কালই যদি হঠাৎ যুদ্ধ বাধে, যুক্তরাজ্য কত দিন লড়তে পারবে?
ইউক্রেনে রাশিয়ার পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ শিগগির পঞ্চম বছরে গড়াতে চলছে। এর মধ্যেই ইউরোপজুড়ে বাড়ছে 'হাইব্রিড ওয়ার', যা উত্তেজনা আরও উসকে দিচ্ছে। যুক্তরাজ্যের সামরিক প্রধানেরা সতর্ক করে বলেছেন, যুদ্ধ এড়াতে চাইলে এখনই যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে হবে। কিন্তু অকল্পনীয় সেই ঘটনাটি যদি ঘটেই যায়, রাশিয়ার সঙ্গে যদি সত্যিই যুদ্ধ বেধে যায়, তবে যুক্তরাজ্য কত দিন লড়তে পারবে? কয়েক সপ্তাহের বেশি কি তারা আদৌ টিকতে পারবে?
গত ২ ডিসেম্বর রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেন, 'আমরা ইউরোপের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ানোর পরিকল্পনা করছি না। তবে ইউরোপ যদি চায় এবং যুদ্ধ শুরু করে, তবে আমরা এখনই প্রস্তুত।' পুতিনের অভিযোগ, যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনে শান্তি ফেরানোর যে চেষ্টা করছে, ইউরোপের দেশগুলো তাতে বাধা দিচ্ছে।
তবে বিষয়টি পরিষ্কার করা দরকার। যুক্তরাজ্যের একাই রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা নেই বললেই চলে। যুদ্ধ হলে ন্যাটো জোটের অন্য মিত্রদের সহায়তা ছাড়া যুক্তরাজ্য একা লড়বে না।
যুদ্ধ মানেই যে শুধু ড্রোন, বোমা আর ক্ষেপণাস্ত্রের ধ্বংসলীলা—বিষয়টি এখন আর তেমন নয়। ইউক্রেনের মানুষের কাছে এই দৃশ্য অতি পরিচিত ও ভয়াবহ হলেও যুদ্ধের আরও নানা কৌশল রয়েছে।
এখনকার সমাজ প্রযুক্তিনির্ভর। যুক্তরাজ্য বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে যাওয়া কেব্ল ও পাইপলাইনের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। ডেটা আদান–প্রদান, আর্থিক লেনদেন ও জ্বালানি সরবরাহের জন্য এসব ক্যাবলই ভরসা।
অভিযোগ রয়েছে, রাশিয়ার 'ইয়ানটার'-এর মতো গোয়েন্দা জাহাজগুলো যুদ্ধের সময় নাশকতার উদ্দেশ্যে এসব ক্যাবল অবস্থান গোপনে রেকি করেছে। এ কারণেই যুক্তরাজ্যের রয়্যাল নেভি সম্প্রতি সেন্সরযুক্ত পানির নিচের ড্রোন বাহিনী গড়ে তুলেছে।
যুদ্ধ শুরু হলে পানির নিচের এসব গোপন তৎপরতার পাশাপাশি মহাকাশে পশ্চিমা স্যাটেলাইটগুলো অচল করে দেওয়ার চেষ্টা হতে পারে। এতে যুক্তরাজ্যের যুদ্ধ করার ক্ষমতা মারাত্মকভাবে কমে যাবে, এমনকি সাধারণ মানুষের জীবনেও নেমে আসতে পারে চরম বিপর্যয়।
দীর্ঘ যুদ্ধের সক্ষমতা কতটুকু
লন্ডনে সম্প্রতি 'ফাইটিং দ্য লং ওয়ার' নিয়ে একটি সম্মেলন হয়েছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউট (রুসি) আয়োজিত এ সম্মেলনে সামরিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিরা যুক্তরাজ্যের বর্তমান সক্ষমতা নিয়ে আলোচনা করেন। মূল প্রশ্ন ছিল, দীর্ঘ মেয়াদে যুদ্ধ চললে যুক্তরাজ্যের সেনাবাহিনী সেনা, গোলাবারুদ ও যন্ত্রাংশ নিয়ে কত দিন টিকতে পারবে।
