৬০০টির বেশি জলাশয়ে প্রাণ ফিরিয়েছেন তিনি; নজর এবার ভারতের হারিয়ে যেতে বসা প্রাচীন কূপগুলোতে
দিন দিন প্রকট হচ্ছে ভারতের পানির সংকট। এই সংকট মোকাবিলায় এখন কয়েক শ বছরের পুরোনো এক প্রাচীন প্রযুক্তির দিকেই নজর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। মাটির নিচে তৈরি গোলকধাঁধার মতো নকশা করা প্রাচীন এই স্থাপত্যগুলো 'স্টেপওয়েল' বা 'বাওরি' নামে পরিচিত। একসময় হারিয়ে যেতে বসা এই কূপগুলোই এখন দেশটির পানির অভাব মেটানোর বড় সমাধান হয়ে উঠছে।
কয়েক শতাব্দী আগে তৈরি এই কারুকার্যময় কূপগুলো ছিল ভারতীয় জনপদগুলোর প্রাণ। খাওয়ার পানি সংগ্রহ থেকে শুরু করে কৃষিকাজ ও শিল্পকারখানায় ব্যবহারের পানির প্রধান আধার ছিল এসব সোপান-কূপ। শুধু তা-ই নয়, এগুলো স্থানীয় মানুষের মেলামেশার সামাজিক কেন্দ্রও ছিল।
তবে সময়ের বিবর্তনে এই স্থাপত্যগুলো এখন জীর্ণ হয়ে পড়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ ভারতে দ্রুত নগরায়ণ, অযত্ন আর দূষণের কবলে পড়ে এসব অনন্য স্থাপত্যের অনেকগুলোই এখন ধ্বংসের মুখে। কিন্তু ভারতের ভবিষ্যতের পানির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এই প্রাচীন প্রযুক্তিকেই আবার কাজে লাগানোর উদ্যোগ নিয়েছেন এক ভারতীয় পরিবেশকর্মী।
অরুণ কৃষ্ণমূর্তি গত প্রায় ২০ বছর ধরে ভারতের মৃতপ্রায় জলাশয়গুলো পুনরুদ্ধারে কাজ করছেন। তার সংগঠন 'এনভায়রনমেন্টালিস্ট ফাউন্ডেশন অব ইন্ডিয়া' (ইএফআই) ইতিমধ্যে দেশটির ১৯টি রাজ্যের হ্রদ ও পুকুরসহ মোট ৬৫৭টি জলাশয় সংস্কার করেছে। 'রোলেক্স পার্পেচুয়াল প্ল্যানেট ইনিশিয়েটিভ'-এর অংশ হিসেবে এখন তাঁদের বিশেষ নজর এই প্রাচীন সিঁড়িযুক্ত কূপগুলোর দিকে। হারানো এই প্রযুক্তি ফিরিয়ে আনলে ভারতের পানির সংকট অনেকটা কমবে বলে আশা করা হচ্ছে।
অরুণ মনে করেন, প্রাচীন এই কূপগুলো সংস্কার করা তাদের সংগঠনের জন্য এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তিনি বলেন, 'এই ঐতিহাসিক সম্পদগুলো রক্ষা করা আমাদের বড় দায়িত্ব। কারণ, এগুলো মানুষের মেধা ও বুদ্ধিমত্তার এক অনন্য নিদর্শন।'
অরুণ আরও জানান, বড় বড় জলাশয় ও পুকুর সংস্কারের ক্ষেত্রেও তাঁরা পূর্বসূরিদের এই সুনিপুণ কারিগরি জ্ঞানকে কাজে লাগাচ্ছেন। তার মতে, 'এর প্রকৌশল বিদ্যা, ভূমির ব্যবহার, পানির প্রবাহ বোঝা কিংবা পানি ধরে রাখার ক্ষমতা—সবই বিস্ময়কর। বাঁধগুলো কীভাবে দেওয়া হতো, কোথায় তালগাছ লাগানো হতো কিংবা নালাগুলো কীভাবে কাটা হতো—অতীতের এই শিক্ষাগুলোকেই আমরা বর্তমানের সংকট মোকাবিলায় কাজে লাগাচ্ছি।'
মিষ্টি পানির আধার নিয়ে কাজ করার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থাকলেও অরুণ মনে করেন, এই কূপগুলোর সংস্কারের কাজটা বেশ কঠিন ও আলাদা। কারণ, এসব প্রাচীন স্থাপনা সংস্কারে বিশেষ ধরনের ঐতিহ্যগত জ্ঞান এবং নিপুণ কারুকার্যের প্রয়োজন হয়। শুধু সংস্কার করলেই কাজ শেষ হয় না; সংস্কারের পর অনেক সময় দুর্বৃত্তরা এসব স্থাপনার ক্ষতি করে। তাই এগুলোকে আগের অবস্থায় টিকিয়ে রাখাটাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
