৪১ জন আত্মীয়-পরিজনকে আনতে ভিসার তদবির, যুক্তরাজ্যে তদন্তের মুখে লেবারদলের মেয়র

যুক্তরাজ্যের ক্ষমতাসীন লেবার দলের এক রাজনীতিবিদ তার মেয়রের পদ ব্যবহার করে বাংলাদেশ থেকে ৪১ জন আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুবান্ধবকে যুক্তরাজ্যে আনার জন্য তদবিরের মাধ্যমে চেষ্টা করেছেন। এমনটা উঠে এসেছে সে দেশের প্রভাবশালী দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফের এক অনুসন্ধানে।
এনফিল্ড কাউন্সিলের (উত্তর লন্ডন) ডেপুটি মেয়র মোহাম্মদ আমিরুল ইসলাম ব্রিটিশ হাইকমিশন, ঢাকায় তার কাউন্সিলের লোগো ও প্রতীকসংবলিত "আনুষ্ঠানিক" এবং কিছু "জালিয়াতি করা" চিঠি পাঠান, যেখানে তিনি ভিসা আবেদনগুলোকে "অনুকূলভাবে বিবেচনা" করার অনুরোধ জানান।
টেলিগ্রাফ যে চিঠিগুলো দেখেছে, তাতে আমিরুল দূতাবাস কর্মকর্তাদের লিখে অনুরোধ করেন যেন তার "ঘনিষ্ঠ বন্ধু" ও পরিবারের সদস্যরা নির্বিঘ্নে ভিসা পান এবং তারা যেন তার মেয়র হিসেবে অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারেন।
৪৭ বছর বয়সী আমিরুল বর্তমানে যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্তের মুখে আছেন। অভিযোগ উঠেছে তিনি অভিবাসন অপরাধ করেছেন। স্বাধীন তদন্তে আরও দেখা গেছে, তিনি নিজের পদকে ব্যবহার করেছেন পরিবার-পরিজন ও সহযোগীদের ভিসা প্রক্রিয়ায় সহায়তা করতে এবং ব্যক্তিগত স্বার্থে সুবিধা নিতে, যা তার কাউন্সিলকে "কলঙ্কিত" করেছে।
এক বছরের আগেই চিঠি পাঠানো হয়েছিল
যুক্তরাজ্যের স্থানীয় কর্তৃপক্ষ কমিশনের ১৬০ পৃষ্ঠার গোপন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমিরুল ইসলাম মেয়র হওয়ার আগেই কিছু তদবিরের চিঠি পাঠান, এমনকি কিছু চিঠি তখনও পাঠানো হয়েছে— যখন তিনি জানতেন না যে মেয়র নির্বাচিত হবেন।
২০২৪ সালের মে মাসে যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এনফিল্ড কাউন্সিলকে জানায়, বাংলাদেশে ব্রিটিশ দূতাবাস কর্মকর্তারা ডেপুটি মেয়রের স্বাক্ষরযুক্ত একটি ভিসা সংক্রান্ত চিঠি পেয়েছেন। এরপরই তদন্ত শুরু হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, কিছু চিঠিতে আবেদনকারীর পাসপোর্ট নম্বর ও জন্মতারিখও যোগ করা হয় যাতে ভিসা দ্রুত অনুমোদন হয়।
প্রথম দিকে এসব চিঠি মেয়রের কার্যালয় থেকেই পাঠানো হয়েছিল, পরে কিছু চিঠি "জালিয়াতি করে" অফিসিয়াল দেখানো হয় এবং সেগুলো ইসলাম নিজেই পাঠিয়েছেন বলে ধারণা করা হয়।
২০২৪ সালের মে মাসে আমিরুল ইসলামের মেয়র অভিষেক অনুষ্ঠানে ৪১ বাংলাদেশিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, তবে সেই তালিকায় থাকাদের মধ্যে মাত্র একজন অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলেন।
'পদমর্যাদার অপব্যবহার' প্রমাণিত
তদন্তকারীরা বলেছেন, সম্ভাবনার ভারসাম্যের ভিত্তিতে দেখা গেছে আমিরুল ইসলাম ডেপুটি মেয়রের অফিস ব্যবহার করে বাংলাদেশি ঘনিষ্ঠজনদের ভিসা আবেদনে সহায়তা করেছেন, যা নিয়মবহির্ভূত।
আমিরুল তদন্তকারীদের বলেন, তিনি কেবল সেই কাজই করেছেন যা তার আগের কিছু মেয়রও করতেন।
প্রতিবেদন অনুসারে, ১৩টি চিঠি কাউন্সিলের মেয়র অফিস থেকে পাঠানো হয়। আমিরুল স্বীকার করেছেন আরও ছয়টি তিনি নিজেই প্রস্তুত করেছিলেন। বাকি ১১টির বিষয়ে তিনি অস্বীকার করলেও তদন্তকারীরা বলছেন, প্রমাণের ভারসাম্য অনুযায়ী এগুলোও আমিরুল পাঠিয়েছেন বলে তাদের বিশ্বাস।