রুসির হ্যামিশ মান্ডেলের মতে, কয়েক সপ্তাহের বেশি যুদ্ধ চালিয়ে নেওয়ার মতো পরিকল্পনা যুক্তরাজ্যের আছে—এমন প্রমাণ খুব একটা নেই। তিনি বলেন, 'চিকিৎসাসুবিধা সীমিত। রিজার্ভ বা সংরক্ষিত বাহিনী গড়ে তোলার গতিও ধীর। ব্যাপক প্রাণহানি সামাল দেওয়ার যে ব্রিটিশ পরিকল্পনা, তা মূলত 'কোনো প্রাণহানি হবে না'—এমন ধারণার ওপর ভিত্তি করেই তৈরি।'
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, দীর্ঘ যুদ্ধে টিকতে হলে শক্তিশালী 'ব্যাকআপ' বা বিকল্প ব্যবস্থা থাকতে হয়। যুদ্ধের ক্ষতি সামলে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার মতো দ্বিতীয় বা তৃতীয় সারির বাহিনী ও রসদ প্রয়োজন। কিন্তু ব্রিটিশ বাহিনীর বর্তমান কাঠামোতে এই গভীরতার অভাব স্পষ্ট।
বেসরকারি গোয়েন্দা সংস্থা সিবিলিনের প্রধান নির্বাহী জাস্টিন ক্রাম্প বলেন, 'গোলাবারুদ, কামান, যান, আকাশরক্ষা ব্যবস্থা ও জনবল—সবকিছুতেই ঘাটতি রয়েছে। কোনো ইউনিট অকেজো হয়ে পড়লে বা হতাহত বাড়লে তা পূরণ করার সক্ষমতা নেই বললেই চলে।'
ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে দুটি বড় সামরিক শিক্ষা পাওয়া গেছে। প্রথমত, আধুনিক যুদ্ধের প্রতিটি স্তরে ড্রোন এখন অবিচ্ছেদ্য অংশ। দ্বিতীয়ত, যুদ্ধে টিকে থাকতে হলে জনবল ও সামরিক সরঞ্জামের বিশাল মজুত থাকাটা অত্যন্ত জরুরি।
রাশিয়ার জনবল ও যুদ্ধের অর্থনীতি
রাশিয়ার সেনাবাহিনীর মান নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। সেনাদের পর্যাপ্ত রসদ, সঠিক নেতৃত্ব ও খাবারের অভাবের কথা প্রায়ই শোনা যায়। পূর্ব ইউক্রেনের ভয়াবহ 'ড্রোন জোনে' রুশ সেনাদের টিকে থাকার হারও খুব কম।
যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা গোয়েন্দাদের হিসাব অনুযায়ী, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত রাশিয়ার ১১ লাখের বেশি সেনা হতাহত, বন্দী বা নিখোঁজ হয়েছেন। ইউক্রেনেরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তবে সঠিক সংখ্যা নিশ্চিত করা কঠিন।
এত কিছুর পরও রাশিয়ার হাতে বিশাল জনবল রয়েছে। যুদ্ধে প্রতি মাসে গড়ে ৩০ হাজার সেনা হারালেও তা পূরণ করার সক্ষমতা তাদের আছে। নতুন সেনা নিয়োগ দিয়ে তারা সেই ঘাটতি দ্রুত মিটিয়ে ফেলছে।
অন্যদিকে তিন বছরের বেশি সময় ধরে রাশিয়ার অর্থনীতি পুরোদস্তুর যুদ্ধের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে একজন অর্থনীতিবিদকে। রুশ কারখানাগুলোতে দিনরাত তৈরি হচ্ছে ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র ও কামানের গোলা।
কিল ইনস্টিটিউট ফর দ্য ওয়ার্ল্ড ইকোনমির সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাশিয়া প্রতি মাসে প্রায় ১৫০টি ট্যাংক, ৫৫০টি সাঁজোয়া যান, ১২০টি ল্যানসেট ড্রোন এবং ৫০টির বেশি কামান তৈরি করছে।
পিছিয়ে যুক্তরাজ্য ও পশ্চিমারা
সমরাস্ত্র উৎপাদনের এই দৌড়ে যুক্তরাজ্য ও তার পশ্চিমা মিত্ররা রাশিয়ার ধারেকাছেও নেই। বিশ্লেষকরা বলছেন, রাশিয়ার মতো বিপুল হারে অস্ত্র উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করতে পশ্চিম ইউরোপের কারখানাগুলোর কয়েক বছর সময় লেগে যাবে।
