কুরস্ক থেকে যে কারণে ইউক্রেনীয় সেনারা পিছু হটতে বাধ্য হলো

গত গ্রীষ্মে ক্রেমলিনকে অবাক করে দিয়ে করে দ্রুততা ও সাহসিকতার সঙ্গে রাশিয়ার কুরস্ক অঞ্চল দখলে নিয়েছিল ইউক্রেনীয় বাহিনী। কিন্তু রুশ আক্রমণের মুখে অবশেষে এ অঞ্চল থেকে প্রায় পুরোপুরি পিছু হটেছে তারা।
ইউক্রেনীয় প্লাটুন কমান্ডার বরোদা জানিয়েছেন, রুশ বাহিনী সব দিক থেকে তাদের ঘেরাও করেছিল। ফলে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল। পিছু হটার প্রক্রিয়া কিছু অংশে সুশৃঙ্খল হলেও অন্য অংশে অরাজক ছিল, কারণ রুশ বাহিনী ইউক্রেনীয় বাহিনীকে সীমান্তের কাছে একটি সংকীর্ণ অঞ্চলে ঠেলে দিয়েছিল।
বরোদা বলেন, 'যেখানে আমাদের অবস্থান ছিল, সেটি রুশ বাহিনী দখল করেছে।'
আক্রমণের তুঙ্গে ইউক্রেনীয় বাহিনী প্রায় ৫০০ বর্গমাইল রুশ ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ করছিল। কিন্তু রোববার পর্যন্ত তারা মাত্র ৩০ বর্গমাইল এলাকাতেই রাশিয়া-ইউক্রেন সীমান্ত বরাবর অবস্থান ধরে রেখেছিল বলে জানিয়েছেন সামরিক বিশ্লেষক পাসি প্যারোইনেন।
প্যারোইনেন ফোনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, 'যুদ্ধের শেষ ঘনিয়ে আসছে।'
কুরস্কে ইউক্রেনীয় বাহিনীর নিয়ন্ত্রণের পরিসর এখনও স্পষ্ট নয়, তবে সেনারা তীব্র লড়াইয়ের কথা জানিয়েছেন। এখন তাদের মূল লক্ষ্য, ইউক্রেনের সুমি অঞ্চলে রুশ বাহিনীর আক্রমণ প্রতিরোধ করা এবং নতুন একটি সামরিক ফ্রন্ট খোলার চেষ্টা প্রতিহত করা।
বরোদা বলেন, 'আমরা কুরস্ক ফ্রন্টে আমাদের অবস্থান ধরে রেখেছি,' যদিও এখন ওই অবস্থান সীমান্তের কাছাকাছি।
ইউক্রেনীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তা আন্দ্রিই সরাসরি বলেন, 'কুরস্ক অপারেশন মূলত শেষ। এখন আমাদের পরিস্থিতি স্থিতিশীল করতে হবে।'
কিছু বিশ্লেষক কুরস্ক অপারেশনকে অযথা ঝুঁকি হিসেবে সমালোচনা করেছেন, যা ইউক্রেনীয় বাহিনীকে প্রসারিত করেছে এবং ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ঘটিয়েছে।
তবে এটি তাদের মনোবল বৃদ্ধির কারণ ছিল, কারণ এটি দেখিয়েছে যে ইউক্রেন রাশিয়ার ভূখণ্ডে আঘাত হানতে সক্ষম এবং দখল করা এলাকা সম্ভাব্য যুদ্ধবিরতির আলোচনায় হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
কিয়েভ ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে রুশ আক্রমণ থামাতে সক্ষম হলেও, ট্রাম্প প্রশাসন দ্রুত যুদ্ধবিরতির পক্ষে চাপ তৈরি করার মাঝেই কুরস্কে ইউক্রেনীয় বাহিনীর পতন ঘটল।
কুরস্কে ইউক্রেনীয় বাহিনীর পিছু হটার একাধিক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে– রুশ বাহিনীর ইউক্রেনের সরবরাহ লাইন ব্যাহত করা, উত্তর কোরীয় সেনাদের যুদ্ধের ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং মার্কিন সামরিক সহায়তা সামরিক বন্ধ করা, যার মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদানও অন্তর্ভুক্ত ছিল।

যেভাবে যুদ্ধের মোড় ঘুরে গেল
জানুয়ারির শেষের দিকে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস সুমি ও কুরস্কের সীমান্ত পরিদর্শন করেছিল। সেখানে রাশিয়ার ড্রোন হামলার কারণে দিনের বেলা চলাফেরা প্রায় অসম্ভব ছিল। সুমি থেকে ছোট রুশ শহর সুদজা [যা আগস্ট থেকে ইউক্রেনীয় বাহিনী দখল করে রেখেছিল] পর্যন্ত প্রধান সড়কটি পুড়ে যাওয়া গাড়ি, ট্যাংক ও আর্মার্ড গাড়ি ভর্তি ছিল।
