১১৭ বছর বেঁচে থাকা বিশ্বের প্রবীণতম নারীর জিন বিশ্লেষণে দীর্ঘায়ুর রহস্য বের করলেন বিজ্ঞানীরা
কেউ যদি ১১০ বছরেরও বেশি সময় সুস্থভাবে বাঁচে, এমন মানুষদের দেখা হলে সবাই জানতে চান— তাদের দীর্ঘ জীবনের রহস্যটা কী?
তবে এখন বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন সেই রহস্যটি শুধু কথায় নয়, বৈজ্ঞানিকভাবে উদ্ঘাটন করতে। তারা অনুসন্ধান করছেন এমন দীর্ঘজীবী মানুষদের জিনোম বা জিনগত গঠনে কী বিশেষত্ব রয়েছে, যা বার্ধক্যের রোগগুলোকে দূরে রাখে।
সম্প্রতি সেল রিপোর্টস মেডিসিন জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় উঠে এসেছে তেমনই এক উদাহরণ— মারিয়া ব্রানিয়াস মোরেরা। মার্কিন বংশোদ্ভূত এই স্প্যানিশ নারী ২০২৪ সালের আগস্টে ১১৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি ছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে প্রবীণ জীবিত ব্যক্তি।
এই গবেষণার সহ-লেখক, স্পেনের জোসেপ ক্যারেরাস লিউকেমিয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষক ড. ম্যানুয়েল এস্টেলার সিএনএন-কে বলেন, 'তিনি (মারিয়া) খুব উদার মনের মানুষ ছিলেন এবং সবসময় সাহায্য করতে চাইতেন। তার সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতাটা ছিল অসাধারণ।'
ড. এস্টেলার এবং তার গবেষক দল মারিয়ার রক্ত, লালা, মূত্র এবং মলের নমুনা সংগ্রহ করেন। এরপর তারা তার জিনোম বিশ্লেষণ করেন এবং আরও ৭৫ জন আইবেরিয়ান নারীর জিনোমের সাথে তার তুলনা করেন।
সবকিছু বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, মারিয়া এত দীর্ঘ জীবন পেয়েছিলেন কারণ তিনি যেন জেনেটিক লটারি জিতেছিলেন এবং পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করতেন। তার শরীরে এমন কিছু জিন ছিল যা তাকে বয়স-সম্পর্কিত সাধারণ রোগগুলো থেকে রক্ষা করত। পাশাপাশি তিনি একটি স্বাস্থ্যকর জীবনধারা এবং খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ করতেন।
ড. এস্টেলার বলেন, 'তিনি শুরু থেকেই একজন সুস্থতার সাথে সম্পর্কিত জিনোমের অধিকারী ব্যক্তি ছিলেন এবং সারাজীবন ধরে তিনি নিজেকে আরও উন্নত করেছেন।' তিনি মারিয়ার দীর্ঘ জীবনের জন্য প্রায় অর্ধেক কৃতিত্ব তার জিনকে এবং বাকি অর্ধেক তার জীবনযাত্রাকে দেন।
তিনি সিএনএন-কে আরও বলেন, 'তিনি কখনও ধূমপান করেননি, মদ পান করেননি। যতদিন পারতেন, কাজ করতে ভালোবাসতেন। তিনি গ্রামে থাকতেন এবং পরিমিত ব্যায়াম করতেন (বেশিরভাগ দিন এক ঘণ্টা হাঁটতেন)। তার খাদ্যতালিকায় ছিল অলিভ অয়েল, ভূমধ্যসাগরীয় খাবার এবং বিশেষ করে দই।'
মারিয়ার জীবনযাত্রায় যদি কিছুটা অস্বাভাবিক কিছু থেকে থাকে, তবে তা হলো তার দই খাওয়া। তিনি দিনে তিনবার দই খেতেন। গবেষকরা অনুমান করেছেন যে, তার অন্যান্য খাদ্যাভ্যাসের সাথে এই অভ্যাসটি তার অন্ত্রের মাইক্রোবায়োমকে একজন তরুণ ব্যক্তির মতো রাখতে সাহায্য করেছিল এবং তার শরীরে প্রদাহের মাত্রা কমিয়েছিল।