চ্যাথাম হাউসের রাশিয়া বিশেষজ্ঞ কিয়ার গাইলস বলেন, 'ইউক্রেনের স্থলযুদ্ধ প্রমাণ করে দিয়েছে, কেউ যদি রাশিয়ার সঙ্গে স্থলযুদ্ধে জড়াতে চায়, তবে তার বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও জনবল থাকাটা অপরিহার্য।'
তিনি আরও বলেন, 'শুধুমাত্র নিয়মিত বাহিনী দিয়ে হবে না; এর বাইরে বিশাল এক রিজার্ভ বা সংরক্ষিত বাহিনী থাকাটা যে কতটা জরুরি, তা এখন স্পষ্ট।'
ভবিষ্যৎ যুদ্ধের কথা মাথায় রেখে ফ্রান্স ও জার্মানি সম্প্রতি ১৮ বছর বয়সীদের জন্য পুনরায় স্বেচ্ছাসেবী সামরিক সেবা চালুর উদ্যোগ নিয়েছে।
যুক্তরাজ্যের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল স্যার প্যাট্রিক স্যান্ডার্স ২০২৪ সালে অবসরে যাওয়ার আগে একটি প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ভবিষ্যতে স্থলযুদ্ধের জন্য যুক্তরাজ্যের উচিত একটি 'সিটিজেন আর্মি' গড়ে তোলার প্রশিক্ষণ দেওয়া। তবে ব্রিটিশ সরকার বা ১০ ডাউনিং স্ট্রিট সেই প্রস্তাব সঙ্গে সঙ্গেই নাকচ করে দেয়।
এ বিষয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান রুসির জ্যেষ্ঠ ফেলো এড আর্নল্ড বলেন, 'আমার মনে হয়, এটি যুক্তরাজ্যের সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত একটি বিষয়।'
তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, 'সুইডেন, জার্মানি বা ফ্রান্সের মতো দেশগুলো ফের সামরিক সেবার দিকে ঝুঁকছে। কারণ, সাংস্কৃতিকভাবে তাদের ওই ব্যবস্থার কথা মনে আছে। কিন্তু যুক্তরাজ্যে ১৯৬০-এর দশকের পর থেকে আর বাধ্যতামূলক সামরিক সেবা বা ন্যাশনাল সার্ভিস নেই। ফলে যখনই এ নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে আলোচনার চেষ্টা করা হয়েছে, ফল হয়েছে উল্টো।'
রাজনৈতিক বিতর্ক বনাম বাস্তবতা
যুক্তরাজ্যের কনজারভেটিভ সরকারের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী স্যার বেন ওয়ালেস বিবিসিকে বলেছেন, 'বাস্তবতা হলো, সরকারের বাগাড়ম্বর, সুদূরপ্রসারী খরচের প্রতিশ্রুতি আর ফাঁকা বুলি দিয়ে সশস্ত্র বাহিনী টিকে থাকতে পারে না।' ২০১৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত তিনি প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন।
বেন ওয়ালেসের এমন মন্তব্যের কড়া জবাব দিয়েছে বর্তমান লেবার সরকার। বর্তমান প্রতিরক্ষামন্ত্রী জন হিলির একজন মুখপাত্র বিষয়টিকে 'ভিত্তিহীন' বলে উড়িয়ে দিয়েছেন।
তিনি বলেন, 'আমরা কেবল এই বছরেই প্রতিরক্ষা বাজেট ৫০০ কোটি পাউন্ড বাড়িয়েছি। নির্বাচনের পর থেকে ১ হাজারটি বড় চুক্তি সই করেছি। গত এক বছরে ব্রিটিশ ব্যবসার সঙ্গে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের খরচ মূল্যস্ফীতির চেয়েও ৬ শতাংশ বেশি বেড়েছে।'
সরকারের এই মুখপাত্র নরওয়ের সঙ্গে নতুন প্রতিরক্ষা চুক্তি, রয়্যাল নেভির লেজার অস্ত্রের জন্য ৩০ কোটি পাউন্ড এবং সশস্ত্র বাহিনীর আবাসনে ৯০০ কোটি পাউন্ড বিনিয়োগের উদাহরণ টানেন। তাঁর দাবি, সরকার বাহিনীগুলোর রূপান্তর এবং ব্রিটিশ সেনাদের জন্য বিনিয়োগ করছে, যা দেশে কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধি বাড়াবে।