ইউক্রেন কুরস্ক অভিযানে তার অভিজ্ঞতম কয়েকটি ব্রিগেড পাঠিয়েছিল। তবে রুশ বাহিনীর অবিরাম আক্রমণ এবং হাজার হাজার উত্তর কোরীয় সেনা [যারা রুশ বাহিনীর সাথে লড়াই করছিল] ইউক্রেনীয় বাহিনীর অনেক ক্ষতি করেছিল।
জানুয়ারিতে উত্তর কোরীয় বাহিনী সাময়িকভাবে পুনর্গঠনের উদ্দেশ্যে প্রত্যাহার করা হয়েছিল। তবে ফেব্রুয়ারিতে তারা যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরেছিল। ইউক্রেনীয় বাহিনী জানিয়েছিল, তাদের (উত্তর কোরীয় বাহিনী) যুদ্ধ দক্ষতা আগের থেকে উন্নত হয়েছে।
ইউক্রেনীয় প্লাটুন কমান্ডার বরোদা বলেন, 'তাদের অনেকেই বুদ্ধিদীপ্ত কৌশল ব্যবহার করেছিল।'
ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি রুশ বাহিনী ইউক্রেনের মূল সরবরাহ রুটের পাঁচ মাইলের মধ্যে প্রবেশ করেছিল। সুদজায় পৌঁছানোর জন্য এই রুট ব্যবহার করা হত। তারা এসব গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো ড্রোন হামলার মাধ্যমে লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছিল। এর মধ্যে অনেক স্থানে অতি পাতলা ফাইবার অপটিক তার থাকায়, সেগুলো জ্যামিংয়ের বিরুদ্ধে সুরক্ষিত ছিল।
ইউক্রেনীয় বাহিনীর ৩৬ বছর বয়সী বিশেষ অপারেশন ফোর্সের যোদ্ধা কেপ রুশ ড্রোনগুলোকে অ্যাম্বুশের জন্য ব্যবহৃত হতে দেখেছেন। তিনি বলেন, 'তাদের ড্রোনগুলো গুরুত্বপূর্ণ সাপ্লাই রুটের কাছে নামত এবং লক্ষ্যবস্তু পার হওয়ার অপেক্ষায় থাকত।'
ড্রোনের পাশাপাশি রুশ বাহিনী কুরস্কের সেতুগুলো ধ্বংস করতে পূর্বে স্থাপিত বিস্ফোরক ব্যবহার করেছিল। এতে ইউক্রেনীয় বাহিনীর জন্য পিছু হটা আরও কঠিন হয়ে পড়ে।
রুশ যুদ্ধবিমান থেকেও সেতুগুলোতে হামলা চালানো হয়। এর মধ্যে একটি আঘাতে ৬ হাজার পাউন্ডের গাইডেড বোমা ফেলা হয়েছিল। এতে একটি গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহ লাইন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
একজন ঊর্ধ্বতন ইউক্রেনীয় ব্রিগেড কমান্ডারের আরটেম-এর মতে, এই সেতুগুলো ধ্বংস হওয়া সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ইউক্রেনীয় বাহিনীর পজিশন (অবস্থান) ত্যাগের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল। যদিও সব সেনা পালাতে সক্ষম হয়নি, বেশিরভাগই পালাতে সক্ষম হয়েছিল বলে জানান তিনি।

যেভাবে কুরস্কের দখল নিল রাশিয়া
মার্চের ৩ তারিখে ট্রাম্প প্রশাসন যখন সামরিক সহায়তা ও গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান স্থগিত করার ঘোষণা দেয়, তখন ইউক্রেনের কুরস্কে অবস্থান ইতোমধ্যেই বিপদের সম্মুখীন ছিল। হঠাৎ করে মার্কিন গোয়েন্দা তথ্যের অভাব ইউক্রেনের জন্য সঠিক লক্ষ্যবস্তুতে হাইমারস ক্ষেপণাস্ত্রসহ অন্যান্য হামলা চালানো কঠিন করে তোলে বলে ইউক্রেনীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তা আন্দ্রিই জানান।
তিনি বলেন, 'আমরা দামি ক্ষেপণাস্ত্র ভুল লক্ষ্যবস্তুতে ছুঁড়তে পারতাম না।'
৮ মার্চ রুশ বাহিনী একটি বড় সাফল্য অর্জন করে। তারা ইউক্রেনীয় বাহিনীর লাইনগুলোর পেছন থেকে পুরোনো গ্যাস পাইপলাইন ব্যবহার করে অতর্কিত আক্রমণ চালায়। রুশ কর্মকর্তারা এটিকে বীরত্বসূচক আক্রমণ বলে অভিহিত করে। কিন্তু ইউক্রেনীয় সূত্রগুলো এই আক্রমণকে বিপজ্জনক বলে উল্লেখ করে দাবি করে, পাইপলাইনে অবশিষ্ট মিথেনের কারণে বহু সেনা নিহত হয়েছিল।
