চুইংগাম প্রিয়? কী চিবুচ্ছেন জানেন, প্লাস্টিক!
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে, উইলিয়াম রিগলি জুনিয়র চুইংগাম দিয়ে এক বিশাল সাম্রাজ্য গড়ার স্বপ্ন দেখছিলেন। তার এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে, তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ বিভাগকে রাজি করিয়ে ফেলেন সৈন্যদের খাবার প্যাকেটে তার পণ্য অন্তর্ভুক্ত করার জন্য।
তার যুক্তি ছিল—যদিও সে সময়ে এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ছিল না—যে চুইংগাম নাকি তৃষ্ণা মেটাতে, ক্ষুধা দূর করতে এবং মানসিক উত্তেজনা কমাতে পারে। আর তিনি ঠিকই ছিলেন! বিজ্ঞানীরা পরবর্তীতে দেখেছেন, চুইংগাম চিবানো সত্যিই মনোযোগ বাড়াতে, বারবার খাওয়ার প্রবণতা কমাতে, তৃষ্ণা মেটাতে এবং মুখের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে।
হয়তো একারণেই বিশ্বের মানুষ কমপক্ষে ৮,০০০ বছর ধরে আঠালো নানা জিনিস—যেমন গাছের মূল, রজন, ডালপালা, তিমি মাছের চর্বি, এমনকি গাছের ছাল পুড়িয়ে তৈরি করা আলকাতরা—চিবানোর অভ্যাস করে আসছে। আজকের দিনে, চুইংগামকে আবারও সুস্থতার এক মহৌষধ হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। এখন বাজারে শক্তি বাড়ানো, পুষ্টি জোগানো বা মানসিক চাপ কমানোর জন্য ডিজাইন করা বিশেষ চুইংগামও পাওয়া যায়।
বিজ্ঞানীরা এমনকি এমন চুইংগাম তৈরির চেষ্টা করছেন, যা ইনফ্লুয়েঞ্জা, হার্পিস এবং কোভিডের মতো রোগ থেকেও রক্ষা করতে পারে। কিন্তু পরিহাসের বিষয় হলো, চুইংগামের এই নতুন যুগে এমন এক আধুনিক উপাদান ব্যবহার করা হচ্ছে, যা সাধারণত সুস্থতার সাথে একেবারেই যুক্ত নয় আর তা হলো প্লাস্টিক।
প্রাকৃতিক উপাদান থেকে প্লাস্টিকের যুগে
রিগলি যখন তার ব্যবসা শুরু করেন, তখন আমেরিকানরা ক্যান্ডি-কোটেড বল বা প্যাকেজড স্টিক হিসেবে বিক্রি হওয়া চুইংগামে অভ্যস্ত ছিল। এই চুইংগামগুলোর ভিত্তি তৈরি হতো প্রাকৃতিক উপাদান যেমন স্প্রুস গাছের রজন এবং 'চিকল' দিয়ে। চিকল এক ধরনের প্রাকৃতিক আঠা, যা অ্যাজটেক ও মায়ান সভ্যতার মানুষরা হাজার হাজার বছর ধরে চিবাতো।
কিন্তু সমস্যা হলো, যে চিকোজাপোটে গাছ থেকে এই চিকল সংগ্রহ করা হয়, তা বড় হতে অনেক সময় নেয় এবং অতিরিক্ত রস সংগ্রহ করলে গাছগুলো মরে যায়। তাই, ১৯৫০-এর দশকে, চাহিদা মেটাতে হিমশিম খেয়ে চুইংগাম কোম্পানিগুলো রসায়ন বিজ্ঞানের নতুন উদ্ভাবন: সিন্থেটিক রাবার এবং প্লাস্টিকের দিকে ঝুঁকে পড়ে।
আজ, বেশিরভাগ কোম্পানির চুইংগামের ভিত্তি হলো সিন্থেটিক এবং প্রাকৃতিক উপাদানের এক গোপন মিশ্রণ। যদি প্যাকেটে 'গাম বেস' উপাদান হিসেবে লেখা থাকে, তবে সম্ভবত সেই চুইংগামে সিন্থেটিক পলিমার বা প্লাস্টিক রয়েছে। মার্কিন খাদ্য ও ঔষধ প্রশাসন চুইংগামের ভিত্তিতে কয়েক ডজন অনুমোদিত খাদ্য-গ্রেড উপাদান ব্যবহারের অনুমতি দেয়।