ইএফআই মূলত যেসব এলাকায় কূপ সংস্কারের উদ্যোগ নেয়, সেখানকার স্থানীয় বিশেষজ্ঞদেরই কাজে লাগায়। বিশেষ করে যাদের বংশপরম্পরায় এই প্রাচীন স্থাপনাগুলো সম্পর্কে গভীর জ্ঞান আছে, তাদেরই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।
সম্প্রতি বেঙ্গালুরুর কাছে দেবনাহাল্লিতে একটি শুকিয়ে যাওয়া সিঁড়িওয়ালা কূপ সংস্কারের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সংস্থাটি। অরুণ জানান, এর পাথুরে কাঠামো এখনো মোটামুটি ঠিকঠাক থাকলেও নান্দনিক কিছু কাজ করা প্রয়োজন। পাশাপাশি কূপটিকে ভবিষ্যতে রক্ষা করার জন্য স্থানীয় বাসিন্দাদের সম্পৃক্ত করা এবং তাদের মধ্যে দায়বদ্ধতা তৈরির ওপরও জোর দেওয়া হচ্ছে।
প্রাচীন সভ্যতার নগর পরিকল্পনায় ভারত একসময় ছিল বিশ্বসেরা। পরিকল্পিত শহর থেকে শুরু করে সুনিপুণভাবে তৈরি সিঁড়িওয়ালা কূপ ও মন্দিরের জলাধারগুলো ছিল তার অনন্য উদাহরণ।
অরুণ বলেন, 'শত শত বছর আগে বিদ্যুৎ ছিল না। মানুষ তখন মূলত ভূ-পৃষ্ঠের পানির ওপর নির্ভর করত। গভীর মাটির নিচ থেকে ধীরে ধীরে পানি তুলে জমা রাখার জন্য তখন এই সিঁড়িওয়ালা কূপ বা মন্দিরের জলাধারগুলো তৈরি করা হয়েছিল।'
চমৎকার সব কারুকার্য খচিত এই জলাধারগুলো মূলত বৃষ্টির পানি ধরে রাখে। এরপর বালি আর পাথরের স্তরে স্তরে সেই পানি প্রাকৃতিকভাবেই পরিশোধিত হয়ে পরিষ্কার ও পানযোগ্য হয়ে ওঠে। কূপে পানির স্তর ওঠানামা করলেও ভেতরে থাকা সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে মানুষ সারা বছর অনায়াসেই পানি সংগ্রহ করতে পারে।
ভারতে পানিকে অত্যন্ত পবিত্র মনে করা হয়। তাই প্রাচীনকালে অনেক কূপই তৈরি করা হয়েছিল অনেকটা 'উল্টো মন্দিরের' আদলে। মহামূল্যবান এই প্রাকৃতিক সম্পদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই এসব কূপের দেয়ালে নানা দেব-দেবীর মূর্তি ও সূক্ষ্ম কারুকার্য ফুটিয়ে তোলা হতো। অরুণ বলেন, শুরুতে এগুলো মাটির নিচে সাধারণ গর্তের মতো থাকলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা স্থাপত্যশৈলীর এক অনন্য নিদর্শনে পরিণত হয়েছে।
তিনি জানান, তার সংগঠন ইএফআই এ পর্যন্ত দুটি সিঁড়িযুক্ত কূপ সংস্কার করেছে। ২০২৬ সালের মধ্যে আরও ছয়টি কূপ সংস্কার করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। ২০২২ সালে রাজস্থানের আলওয়ারে 'মুসি রানী সাগর' নামের একটি প্রাচীন কূপ সংস্কারের কাজ সফলভাবে শেষ করে ইএফআই। এই মহৎ উদ্যোগে তাদের সহযোগী ছিল হিন্দুজা ফাউন্ডেশন, প্রিন্স আলবার্ট টু ডি মোনাকো ফাউন্ডেশন এবং অশোক লেল্যান্ড।
ভারতের প্রাচীনতম পর্বতমালা আরাবল্লীর পাদদেশে এই কূপটির অবস্থান। দীর্ঘ সময় ধরে এটি ছিল আলওয়ার শহরের মানুষের পানির প্রধান উৎস। তবে দীর্ঘদিনের অযত্ন আর অবহেলায় এটি প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। কূপে স্তূপাকার ময়লা-আবর্জনা জমে পানি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছিল এবং প্রাচীন পাথুরে দেয়ালগুলোও খসে পড়ছিল।
ইএফআই এই কূপের অবকাঠামো মেরামত করার পাশাপাশি সব আবর্জনা পরিষ্কার করেছে। এর ফলে এখন সেখানে আগের চেয়ে অনেক বেশি পানি জমা হচ্ছে এবং সেই পানির গুণমানও আগের চেয়ে অনেক উন্নত হয়েছে।
