ঔপনিবেশিক প্রভাব না ভাষাগত সুবিধা? ইংরেজি ভাষা নিয়ে টানাপোড়নে ভারত
১৬০০ সালের দিকে ব্রিটিশ বণিকরা ভারতের উপকূলে এসে মূলত মসলা ও রেশমের জন্য বাণিজ্য শুরু করে। কিন্তু পরবর্তীতে তারা এখানে দীর্ঘকাল বসতি স্থাপন করে, যার ফলশ্রুতিতে ভারতীয় সমাজে ঔপনিবেশিক শোষণ ছাড়াও একটি গুরুত্বপূর্ণ উত্তরাধিকার থেকে যায়—ইংরেজি ভাষা।
প্রথমে ইংরেজি ছিল ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যম। পরবর্তীতে আইন ও প্রশাসনের ভাষা হিসেবে গড়ে ওঠে। ধীরে ধীরে ইংরেজি উচ্চবিত্ত ও শিক্ষিত সমাজের পরিচয়চিহ্নে পরিণত হয়।
তবে গত এক দশকের বেশি সময় ধরে শাসনরত হিন্দুত্ববাদী সরকারের নীতি ও মনোভাব ইংরেজি ভাষার অবস্থানে পরিবর্তন এনেছে। বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ইংরেজির প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করার চেষ্টা করছে।
সম্প্রতি ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ মন্তব্য করেন, 'ইংরেজি ভাষায় কথা বলার জন্য মানুষ শিগগিরই লজ্জিত বোধ করবে।' তার এই বক্তব্য ভারতের ১৪০ কোটি মানুষের মধ্যে জাতীয় পরিচয় এবং ভাষা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি করেছে।
যদিও অমিত শাহ সরাসরি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের কথা উল্লেখ করেননি, তিনি বলেন, 'আমাদের দেশের ভাষাগুলোই আমাদের সংস্কৃতি। এই ভাষাগুলো ছাড়া আমরা প্রকৃত ভারতীয় হতে পারি না।'
ঔপনিবেশিক যুগে ইংরেজি ভাষা প্রথম ব্যবহৃত হত সরকারি কার্যালয়গুলোতে—হিসাব-নিকাশ ও চুক্তিপত্র লেখার কাজে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ শাসন গুজরাটের বন্দর থেকে দিল্লির রাজপ্রাসাদ পর্যন্ত প্রসারিত হওয়ার পর ইংরেজি হয়ে ওঠে শাসক ও প্রশাসনিক শ্রেণির প্রধান ভাষা।
স্বাধীনতার পর ভারতীয় সমাজের সামনে বড় এক প্রশ্ন দাঁড়ায়—এই বহুভাষী দেশে জাতির নতুন ভাষা কী হবে? তখন উত্তর ভারতের প্রধান ভাষা হিন্দিকে সরকারি ভাষা হিসেবে প্রস্তাব দেওয়া হয়।
দক্ষিণ ভারতের বেঙ্গালুরু শহরের সাবেক করপোরেট কর্মকর্তা প্রদীপ বাহিরওয়ানি বলেন, 'ইংরেজি ঔপনিবেশিক শাসকদের ভাষা। জাতীয় ভাষা হওয়া উচিত এমন ভাষা যার শিকড় ভারতের মাটিতে।'
অন্যদিকে সমালোচকরা মনে করেন, অমিত শাহর বক্তব্য ভারতের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। তারা বলছেন, ইংরেজিকে 'লজ্জার বিষয়' হিসেবে দেখানো সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি, যা ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার মুছে ফেলার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ ভাষা থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে দেশকে।
জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞানী অধ্যাপক আয়েশা কিদওয়াই বলেন, 'মানুষ ইংরেজি শিখতে চায়, কারণ এর আন্তর্জাতিক মর্যাদা আছে। এটা শুধুমাত্র ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার নয়।'
বিজেপির এই অবস্থানের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
ভারতে ভাষা নিয়ে এ দ্বন্দ্ব ছড়িয়ে পড়েছে রাস্তাঘাটেও। গত সপ্তাহে মুম্বাইয়ের এক ট্রেনে মারাঠি ভাষায় কথা না বলার কারণে এক যাত্রীকে হয়রানির ভিডিও ভাইরাল হয়। পরে শহরের অন্যান্য অংশেও সরকারি উদ্যোগে হিন্দি ভাষার প্রচারকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়।
