ভারতের ধর্মস্থলার মন্দিরে ধর্ষিতদের গোপন দাফনের অভিযোগকারীকে গ্রেপ্তার

ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের ছোট্ট ধর্মীয় শহর ধর্মস্থলা—যেখানে প্রতিদিন হাজার হাজার ভক্ত আসে শতাব্দী প্রাচীন মঞ্জুনাথ স্বামীর মন্দিরে প্রার্থনা করতে। এমন এক পবিত্র স্থানকে ঘিরে যখন এক ব্যক্তি অভিযোগ করলেন, শত শত নারী ও কিশোরীকে ধর্ষণ ও হত্যার পর তাঁকে নাকি গোপনে মাটিচাপা দিতে বাধ্য করা হয়েছিল, তখন সেটি শুধু একটি অভিযোগই ছিল না; এটি আঘাত হেনেছিল সমাজের নৈতিক ভরকেন্দ্রে। খবর বিবিসির।
কিন্তু সেই একই ব্যক্তি এখন গ্রেপ্তার হয়েছেন 'মিথ্যা সাক্ষ্যদানের' অভিযোগে। ভারতের বিশেষ তদন্ত দল (এসআইটি) দাবি করছে, তিনি আদালতে যেসব বক্তব্য রেখেছেন, তার প্রমাণ মেলেনি। এমনকি যে মানবখুলি তিনি আদালতে জমা দিয়েছিলেন, তা তার উল্লেখিত কবরস্থল থেকে উদ্ধার করা হয়নি। অর্থাৎ, তাঁর দেওয়া তথ্যে অসংখ্য ফাঁকফোকর রয়েছে।
শিবের এক অবতার হিসেবে পূজিত এই দেবতার মন্দির প্রতিদিন হাজার হাজার তীর্থযাত্রীকে আকর্ষণ করে এবং স্থানীয় জনজীবনের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত।
অভিযোগ ঘিরে রাজনৈতিক উত্তেজনা তৈরি হলে রাজ্য সরকার একটি স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম (এসআইটি) গঠন করে। শনিবার (২৩ আগস্ট) সকালে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক এসআইটি কর্মকর্তা বিবিসিকে জানান—অভিযোগকারী ব্যক্তিকে "মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।"

গত জুলাই মাসের শুরুতে মধ্যবয়সী ওই ব্যক্তি থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন এবং একজন ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে গিয়ে সাক্ষ্য দেন। তার পরিচয় গোপন রাখা হয়েছে। প্রকাশ্যে তাঁকে সবসময় কালো পোশাকে, মাথা ঢাকা হুড ও মুখোশ পরিয়ে উপস্থিত করা হয়।
অভিযোগপত্রে, যা বিবিসি দেখেছে, তিনি দাবি করেন ১৯৯৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত মন্দিরে পরিচ্ছন্নতা কর্মী হিসেবে কাজ করেছেন। সেই সময় তাকে শত শত নারী ও কিশোরীর ধর্ষণ ও হত্যার পর লাশ কবর দিতে বাধ্য করা হয়। তিনি পাঁচটি নির্দিষ্ট ঘটনার বর্ণনা দেন এবং বলেন, এর বাইরেও আরও অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। অভিযোগকারীর ভাষ্য অনুযায়ী, ধর্ষণ ও হত্যার শিকার অনেক ভিকটিম-ই ছিল অপ্রাপ্তবয়স্ক বা কিশোরী।
তিনি আরও বলেন, ২০১৪ সাল থেকে আত্মগোপনে ছিলেন এবং বিবেকের তাড়নায় ফিরে এসে এ তথ্য প্রকাশ করেছেন। তবে তিনি কারও নাম উল্লেখ না করে "মন্দির কর্তৃপক্ষ ও এর কর্মচারীদের" অভিযুক্ত করেন। অভিযোগটি মন্দির প্রশাসক সরাসরি "মিথ্যা ও ভিত্তিহীন" বলে প্রত্যাখ্যান করে।
ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করার সময় ওই ব্যক্তি তার ব্যাগ থেকে একটি মানবখুলি বের করে দেখান এবং দাবি করেন, এটি তার কবর দেওয়া এক মৃতদেহের অংশ, যা তিনি সম্প্রতি মাটি খুঁড়ে তুলেছেন। তবে এসআইটি কর্মকর্তা জানান, "তিনি যে খুলি ও হাড়গোড় উপস্থাপন করেছেন, তা কোনোভাবেই ওই স্থানগুলো থেকে উদ্ধার নয়, যেসব স্থানে তিনি দাবি করেছিলেন।"
এই প্রেক্ষাপটে শনিবার তাকে গ্রেপ্তার—পুরো ঘটনায় নতুন মোড় এনে দিয়েছে। এ অভিযোগ ঘিরে ইতিমধ্যেই ব্যাপক মিডিয়া কাভারেজ হয়েছে। রাজ্যের নারী কমিশন যা নিয়ে উদ্বেগ জানালে রাজ্য সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ফৌজদারি তদন্ত শুরু করে এবং এসআইটি গঠন করে।
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে এসআইটি ধর্মস্থলা ও আশপাশের বিভিন্ন স্থানে খননকাজ চালিয়েছে। অভিযোগকারী ১৩টি সম্ভাব্য কবরের জায়গা চিহ্নিত করেছিলেন— যার মধ্যে কিছু স্থান ছিল দুর্গম, ঘন জঙ্গলে ঢাকা। এসআইটির সূত্রে বিবিসি জানিয়েছে, অন্তত দুটি স্থানে মানবদেহের অবশিষ্টাংশ, যার মধ্যে একটি খুলি এবং প্রায় ১০০ টুকরো হাড় পাওয়া গেছে। এগুলো এখন ফরেনসিক পরীক্ষাধীন এবং মৃতদের পরিচয় এখনো জানা যায়নি।
এই অভিযোগ ঘিরে আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছে প্রভাবশালী হেগড়ে পরিবার—যারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মন্দিরের প্রশাসনিক দায়িত্বে রয়েছে।
এই পরিবারের প্রধান হলেন, মন্দিরের প্রধান প্রশাসক ও ভারতীয় রাজ্যসভার এমপি বীরেন্দ্র হেগড়ে, যিনি ২০১৫ সালে দেশটির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান 'পদ্মবিভূষণ' পেয়েছেন। বিবিসিকে দেওয়া বিবৃতিতে তিনি বলেন—"ধর্মস্থলার আশপাশে অস্বাভাবিক মৃত্যুর অভিযোগ তদন্তে সরকার যে এসআইটি গঠন করেছে, মন্দির প্রশাসন তা আন্তরিকভাবে স্বাগত জানাচ্ছে। আমরা তদন্তে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করছি। ভারতের বিচারব্যবস্থা, তদন্ত সংস্থা এবং সংবিধানের ওপর আমাদের পূর্ণ আস্থা রয়েছে।"
পরে ভারতীয় সংবাদ সংস্থা পিটিআই-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি অভিযোগকারীর দাবি "অসম্ভব" বলে উল্লেখ করেন এবং বলেন, "একবারে সত্যটি স্পষ্টভাবে বেরিয়ে আসা উচিত।"
ঘটনাটি নিয়ে রাজনীতিতেও তীব্র বিতর্ক দেখা দিয়েছে। অভিযোগকারীকে গ্রেপ্তার কি সত্যিই 'মিথ্যাচার' উন্মোচন, নাকি প্রভাবশালীদের রক্ষার হাতিয়ার— দেখা দিয়েছে এমন প্রশ্ন।
সদ্য সমাপ্ত রাজ্য বিধানসভা অধিবেশনে বিরোধী বিজেপি নেতারা এটিকে "হিন্দু ধর্মীয় স্থানের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা" হিসেবে অভিহিত করেন। অন্যদিকে রাজ্যে ক্ষমতাসীন কংগ্রেসের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জি. পরমেশ্বরা বলেন, সরকার কাউকে আড়াল করতেও চায় না, আবার কাউকে কলঙ্কিত করতেও চায় না।
তিনি প্রশ্ন রাখেন—"সত্য কি প্রকাশ পাবে না? কিছু না পাওয়া গেলে ধর্মস্থলার মর্যাদা আরও বাড়বে। আর কিছু যদি প্রমাণিত হয়, তবে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে।"