প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টারে হামলার ঘটনায় গ্রেপ্তার ১৭: ডিএমপি
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো ও ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের অফিসে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনায় এখন পর্যন্ত মোট ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)।
আজ সোমবার (২২ ডিসেম্বর) বেলা ১২টায় ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে এই বিষয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) এস এন মো. নজরুল ইসলাম।
নজরুল ইসলাম বলেন, 'কয়েক হাজার লোকজন প্রথমে কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর অফিস এবং পরবর্তীতে ডেইলি স্টার অফিস ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ইত্যাদি চালায়। যা অনাকাঙ্ক্ষিত, অনভিপ্রেত। এটা আমরা কখনোই কাম্য করি না। কিন্তু কতিপয় দুষ্কৃতিকারী সব সময় সুযোগের সন্ধানে থাকে, দেশে একটি অরাজকতা পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টায় থাকে।'
তিনি বলেন, 'কতিপয় লোক কোথাও গ্যাঞ্জাম হলে টাকা-পয়সা, কম্পিউটার ইত্যাদি লুন্ঠনে সেখানে চলে যায়। পুলিশ, সেনাবাহিনী সর্বোচ্চ চেষ্টা করে তাদের নির্বৃত্ত করা যায়নি। এমনকি তারা রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে ফায়ার সার্ভিসের গাড়িও আটকে রেখেছিল।'
তিনি আরো জানান, গণমাধ্যমের ওপর ঘটে যাওয়া এই ন্যক্কারজনক ঘটনায় এখন পর্যন্ত প্রথম আলো মামলা করেছে। ডেইলি স্টারের মামলা প্রক্রিয়াধীন। তারা ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণের পর মামলা করবে।
ডিএমপির এই কর্মকর্তা আরো বলেন, 'ইতোমধ্যে ডিএমপি, ডিবি, সিটিটিসি ও অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ভিডিও ফুটেজ দেখে দুষ্কৃতিকারীদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছে এবং তাদের গ্রেপ্তারের প্রচেষ্টাও অব্যাহত রেখেছি। এখন পর্যন্ত থানা পুলিশ কর্তৃক ১৩ জন, সিটিটিসি কর্তৃক ৩ জন ও ডিবি কর্তৃক ১ জনসহ মোট ১৭ জনকে আমরা গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছি। তাদের বিরুদ্ধে প্যানাল কোড, স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট, সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট, এন্টি টেরোরিজম অ্যাক্ট- এই চারটি আইনে মামলা হয়েছে।'
তিনি আরো বলেন, 'থানা পুলিশ কর্তৃক গ্রেপ্তারকৃত ১৩ জনের মধ্যে মো. নাইমের (২৬) কাছ থেকে টিভি, ফ্রিজ এবং ৫০ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে রয়েছেন- মো. আকাশ আহমেদ সাগর, মো. আব্দুল আহাদ, মো. নজরুল ইসলাম ওরফে মিনহাজ, মো. জাহাঙ্গীর, মো. সোহেল রানা, মো. আব্দুল বারেক শেখ ওরফে আল-আমিন, রাশেদুল ইসলাম, সোহেল রানা, শফিকুল ইসলাম। মো. প্রান্ত শিকদার ওরফে ফয়সাল আহমেদ প্রান্ত, মো. আবুল কাশেম, মো. রাজু হোসাইন- এই তিনজনকে সিটিটিসি কর্তৃক গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মো. সাইদুর রহমানকে ডিবি গ্রেপ্তার করেছে।'
গ্রেপ্তারকতৃদের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় আছে কিনা জানতে চাইলে এস এন মো. নজরুল ইসলাম বলেন, 'আমি তাদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা খুঁজতে চাচ্ছি না। আমি খুঁজতে চাচ্ছি, তারা দুষ্কৃতিকারী, আইন ভঙ্গ করেছে, আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছে। দেশের প্রচলিত আইনে তাদের বিচার হবে।'
উল্লেখ্য, পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রোববার প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসকে জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক এসব ঘটনায় জড়িত সন্দেহে ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ইতোমধ্যে ৩১ জনকে প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করা হয়েছে।
এছাড়া চট্টগ্রামে ভারতের সহকারী হাইকমিশনারের বাসভবনের নিকটে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টাকারীদের মধ্যে তিনজনকে ভিডিও ফুটেজের মাধ্যমে শনাক্ত করা হয়েছে।
