দ্রীয়ভাবে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হলেও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করে। ভালো কাজের জন্য সেখানে পুরস্কার বা পদোন্নতির ব্যবস্থাও রয়েছে।
ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের তথ্য অনুযায়ী, চীনের বড় শহরগুলোর মেয়ররা কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষ পর্যায়ে যথেষ্ট প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন এবং দক্ষতার সঙ্গে কাজ করলে দ্রুত পদোন্নতিও পান। ফলে শহরের উন্নয়নে তারা সর্বোচ্চ উদ্যোগ নেন।
এর বিপরীতে ভারতের বাস্তবতা তুলে ধরে বিনায়ক চট্টোপাধ্যায় একটি সহজ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তোলেন—'ভারতের বড় শহরগুলোর মেয়রদের নামই বা আমরা কজন জানি?'
লেখক অঙ্কুর বিসেনের মতে, ভারতের শহর পরিচালনাকারী মেয়র ও স্থানীয় কাউন্সিলগুলো রাষ্ট্রের সবচেয়ে দুর্বল অঙ্গ। জনগণের সবচেয়ে কাছাকাছি থাকা সত্ত্বেও তাদেরই মোকাবিলা করতে হয় সবচেয়ে জটিল ও কঠিন সমস্যাগুলো।
তিনি বলেন, 'এসব প্রতিষ্ঠান কার্যত শক্তিহীন—নিজস্ব রাজস্ব আদায়, জনবল নিয়োগ কিংবা তহবিল বরাদ্দের ক্ষেত্রে তাদের ক্ষমতা অত্যন্ত সীমিত। এর বিপরীতে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরাই কার্যত সুপার মেয়র হিসেবে সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন।'
তবে কিছু ব্যতিক্রমী উদাহরণও রয়েছে। নব্বইয়ের দশকে প্লেগ মহামারীর পর সুরাট কিংবা মধ্যপ্রদেশের ইন্দোর শহরের চেহারা আমূল বদলে দেওয়ার পেছনে ছিল রাজনৈতিক মদতপুষ্ট আমলাদের সক্রিয় ভূমিকা।
কিন্তু অঙ্কুর বিসেনের মতে, এসব ঘটনা কোনো দীর্ঘস্থায়ী বা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার প্রতিফলন নয়; বরং নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তির দক্ষতার ফল। ওই কর্মকর্তারা বদলি বা বিদায় নেওয়ার পর অনেক ক্ষেত্রেই সেই ধারাবাহিকতা বজায় থাকে না।
ভঙ্গুর এই শাসনব্যবস্থার পাশাপাশি ভারত আরও কয়েকটি গভীর সংকটের মুখোমুখি। গত ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে দেশে কোনো আদমশুমারি হয়নি। সরকারিভাবে বলা হয়, দেশের ৩০ শতাংশ মানুষ শহরে বাস করে। কিন্তু অনানুষ্ঠানিক হিসাবে ভারতের প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যাই এখন শহুরে বৈশিষ্ট্য ধারণ করেছে।
পরবর্তী আদমশুমারি ২০২৬ সালের আগে হওয়ার সম্ভাবনাও কম। অঙ্কুর বিসেন প্রশ্ন তুলেছেন, নগরায়ণের প্রকৃত বিস্তার ও ধরন সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্য না থাকলে সমস্যার সমাধান শুরু করা সম্ভব কীভাবে?
বিশেষজ্ঞদের মতে, তথ্যের এই ঘাটতি এবং সংবিধানের ৭৪তম সংশোধনীর সঠিক বাস্তবায়ন না হওয়াই ভারতের তৃণমূল পর্যায়ের গণতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়ার ইঙ্গিত দেয়। এ প্রসঙ্গে বিনায়ক চট্টোপাধ্যায় বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, কয়েক বছর আগে দুর্নীতির বিরুদ্ধে যেমন দেশজুড়ে তীব্র জনরোষ তৈরি হয়েছিল, শহরগুলোর এই দুরবস্থা নিয়ে তেমন কোনো জোরালো প্রতিবাদ কেন দেখা যাচ্ছে না?
অঙ্কুর বিসেনের মতে, পরিবর্তন আনতে হলে হয়তো ভারতকে একটি 'উপলব্ধির চক্রের' মধ্য দিয়ে যেতে হবে। তিনি ১৮৫৮ সালের লন্ডনের 'গ্রেট স্টিঙ্ক'-এর উদাহরণ টেনে বলেন, সেই চরম অস্বস্তিকর পরিস্থিতির পরই ব্রিটিশ সরকার শহরের পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা সংস্কারে বাধ্য হয়েছিল, যা পরবর্তী সময়ে কলেরার মতো মহামারি প্রতিরোধে সহায়ক হয়।
তার মতে, পরিস্থিতি যখন একেবারেই সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখনই এসব বিষয় রাজনৈতিক গুরুত্ব পেতে শুরু করে।