অনেকের ধারণা, বিজেপি হিন্দি ভাষাকে জাতীয় ঐক্য ও হিন্দুত্ববাদী পরিচয়ের অংশ হিসেবে ব্যবহার করছে, যা দলের উত্তর ভারতের রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে জড়িত।
ভাষার রাজনীতি
ব্রিটিশ শাসন থেকে ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার পর ভারতের ইংরেজি ভাষা রাজনৈতিকভাবে গুরুত্ব পেতে শুরু করে।
বর্তমানে দেশটির প্রায় ১০ শতাংশ মানুষ ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করে থাকেন। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, প্রায় ৪৪ শতাংশ মানুষ হিন্দিকে মাতৃভাষা হিসেবে ব্যবহার করেন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি হিন্দি ভাষার প্রচারে জোর দিয়ে সরকারি কার্যক্রমে ইংরেজির ব্যবহার কমানোর চেষ্টা করছে।
মোদি সরকার কর্মকর্তাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও সরকারি কাজকর্মে হিন্দি ব্যবহারের প্রতি উৎসাহ দিয়ে থাকে। মোদির রাজনৈতিক বক্তৃতাগুলো মোদি নিজেই প্রায়ই হিন্দিতে দিয়ে থাকেন।
২০২৩ সালে নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত জি২০ সম্মেলনের আমন্ত্রণপত্রে দেশের নাম 'ভারত' লেখা হয়েছিল, 'ইন্ডিয়া' নয়। এ নিয়ে আলোচনা বেড়েছে যে মোদি সরকার ভবিষ্যতে ভারতের ইংরেজি নাম পুরোপুরি বাদ দিতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী মোদির সমালোচকরা এ সিদ্ধান্তের পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য দেখতে পেয়েছেন।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) থেকে উঠে আসা বিজেপির ভাষানীতি দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ বৃহৎ হিন্দু জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিজেপি উত্তর ভারতের এই সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থকদের শক্তিশালী করতে এই নীতি গ্রহণ করেছে।
জুলাইয়ের শুরুতে মহারাষ্ট্রের মুম্বাইয়ে সহিংস দাঙ্গার পেছনে ছিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে হিন্দিকে বাধ্যতামূলক তৃতীয় ভাষা করার বিতর্কিত সিদ্ধান্ত।
দক্ষিণ ভারতেও ইংরেজি ও আঞ্চলিক ভাষা যেমন তামিল, তেলেগু, কান্নড়ের সঙ্গে যুক্ত প্রতিবাদ ও প্রতিক্রিয়া তীব্র কারণ এসব ভাষাকে স্থানীয় পরিচয় ও স্বায়ত্তশাসনের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়।
ভারতে ইংরেজি ভাষার বিকাশ
ভারতে ইংরেজি ভাষার বিস্তারের সূচনা ১৯ শতকের ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ থমাস ম্যাককলের চিন্তা থেকে। তিনি সংস্কৃত, পার্সি বা আরবির পরিবর্তে ইংরেজিকে শিক্ষার মাধ্যম করার পক্ষে ছিলেন।
ম্যাককলের লক্ষ্য ছিল একটি মধ্যস্থতাকারী শ্রেণি গড়ে তোলা—যারা 'রক্ত ও বর্ণে ভারতীয়, কিন্তু স্বাদ, মত, নৈতিকতা ও বুদ্ধিতে ইংরেজ' হবে। তার মতে, এই শ্রেণি ঔপনিবেশিক প্রশাসনকে আরও কার্যকরভাবে পরিচালনায় সহায়তা করবে।
ব্রিটিশ সরকার এই দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে ইংরেজিকে প্রশাসন, উচ্চশিক্ষা ও বিচার ব্যবস্থার ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। এর ফলে গড়ে ওঠে একটি সুবিধাপ্রাপ্ত ইংরেজি-শিক্ষিত শ্রেণি—আইনজীবী, শিক্ষক ও লেখক—যাঁদের মধ্যে ছিলেন জওহরলাল নেহরু, মহাত্মা গান্ধীসহ অনেক জাতীয়তাবাদী ও সমাজ সংস্কারক।