তদন্তে উঠে এসেছে, মেয়র কার্যালয়ের কর্মীরা ভিসা-সহায়ক চিঠি প্রস্তুত করতে অস্বস্তি প্রকাশ করার পর আমরুল ইসলাম নিজেই সেসব চিঠিতে "কারসাজি" করেন। সব চিঠিতেই তার বা তার পক্ষে কাউন্সিলের কোনো না কোনো কর্মীর স্বাক্ষর ছিল।
চিঠিগুলোয় লেখা থাকত—"এনফিল্ডে আমার অফিস আয়োজিত বিশেষ অনুষ্ঠানে আমার আত্মীয়/বন্ধুর উপস্থিতি আমার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।" এ ছাড়া সব খরচ বহনের প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হতো এবং আবেদনকারীরা তার বাড়িতে থাকবেন বলে উল্লেখ করা হতো।
রাজনৈতিক চাপ ও বিতর্ক
প্রতিবেদন বলছে, ডেপুটি মেয়ররা বিদেশি অতিথিদের ভিসা দেওয়ার পক্ষে সীমিতভাবে কাউন্সিলের সম্পদ ব্যবহার করতে পারেন, তবে আমিরুল ইসলাম এই সীমা অতিক্রম করেছেন। তিনি কেবল আত্মীয় নয়, বিভিন্ন বন্ধু ও সহযোগীদেরও সুবিধা দিতে চেয়েছেন।
কিছু চিঠি অনুষ্ঠানের এক বছর আগে বা অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর পাঠানো হয়েছিল, এতে প্রমাণিত হয় ভিসা চাওয়ার উদ্দেশ্য অনুষ্ঠানে উপস্থিতি নয়, বরং অন্য কিছু ছিল।
কাউন্সিলের কনজারভেটিভ নেতা ক্লার জর্জিও আলেসান্দ্রো বলেন, "এনফিল্ড লেবার কাউন্সিল এসব অভিযোগ আগেই জানত, তারপরও তাকে মেয়র হতে দিয়েছে। এতে কাউন্সিল কলঙ্কিত হয়েছে। তার পদত্যাগ করা উচিত।"
আমিরুল ইসলামের বক্তব্য
ইসলাম বলেন, তিনি কোনো ভুল করেননি। তদন্তে তিনি দাবি করেন, বাংলাদেশে একটি "এজেন্সি" তার কিছু চিঠি জাল করেছে ও স্বাক্ষর নকল করেছে।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া একজন ব্যক্তি হিসেবে তার মেয়র হওয়া নিয়ে পরিবার গর্বিত ছিল এবং তারা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আগ্রহী ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার সমর্থিত কোনো ভিসা আবেদন সফল হয়নি।
পরবর্তী ব্যবস্থা
২০২৫ সালের জুনে লেবার পার্টি আমিরুল ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত করে। তিনি বর্তমানে স্বাধীন কাউন্সিলর হিসেবে কাজ করছেন।
এনফিল্ড কাউন্সিল এক বিবৃতিতে জানায়, আমিরুল ইসলাম তার দপ্তরকে কলঙ্কিত করেছেন এবং এখন তাকে শাস্তি মেনে চলতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে, ভিসা আবেদনে কাউন্সিলর হিসেবে সহায়তা না করা, আচরণবিধি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা এবং সাবেক মেয়রের ব্যাজ আর ব্যবহার না করা।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র বলেন, "অভিবাসন-সংক্রান্ত অপরাধের সব অভিযোগ গভীরভাবে তদন্ত করা হয়। যেখানে প্রয়োজন, সঠিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।"
এনফিল্ড কাউন্সিল ব্যাখ্যা করেছে কেন তারা তদন্ত শুনানি জনসমক্ষে আনেনি। কাউন্সিলের মতে, এটি ন্যায়সংগত ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়া ছিল এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর গোপনীয়তা রক্ষা করাই ছিল প্রধান উদ্দেশ্য।
প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে কাউন্সিল জানিয়েছে: "আমরা আমাদের কাউন্সিলরদের কাছ থেকে সর্বোচ্চ মানের আচরণ আশা করি। বিস্তৃত তদন্ত শেষে যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তাতে আমরা সন্তুষ্ট।"