গ্রেপ্তারকৃত কাশেম ফারুক বগুড়ার আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া কাসেমুল উলুম মাদ্রাসার প্রাক্তন ছাত্র এবং ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকার বাসিন্দা। মো. সাইদুর রহমান ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলার নোয়াকান্দা গ্রামের বাসিন্দা।
শেরপুর জেলার বাসিন্দা গ্রেপ্তারকৃত রাকিব হোসেন প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টার-এ ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী হিসেবে ভিডিও ফুটেজে শনাক্ত হয়েছেন। তার আইডি থেকে ধ্বংসস্তূপের ছবি তুলে পোস্ট করা হয়। তিনি ফেসবুকে তার আইডি থেকে উসকানিমূলক পোস্টও করেন।
ঢাকার তেজগাঁওয়ের কুনিপাড়া এলাকার বাসিন্দা মো. নাইমকে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলায় এ ঘটনায় লুট হওয়া ৫০,০০০ টাকাসহ গ্রেপ্তার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে নাইম স্বীকার করেছেন, তিনি মোট ১,২৩,০০০ (এক লক্ষ তেইশ হাজার) টাকা লুট করেছেন। লুট করা টাকা দিয়ে তিনি মোহাম্মদপুর থেকে একটি টিভি ও একটি ফ্রিজ কিনেছিলেন, যা ইতোমধ্যে উদ্ধার করা হয়েছে।
ঢাকার কারওয়ান বাজার রেললাইন এলাকা থেকে গ্রেপ্তারকৃত মো. সোহেল রানার বিরুদ্ধে মাদকসহ অন্যান্য আইনে ঢাকার বিভিন্ন থানায় ১৩টি মামলা রয়েছে। একই এলাকা থেকে গ্রেপ্তারকৃত মো. শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে অতীতে অগ্নিসংযোগ ও ককটেল বিস্ফোরণের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে দুটি মামলা রয়েছে।
গ্রেপ্তারকৃত অন্যান্যদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।
প্রথমে প্রথম আলো ভবন, পরে ডেইলি স্টার এবং এরপর উদীচীতে হামলার ঘটনা ঠেকাতে ডিএমপি সক্ষম ছিল কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে নজরুল ইসলাম বলেন, 'আমরা সক্ষম। তবে সব সময় সব ঘটনা কভার করা সম্ভব হয় না। যখন জনসেন্টিমেন্ট বেড়ে যায়, তখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্র সর্বোচ্চ পর্যায়ে তার সক্ষমতা ব্যবহার করে।'
তিনি বলেন, 'কারওয়ান বাজারের যে পরিস্থিতি ছিল, সেখানে আমরা অ্যাকশনে গেলে গুলি হতো, দুই–চারজন মারা যেতেন। এরপর পুলিশের ওপর পাল্টা আক্রমণ হতো।'
ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৪ ধারার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে নজরুল ইসলাম জানান, নির্দিষ্ট কিছু অপরাধের ক্ষেত্রে অপরাধীকে ধরতে সহায়তা করার আইনি অধিকার জনগণের রয়েছে। এই অধিকারের ভিত্তিতেই কেবল এই ঘটনা নয়, বরং অন্যান্য মামলার আসামিদের ধরিয়ে দিতে বা তাদের সম্পর্কে তথ্য দিতে এলাকাবাসীর প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে গত ১৮ ডিসেম্বরের ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরে জানানো হয়, ওই দিন রাত সাড়ে ৯টার দিকে ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরীফ ওসমান হাদীর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে শাহবাগ মোড়ে উত্তেজনা সৃষ্টি হয় এবং লোকজন জড়ো হতে থাকে। এক পর্যায়ে জনতা কারওয়ান বাজারের দিকে অগ্রসর হয়।
এতেবলা হয়, রাত আনুমানিক সোয়া ১১টা থেকে দিবাগত রাত আড়াইটা পর্যন্ত কয়েক হাজার মানুষের উপস্থিতিতে পরিকল্পিতভাবে এই হামলা চালানো হয়। হামলাকারীরা প্রথমে প্রথম আলো এবং পরবর্তীতে দ্য ডেইলি স্টার কার্যালয়ে ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট চালায় এবং অগ্নিসংযোগ করে। এই পুরো ঘটনাকে 'অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনভিপ্রেত' বলে বর্ণনা করা হয়।
নজরুল ইসলাম আরও বলেন, হামলার সময় ফায়ার সার্ভিসের গাড়িগুলো আগুন নেভাতে ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে চাইলেও তাদের বাধা দেওয়া হয়। দুর্বৃত্তরা রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে জরুরি সেবা চলাচলে বিঘ্ন ঘটায়, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছিল। সংশ্লিষ্টদের শনাক্তে সাধারণ মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ এখন একান্ত প্রয়োজন বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।