২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, ভারতে ১৩ কোটির বেশি মানুষ ইংরেজিতে দক্ষতার কথা জানিয়েছেন—যা দেশটিকে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ইংরেজিভাষী জনগোষ্ঠীর মর্যাদা দিয়েছে। এই ভাষাগত দক্ষতা বিদেশি বিনিয়োগ, আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব ও প্রযুক্তিভিত্তিক খাতে ভারতের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানকে জোরদার করেছে।
তবে ইংরেজির প্রাধান্য একটি নতুন ধরনের সামাজিক বিভাজনও সৃষ্টি করেছে। যারা ইংরেজি জানেন না, তারা উচ্চআয় ও পেশাগত সুযোগ থেকে অনেকাংশে পিছিয়ে পড়ছেন।
ধনী, শহুরে এবং উচ্চবর্ণের পরিবারগুলোতে ইংরেজির চর্চা বেশি, কারণ ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানত শহরেই কেন্দ্রীভূত। ফলে গ্রামীণ ও নিম্নবর্ণের মানুষ এখনো এই ভাষাগত সুবিধা থেকে অনেকটাই বঞ্চিত।
নয়াদিল্লির একটি হোটেলের পরিচ্ছন্নতাকর্মী বৈষ্ণবী গুজনান নারোতে বলেন, 'আমি ভালো বেতনের কাজ পাচ্ছি না, কারণ তারা বলে আমি ইংরেজি জানি না।' তার মতে, 'হিন্দি জানলে সাধারণ কাজ হয়তো করা যায়, কিন্তু ভালো পদে কাজ করতে ইংরেজি জানা বাধ্যতামূলক।'
একই অভিজ্ঞতার কথা বলেন নয়াদিল্লির একটি বেসরকারি সংস্থার কম্পিউটার শিক্ষক বিজয় কুমার। 'আমি স্কুলে ইংরেজি শিখিনি,' বলেন তিনি। 'তাই জীবনে অনেক সুযোগ হারিয়েছি বলে মনে হয়।'
বহুভাষিক ভারতে সংকটে আদিবাসী ভাষাগুলো
ইংরেজি ও হিন্দির প্রভাব, সঙ্গে দ্রুত শহরায়ণের ফলে ভারতের বহু আদিবাসী ভাষা ধীরে ধীরে মূলধারার বাইরে ছিটকে পড়ছে। শত শত উপজাতীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত এসব ভাষা আজ অস্তিত্বের সংকটে।
ইউনেস্কোর হিসাবে, ভারতের প্রায় ২০০টি ভাষা বর্তমানে 'সঙ্কটাপন্ন'। আর পিপলস লিঙ্গুইস্টিক সার্ভে অব ইন্ডিয়ার তথ্য বলছে, গত ৫০ বছরে অন্তত ২২০টি ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
ঝাড়খণ্ডের লেখক ও সমাজকর্মী অলোকা কুজুর বলেন, 'ভারতের অনেক ভাষাই তার প্রাপ্য মর্যাদা বা স্বীকৃতি পায় না।' তার মাতৃভাষা কুডুক, ঝাড়খণ্ডের একটি উপজাতীয় ভাষা, যা এখনও প্রায় ২০ লাখ মানুষের মুখে ব্যবহৃত হলেও ইউনেস্কো সেটিকে 'সঙ্কটাপন্ন' হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
অলোকা কুজুর মনে করেন, ইংরেজির প্রভাব কুডুক ভাষা ও সংস্কৃতির স্বীকৃতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। 'আদিবাসী ভাষার সঙ্গে আমাদের এমন এক গভীর আত্মিক সম্পর্ক আছে যা কখনো ছিন্ন হয় না,' বলেন তিনি। তবে তাঁর পর্যবেক্ষণ—দৈনন্দিন জীবনে কুডুক ভাষার ব্যবহার ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে।
ভবিষ্যতের প্রসঙ্গে বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের ভাষানীতিতে ইংরেজির গুরুত্ব সহজে কমবে না। অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রীতা কোরতারির ভাষায়, 'ইংরেজিকে পাশ কাটানোর কোনো ভয় নেই। এটি এতটাই শক্তিশালী যে সহজে ছিটকে পড়বে না।'
অনুবাদ: আয়েশা ওয়ারেসা