তবে বিষয়টি কেবল দলীয় রাজনীতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। মূল প্রশ্ন হলো, দীর্ঘদিন ধরে প্রতিরক্ষা খাতে কম অর্থায়নের ফলে যুক্তরাজ্য এখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে কি না, যেখানে দেশটি বেশ কিছু ক্ষেত্রে—বিশেষ করে আকাশরক্ষা ব্যবস্থায় মারাত্মক ঝুঁকির মুখে।
সমরাস্ত্র কেনাকাটায় দীর্ঘসূত্রতা আর অদক্ষতাও বড় সমস্যা। প্রতিরক্ষা চুক্তিগুলো বাস্তবায়িত হতে বছরের পর বছর লেগে যায়। যেমন 'আয়াক্স' নামের একটি সাঁজোয়া যানের প্রকল্পের কথা বলা যায়। শত শত কোটি পাউন্ড খরচের পরও এটি এখনো নানা সমস্যায় জর্জরিত, নির্ধারিত সময়ও পার হয়ে গেছে অনেক আগে। অথচ ন্যাটো কর্মকর্তারা সতর্ক করে বলছেন, আগামী তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে রাশিয়ার কোনো ন্যাটো দেশে হামলা চালানোর সক্ষমতা তৈরি হয়ে যেতে পারে।
অতীতের সঙ্গে বর্তমানের তুলনা করলেই সক্ষমতার ঘাটতি চোখে পড়ে। ১৯৯০ সালে স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হওয়ার সময় যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা বাজেট ছিল জিডিপির ৪ দশমিক ১ শতাংশ। এর পরের বছরই (১৯৯১) ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের কবল থেকে কুয়েতকে মুক্ত করতে 'অপারেশন ডেজার্ট স্টর্ম'-এ ৪৫ হাজার সেনা পাঠিয়েছিল যুক্তরাজ্য। আজকের প্রেক্ষাপটে এত বিপুল সেনা পাঠানোর সক্ষমতা যুক্তরাজ্যের আছে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
বাজেট ও জনবলের করুণ দশা
অর্থনীতির ওপর নানা চাপ সামলে ২০২৭ সালের মধ্যে জিডিপির আড়াই শতাংশ প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয়ের লক্ষ্য পূরণে হিমশিম খাচ্ছে যুক্তরাজ্য সরকার। অথচ রাশিয়া এখনই এ খাতে ব্যয় করছে জিডিপির প্রায় ৭ শতাংশ।
কাগজে-কলমে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সদস্যসংখ্যা ৭৪ হাজার। কিন্তু গবেষণা সংস্থা রুসির এড আর্নল্ডের হিসাব ভিন্ন। তিনি বলছেন, অসুস্থতার কারণে যুদ্ধে যেতে অক্ষম, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা প্রতিরক্ষা অ্যাটাশে এবং অন্যান্য কাজে নিয়োজিতদের বাদ দিলে যুদ্ধ করার মতো প্রকৃত সেনা আছে মাত্র ৫৪ হাজার। ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়া দুই মাসে গড়ে যে পরিমাণ সেনা হারায়, যুক্তরাজ্যের মোট যুদ্ধক্ষম সেনার সংখ্যা তার চেয়েও কম।
সিবিলিনের প্রধান জাস্টিন ক্রাম্প মনে করেন, স্থলযুদ্ধ শুরু হলে ব্রিটিশ বাহিনী টিকতে পারবে মাত্র কয়েক সপ্তাহ। এরপরই তারা কার্যকরভাবে লড়াই করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে। অবশ্য তিনি এ–ও বলেছেন, বিষয়টি নির্ভর করবে যুদ্ধের ধরন কেমন হবে তার ওপর।
যুক্তরাজ্য কি ইতিমধ্যে যুদ্ধে জড়িয়েছে?
কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করেন, যুক্তরাজ্য ইতিমধ্যে রাশিয়ার সঙ্গে একধরনের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। একে বলা হচ্ছে 'হাইব্রিড' বা 'গ্রে-জোন' যুদ্ধ। সাইবার হামলা, ভুয়া খবর ছড়ানো এবং ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর বিমানবন্দর বা সামরিক ঘাঁটির আশপাশে ড্রোন ওড়ানোর মতো ঘটনাগুলো এর অংশ। এসব ঘটনায় জড়িত থাকার কথা সাধারণত অস্বীকার করা হয়।
এসব ঘটনা উদ্বেগজনক সন্দেহ নেই। কিন্তু রাশিয়ার সেনাবাহিনী যদি ন্যাটোভুক্ত কোনো দেশে সরাসরি হামলা চালায়, ভূখণ্ড দখল করে বা মানুষ হত্যা শুরু করে, তবে যে ভয়াবহ সংকট তৈরি হবে, তার তুলনায় বর্তমান পরিস্থিতি কিছুই নয়।
ইউক্রেনে লক্ষ্য পূরণ হলে পুতিন সেখানেই থামবেন না বলে আশঙ্কা করছেন ন্যাটোর সামরিক প্রধানেরা। তাদের ধারণা, এরপর পুতিন নতুন নতুন জায়গায় আগ্রাসন চালানোর পরিকল্পনা করতে পারেন। এমন কয়েকটি ঝুঁকিপূর্ণ বা 'ফ্ল্যাশপয়েন্ট' এলাকার কথা উঠে এসেছে আলোচনায়।
এর মধ্যে অন্যতম 'সুওয়ালকি গ্যাপ'। পোল্যান্ড ও লিথুয়ানিয়ার সীমান্তের মাঝের প্রায় ১০০ কিলোমিটার এলাকা এটি। দুটি দেশই ন্যাটোর সদস্য। এই অংশটুকুই রাশিয়ার মিত্র বেলারুশকে বাল্টিক সাগরের তীরে অবস্থিত রাশিয়ার ছিটমহল কালিনিনগ্রাদ থেকে আলাদা করে রেখেছে।
তাত্ত্বিকভাবে বলা যায়, এই সীমান্ত এলাকা দখল করতে পারলে মস্কো সরাসরি বাল্টিক সাগরে তাদের কৌশলগত ঘাঁটিতে যাতায়াতের পথ পেয়ে যাবে।
বাল্টিক অঞ্চলের দেশগুলোও সংঘাতের ঝুঁকিতে আছে। এস্তুনিয়া, লাটভিয়া ও লিথুয়ানিয়া—একসময় এই তিন দেশই সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল এবং মস্কো থেকেই শাসিত হতো। স্বাধীনতার পর তারা ন্যাটোতে যোগ দিয়েছে।
তবে এসব দেশে এখনো প্রচুর রুশভাষী মানুষ বাস করে। পুতিন হয়তো এই 'সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার' অজুহাতে সীমান্ত পার হয়ে সেনা পাঠানোর চেষ্টা করতে পারেন। উদাহরণ হিসেবে এস্তুনিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় শহর নার্ভার কথা বলা যায়। শহরটির অধিকাংশ মানুষ রুশ ভাষায় কথা বলে। নদীর এক পাড়ে নার্ভা, আর ঠিক অন্য পাড়েই রাশিয়ার বিশাল দুর্গ ইভানগোরোদ। ফলে এটি সহজেই রাশিয়ার লক্ষ্যবস্তু হতে পারে।
নার্ভা থেকে প্রায় ৮০ মাইল পশ্চিমে ২০১৭ সাল থেকে যুক্তরাজ্যের ৯০০ সদস্যের একটি সেনাদল (ব্যাটেল গ্রুপ) মোতায়েন আছে। পরিকল্পনা হলো, যুদ্ধ শুরু হলে দ্রুত সেখানে আরও সেনা পাঠিয়ে সংখ্যাটি ৩ হাজার বা তার বেশিতে উন্নীত করা হবে।
সংঘাতের আরেকটি সম্ভাব্য ক্ষেত্র হতে পারে আর্কটিক বা সুমেরু অঞ্চলের দ্বীপপুঞ্জ ভালবার্ড। এটি নরওয়ের শাসনাধীন হলেও সেখানে রাশিয়ার বিচরণ রয়েছে। দ্বীপটির বারেন্টসবার্গ শহরে রাশিয়ার কয়লাখনি রয়েছে, যা সেখানে তাদের শক্ত উপস্থিতির জানান দেয়।
যুক্তরাজ্যের মাটিতে নাশকতা ও পুতিনের 'দায়'
ইউক্রেনের অন্যতম ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাজ্য। কিয়েভকে শক্তিশালী অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করার জন্য বরাবরই সরব লন্ডন। এ কারণে যুক্তরাজ্য এখন পুতিনের 'এক নম্বর শত্রু' হয়ে উঠেছে বলে মনে করা হয়।
যুক্তরাজ্যের মাটিতে ঘটা একাধিক নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নাম জড়িয়েছে। এর একটি হলো ২০০৬ সালে লন্ডনে সাবেক কেজিবি কর্মকর্তা আলেকজান্ডার লিটভিনেঙ্কোকে হত্যা। তেজস্ক্রিয় পলোনিয়াম-২১০ প্রয়োগ করে তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল। ওই ঘটনার গণতদন্তে উঠে এসেছিল যে পুতিন 'সম্ভবত' এই হত্যাকাণ্ডের অনুমোদন দিয়েছিলেন।