তবে, লন্ডনের কিংস কলেজের বার্ধক্য বিষয়ক অধ্যাপক ক্লেয়ার স্টিভস, যিনি এই গবেষণার সাথে জড়িত ছিলেন না, তিনি বলেন, 'মারিয়ার দইয়ের প্রতি ভালোবাসা তার 'সামগ্রিক সুস্থতার' একমাত্র কারণ নাও হতে পারে। তার অন্ত্রের মাইক্রোবায়োম সম্ভবত এটাই প্রমাণ করে যে, তার শরীরের অন্যান্য ভালো দিকগুলোর কারণে তিনি সেই সব অন্ত্রের ভালো ব্যাকটেরিয়ার জন্য একটি খুব ভালো ধারক ছিলেন।'
প্রচুর দই খাওয়া ছাড়াও, মারিয়ার শরীরে জিনের বিভিন্ন রূপ ছিল যা তাকে স্বাস্থ্যকরভাবে বয়স বাড়াতে সাহায্য করেছিল। গবেষক দলটি যে কয়েকটি জিন শনাক্ত করেছে তার মধ্যে রয়েছে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং স্মৃতিশক্তির সাথে যুক্ত একটি জিন, শরীর কীভাবে চর্বি বিপাক করে তা প্রভাবিত করে এমন একটি জিন এবং মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য ও হৃদরোগের সাথে যুক্ত আরেকটি জিন।
ক্লেয়ার স্টিভস সিএনএন-কে বলেন, 'এই গবেষণাপত্রের বিশদ বিবরণের স্তরটি অসাধারণ।' তিনি আরও বলেন, 'তারা খুব গভীরে গিয়ে বিভিন্ন বার্ধক্য প্রক্রিয়া মূল্যায়ন করতে সক্ষম হয়েছেন। আমার জানা মতে, এত বিশদভাবে এই কাজটি করা প্রথম গবেষণাপত্র এটি।' তিনি যোগ করেন যে, ভবিষ্যতের গবেষণায় দেখা উচিত যে এই ফলাফলগুলো অন্যান্য শতবর্ষী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও পাওয়া যায় কিনা।
তবে, গবেষকদের মতোই স্টিভসও এই একটি মাত্র ব্যক্তির উপর ভিত্তি করে করা গবেষণা থেকে ব্যাপক সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর বিষয়ে সতর্ক করেছেন, কারণ প্রত্যেকের বার্ধক্য প্রক্রিয়া ভিন্ন। তিনি বলেন, 'যখন আপনি শুধুমাত্র একজন ব্যক্তিকে নিয়ে গবেষণা করেন, তখন আপনি নিশ্চিত হতে পারেন না যে যা দেখছেন তা নিছকই কাকতালীয় কিনা।' যদিও তিনি যোগ করেন যে, একজন ব্যক্তির উপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করাও কিছু অন্তর্দৃষ্টি দিতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, মারিয়ার জিনোম পরীক্ষা করে গবেষক দলটি দেখাতে সক্ষম হয়েছে যে, 'অত্যধিক বার্ধক্য এবং দুর্বল স্বাস্থ্য অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত নয়।'
স্টিভস বলেন, 'বয়সের সাথে অসুস্থতা অনিবার্য নয়। এটি জৈবিক প্রক্রিয়ার কারণে ঘটে। এটি এমন কিছু যা আমরা পরিবর্তন করতে পারি।' তিনি আরও বলেন যে, এই গবেষণাপত্রটি দেখায় যে 'এর কোনো একটিমাত্র সমাধান নেই, এটি একাধিক ভিন্ন পথের সমন্বয়।'
এবং স্বাস্থ্যকর বার্ধক্যের সাথে জড়িত জিন এবং প্রোটিনগুলো শনাক্ত করার মাধ্যমে, ড. এস্টেলার আশা করেন যে গবেষকরা এমন ওষুধ তৈরির পথ দেখাতে পারবেন যা এই নির্দিষ্ট উপাদানগুলোকে লক্ষ্য করে কাজ করবে।
স্টিভস যোগ করেন, 'আমাদের লক্ষ্য ১১৭ বছর বেঁচে থাকা নয়। আমরা যা করতে চাই তা হল, অসুস্থতা এবং কষ্টের সময়টাকে যতটা সম্ভব ছোট করে আনা। আর এই ভদ্রমহিলা ঠিক তাই করেছেন, পাশাপাশি একটি দীর্ঘ জীবনও পেয়েছেন।'