তবে রাশিয়ার এই আক্রমণের মাধ্যমে যথেষ্ট বিভ্রান্তি এবং বিশৃঙ্খলা তৈরি করেছিল, যা ইউক্রেনীয় বাহিনীকে পিছু হটতে বাধ্য করেছিল বলে জানান ব্ল্যাক বার্ড গ্রুপের প্যারোইনেন।
এ সময় উত্তর কোরীয় বাহিনী কুরিলিভকা গ্রাম থেকে দক্ষিণে ইউক্রেনীয় বাহিনীর লাইন ভেঙে আক্রমণ শুরু করে। এটি কিয়েভের সরবরাহ চেইনকে আরও সংকুচিত করে। ইউক্রেনীয় বাহিনী সেখানে প্রতিরক্ষা লাইন বরাবর পিছু হটতে থাকে এবং রাশিয়ান বাহিনী দ্রুত সুদজা শহরের দিকে এগিয়ে যায়।
বিশ্লেষকরা বলেন, রুশ বাহিনীর অবস্থান মাথায় রেখে, যানবাহন ব্যবহার করে পিছু হটা ড্রোনের জন্য সহজ টার্গেট হতে পারত। এবং রাস্তার ওপর ছড়িয়ে থাকা ধ্বংস হওয়া সামরিক যানবাহনও পিছু হটতে আরও বাধা তৈরি করেছিল। 'বিশাল অংশ পায়ে হেঁটে পিছু হটতে হয়েছিল,' বলেন মিলিটারি বিশ্লেষক সেরহিই হ্রাবস্কি। কিছু ইউক্রেনীয় সেনা নিজেদের সরঞ্জাম জ্বালিয়ে দিয়ে রুশ বাহিনীর হাতে পড়ার আগে পিছু হটে যায়।
১০ মার্চ সুদজা থেকে কিছু ইউনিট পিছু হটার নির্দেশ পায় বলে জানান তিনজন ইউক্রেনীয় সেনা ও কমান্ডার। ইউক্রেনীয় প্লাটুন কমান্ডার বরোদা বলেন, 'এটি ছিল একটি মিশ্র, সংগঠিত ও বিশৃঙ্খল পিছু হটা।'
বিভিন্ন কারণ, যেমন ক্লান্তি, কমান্ডারদের নির্দেশের গুণগত মান, যোগাযোগের সমস্যা বা সঠিক সমন্বয়– কুরস্ক থেকে ইউক্রেনীয় বাহিনীর পিছু হটবার জন্য এগুলো দায়ী ছিল।
৩ দিন পর রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, তারা সুদজা পুনর্দখল করেছে। শনিবার তারা দাবি করে, শহরের বাইরে দুটি গ্রামও পুনর্দখল করা হয়েছে। ইউক্রেনীয় সামরিক স্টাফ সরাসরি রাশিয়ার সুদজা দখল করার বিষয়টি উল্লেখ করেনি। তবে রবিবার তারা একটি মানচিত্র প্রকাশ করে, যেখানে সুদজা শহর কুরস্কে তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় বাইরে দেখানো হয়।
সুদজা একসময় ৫ হাজার মানুষের বাসস্থান ছিল। যুদ্ধের ফলে শহরটি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কুরস্ক অভিযানের পর থেকে দুই পক্ষই বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে বলে জানান সামরিক বিশ্লেষকরা।

নতুন ফ্রন্টের আশঙ্কা
যদিও কিয়েভ যুদ্ধের সমাপ্তির জন্য রুশ ভূখণ্ডে তাদের নিয়ন্ত্রণ ব্যবহার করে আলোচনার ক্ষেত্রে সুবিধা পাওয়ার আশা করেছিল, এখন প্রেসিডেন্ট পুতিন ইউক্রেনীয় বাহিনীর পিছু হটার সুযোগে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে বিরোধ বন্ধ করার জন্য শক্তি বাড়ানোর চেষ্টা করছেন।
শনিবার ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে সীমান্তে জড়ো হওয়ার এবং সুমি অঞ্চলে প্রবেশ করে কুরস্কে ইউক্রেনীয় সেনাদের ঘেরাও ও আটকে ফেলার চেষ্টা করার অভিযোগ তুলেন। তবে, এই দাবিগুলো স্বাধীনভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
এখন ইউক্রেনীয় সেনারা বলছেন, তারা রুশ বাহিনীকে সুমির দিকে অগ্রসর হতে দেওয়া থেকে বিরত রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
সুমি অঞ্চলের ৪৪ বছর বয়সী স্বেচ্ছাসেবক অক্সানা পিনচুকোভা বলেছেন, তিনি আগামী সপ্তাহগুলোর জন্য উদ্বিগ্ন। তিনি বলেন, 'ধ্বংসাত্মক আক্রমণ এবং শেলিংয়ের মধ্যে জীবনযাপন– সবাই এর সাথে মানিয়ে নিতে পারে না।'
ইউক্রেনীয় সেনারা তাদের আসল নাম ব্যবহারের পরিবর্তে যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত নাম ব্যবহারের অনুরোধ জানিয়েছেন।