এর মধ্যে রয়েছে পলিথিন (সবচেয়ে সাধারণ প্লাস্টিক, যা প্লাস্টিকের ব্যাগ এবং দুধের জগে ব্যবহৃত হয়), পলিভিনাইল অ্যাসিটেট (এক ধরনের প্লাস্টিক যা আঠাতেও পাওয়া যায়), এবং স্টাইরিন-বুটডাইন রাবার (সাধারণত গাড়ির টায়ারে ব্যবহৃত হয়)।
শিল্প বিশেষজ্ঞদের মতে, চুইংগামের অনেক আকর্ষণীয় গুণাবলীই আসে এই সিন্থেটিক পলিমার থেকে। যেমন, পলিভিনাইল অ্যাসিটেট বাবল বা ফানুসকে সহজে ফাটতে দেয় না। স্টাইরিন-বুটডাইন রাবার চুইংগামকে এমন এক স্থিতিস্থাপকতা দেয়, যা এটিকে দাঁতে আটকে যাওয়ার পরিবর্তে নিজের সাথেই লেগে থাকতে সাহায্য করে। আর পলিথিন চুইংগামকে নরম করতে ব্যবহৃত হয়, যাতে চিবোতে গিয়ে চোয়াল ক্লান্ত না হয়।
মাইক্রোপ্লাস্টিকের মারাত্মক ঝুঁকি
কিন্তু প্লাস্টিকের চুইংগামও একভাবে ভেঙে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, চুইংগাম চিবানোকে মাইক্রোপ্লাস্টিক গ্রহণের সাথে যুক্ত করা হয়েছে। ডিসেম্বরে প্রকাশিত একটি গবেষণায়, যুক্তরাজ্যের গবেষকরা একজন স্বেচ্ছাসেবককে এক ঘণ্টা ধরে এক টুকরো চুইংগাম চিবোতে বলেন। এক ঘণ্টা চিবানোর পর, তার লালায় ২,৫০,০০০-এরও বেশি মাইক্রো এবং ন্যানো প্লাস্টিকের টুকরো পাওয়া গেছে—যা এক লিটার বোতলজাত জলে পাওয়া মাইক্রোপ্লাস্টিকের সমান!
বিজ্ঞানীরা এখনও মাইক্রোপ্লাস্টিক গ্রহণের স্বাস্থ্যগত প্রভাব সম্পর্কে জানার চেষ্টা করছেন। মাইক্রোপ্লাস্টিক মানুষের যকৃত, কিডনি, মস্তিষ্ক, ফুসফুস, অন্ত্র, এমনকি বুকের দুধেও পাওয়া গেছে। ইঁদুরের ওপর কিছু গবেষণা ইঙ্গিত দেয় যে, মাইক্রোপ্লাস্টিকের ক্ষতি করার ক্ষমতা রয়েছে এবং এটি শ্বাসযন্ত্র, পরিপাক এবং প্রজনন সংক্রান্ত সমস্যার সাথে যুক্ত হতে পারে, এমনকি কোলন এবং ফুসফুসের ক্যান্সারের কারণও হতে পারে।
ভবিষ্যৎ কী?
ক্ষুদ্র প্লাস্টিকের কণা গ্রহণ এখন যেন জীবনেরই এক অংশ হয়ে গেছে। কিন্তু গত ১০ বছরে মানুষ তাদের খাবারে প্লাস্টিকের কণা প্রবেশ করা নিয়ে বেশ ভীত হয়ে পড়েছে। তারা প্লাস্টিকের পাত্রে খাবার গরম করা বা প্লাস্টিকের বোতলে জল পান করা নিয়ে চিন্তিত। চুইংগাম বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই উদ্বেগের কারণ হয়নি, তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অন্যান্য কারণে এর জনপ্রিয়তা কমছিল।
সেই হারানো বাজার ফিরে পেতে, চুইংগাম কোম্পানিগুলো এখন সিন্থেটিক চুইংগামকে সুস্থতার একটি হাতিয়ার হিসেবে তুলে ধরছে। ঠিক রিগলির মতোই, তারা বাজি ধরছে যে মানুষ চুইংগামের উপকারিতার দিকেই মনোযোগ দেবে এবং এর ভেতরে থাকা প্লাস্টিকের কথা নিয়ে খুব বেশি ভাববে না। তবে, যারা আরও প্লাস্টিক গ্রহণের বিষয়ে চিন্তিত, তাদের জন্য চুইংগামের প্যাকেটটি হাতে না নেওয়াই হয়তো সবচেয়ে সহজ এবং বুদ্ধিমানের কাজ।