অরুণ মনে করেন, খুব বেশি আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য না নিয়েও কেবল সামান্য কিছু সংস্কারের মাধ্যমেই এসব প্রাচীন স্থাপত্য রক্ষা করা সম্ভব। তবে এর জন্য প্রয়োজন এমন এক দক্ষ কর্মী বাহিনী, যাদের কাছে এই স্থাপত্যশৈলী নিয়ে পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে পাওয়া বিশেষ জ্ঞান রয়েছে।
অরুণ বলেন, 'এসব স্থাপনার পেছনে গভীর বিজ্ঞান লুকিয়ে আছে। তারা যে ধরনের উপকরণ ব্যবহার করেছেন এবং যে দক্ষতার সঙ্গে এগুলো তৈরি করেছেন, তা এক কথায় বিস্ময়কর। এসব শিখতে পারা এবং প্রাচীন কূপগুলো নিয়ে কাজ করা আমার জন্য এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা।'
ভারতের ইতিহাস ও জনপদ বরাবরই পানির ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। উত্তরে হিমালয়ের হিমবাহ থেকে শুরু করে দক্ষিণের বিস্তীর্ণ জলাভূমি—সারা দেশজুড়ে জালের মতো ছড়িয়ে আছে অসংখ্য নদ-নদী। ২ হাজার ৫১০ কিলোমিটার দীর্ঘ গঙ্গা নদীর অববাহিকা বিশ্বের অন্যতম জনবহুল অঞ্চল, যা টিকে আছে কোটি কোটি মানুষের নির্ভরতায়।
অথচ এই গঙ্গা নদীই আজ দূষণে বিপর্যস্ত। অপরিশোধিত পয়োবর্জ্য, কৃষি ও শিল্পকারখানার বর্জ্য প্রতিনিয়ত এই নদীর পানিকে বিষিয়ে তুলছে।
দূষণে নাজেহাল হলেও হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে গঙ্গা অত্যন্ত পবিত্র। তারা বিশ্বাস করেন, এই নদী দেবী গঙ্গারই জাগতিক রূপ। আসলে ভারতে পানির গুরুত্ব কেবল ব্যবহারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে গভীর আধ্যাত্মিক বিশ্বাস। এই জনপদে প্রকৃতির নানা উপাদানের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে ঈশ্বর ও পবিত্রতার ধারণা।
অরুণ বলেন, 'আমাদের সংস্কৃতির বিবর্তনে পানি ও প্রকৃতি পূজা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। আমরা জানতাম পানি ছাড়া জীবন অচল। আমাদের কাছে পানিই ঈশ্বর, পানিই শক্তি। আর আমাদের প্রায় সব উৎসবের উদ্দেশ্যই হলো পানির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা।'
দিল্লি থেকে চেন্নাই—যমুনা নদীর তীর থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত প্রতিদিন এমন সব ধর্মীয় আচার পালিত হয়। এসব উৎসবে প্রতিমা থেকে শুরু করে প্লাস্টিকের ফুল—নানা কিছু পানিতে বিসর্জন দেওয়া হয়। অরুণ মনে করেন, এই রীতিই নদী ও প্রাচীন সিঁড়িওয়ালা কূপগুলোকে দূষিত করছে। তার ভাষায়, 'প্রকৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি এই দায়িত্বহীন আচরণই আমাদের আজকের এই সংকটের মূল কারণ।'
কাজের পথে নানা বাধার কারণে মাঝেমধ্যে হতাশ হয়ে পড়লেও হাল ছাড়তে নারাজ অরুণ। মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে তাঁর সংগঠন ইএফআই স্কুলগুলোতে নানা কর্মসূচি চালাচ্ছে। দেয়ালচিত্রের মাধ্যমেও মানুষকে প্রাচীন এসব স্থাপনা রক্ষায় উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে, যেন তাঁর নিজেরাই এই প্রাণদায়ী স্থাপনাগুলো রক্ষায় এগিয়ে আসেন।
অরুণ বলেন, 'এসব স্থাপনা নিয়ে কাজ করার সুযোগ পাওয়াটাও এক বড় আশীর্বাদ। আমরা আমাদের সর্বোচ্চটা দিয়ে এই কাজ চালিয়ে যেতে চাই।'