এরপর ২০১৮ সালে সলসবুরিতে সাবেক রুশ গোয়েন্দা (পরে ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআই সিক্সের এজেন্ট) সের্গেই স্ক্রিপালকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। এ ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়েছিল মারাত্মক নার্ভ এজেন্ট 'নোভিচক'।
এই ঘটনায় ডন স্টার্জেস নামের এক ব্রিটিশ নারী মারা যান। তিন সন্তানের জননী স্টার্জেস পারফিউমের বোতলে রাখা নোভিচক ভুল করে হাতে মেখেছিলেন। গত সপ্তাহে প্রকাশিত এক তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্টার্জেসের মৃত্যুর জন্য পুতিন 'নৈতিকভাবে দায়ী'।
তদন্ত কমিটির প্রধান লর্ড অ্যান্থনি হিউজ বলেন, 'আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে সের্গেই স্ক্রিপালকে হত্যার অভিযানটি সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে, অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট পুতিনের অনুমোদনক্রমেই পরিচালিত হয়েছিল।'
তবে রাশিয়া বরাবরই এসব হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। স্টার্জেসের মৃত্যুর বিষয়ে তারা ২০টির বেশি ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছে। আর সবশেষ এই তদন্ত প্রতিবেদনকে 'রুচিহীন রূপকথা' বলে উড়িয়ে দিয়েছে মস্কো।
ন্যাটো, ট্রাম্প এবং যুদ্ধের সমীকরণ
যুক্তরাজ্য সামরিক জোট ন্যাটোর অন্যতম প্রধান সদস্য। হোয়াইট হাউসের বর্তমান মার্কিন প্রশাসন (ট্রাম্প সরকার) ন্যাটোর পাশে থাকবে কি না, তা নিয়ে আড়ালে-আবডালে প্রশ্ন উঠছে ঠিকই। তবে যুক্তরাজ্যকে একা রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়তে হবে—এমনটা ভাবা কঠিন।
সিবিলিনের প্রধান জাস্টিন ক্রাম্প বলেন, 'যুক্তরাজ্য ও রাশিয়ার মধ্যে একক যুদ্ধের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। আমরা নিশ্চিতভাবেই মিত্রদের সঙ্গেই লড়ব। তবে রাশিয়া তখনই সংঘাত শুরু করবে, যখন তারা মনে করবে যে ন্যাটো জোট ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে।'
এখানে অনিশ্চয়তার বড় জায়গাটি হলো মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ন্যাটোর সামরিক কমিটির চেয়ারম্যান অ্যাডমিরাল কাভো ড্রাগন সম্প্রতি আশ্বস্ত করেছেন যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ন্যাটোর সুরক্ষায় সম্পূর্ণ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু অন্যরা অতটা নিশ্চিত হতে পারছেন না। যেমন ধরা যাক, এস্তুনিয়ার নার্ভা শহরকে বাঁচাতে ট্রাম্প কি যুদ্ধে জড়াবেন?
সমাজ হিসেবে কতটা প্রস্তুত যুক্তরাজ্য
চ্যাথাম হাউসের কেইর গাইলস বলেন, 'যুক্তরাজ্য আসলে কতটা সক্ষম, তার কোনো এককথার উত্তর নেই। কারণ রাশিয়ার চ্যালেঞ্জ নানাভাবে আসতে পারে।'
তবে পোল্যান্ড, ফিনল্যান্ড বা বাল্টিক দেশগুলোর মতো যুক্তরাজ্য সমাজ হিসেবে যুদ্ধের জন্য মোটেও প্রস্তুত নয়—এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। এমনকি যুদ্ধের জন্য বড় ধরনের প্রস্তুতি নেওয়াটাও বেশ ব্যয়বহুল, অজনপ্রিয় এবং রাজনৈতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ।
ব্রিটিশ জনগণের উদ্দেশে কঠিন এক সতর্কবার্তা দিয়েছেন কেইর গাইলস। তিনি বলেন, 'মনে রাখতে হবে, আপনারা যে অধিকার, স্বাধীনতা আর সমৃদ্ধি এত দিন স্বাভাবিক মনে করে আসছেন, তা আসলে হুমকির মুখে। স্বাধীনতা এমনি এমনি আসে না, এর মূল্য দিতে হয়।'
তিনি আরও বলেন, 'এটাও বুঝতে হবে যে জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আসবে। খরচ বাড়ার জন্য বর্তমান বা আগের সরকারকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। সমস্যার মূল বা আসল দোষী বসে আছে মস্কোতে।'
