শৈশবে অতিরিক্ত চিনি খাওয়া যেভাবে শিশুর সারা জীবনের ওপর প্রভাব ফেলে
বাবা-মায়েরা বহুদিন ধরেই জানেন যে অতিরিক্ত চিনি সন্তানের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণাগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, এর ক্ষতি কতটা মারাত্মক হতে পারে। সম্প্রতি সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, এর বিপদ প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত পিছু ছাড়ে না। শৈশবে যারা অতিরিক্ত প্রক্রিয়াজাত চিনি খেয়েছে, প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় তাদের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ এবং টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি অনেক বেশি। এই গবেষণা স্পষ্ট করে দিয়েছে, শিশুদের জন্য চিনির নিরাপদ মাত্রা বর্তমানে তারা যা খাচ্ছে, তার চেয়ে অনেক কম।
অতিরিক্ত চিনি প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যও ক্ষতিকর, তবে শৈশবে যখন শিশুদের খাদ্যাভ্যাস তৈরি হয়, তখন এটি বিশেষভাবে বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী এবং এই গবেষণার সহ-লেখক তাদেজা গ্রাসনার বলেন, "আপনি যদি শৈশবে মিষ্টি খাবারের প্রতি আকৃষ্ট হন, তবে সারা জীবনই আপনার মিষ্টির প্রতি টান থাকবে। যার এই অভ্যাস নেই, তার তুলনায় আপনার এই টান অনেক বেশি হবে।"
ফলমূলের মতো কিছু খাবারে প্রাকৃতিক চিনি থাকলেও, প্রক্রিয়াজাত খাবারের মাধ্যমে আমাদের শরীরে অতিরিক্ত চিনি প্রবেশ করে। আমেরিকার শিশুরা প্রচুর পরিমাণে প্রক্রিয়াজাত চিনি খায়—গড়ে প্রতিদিন প্রায় ১৭ চা চামচ, যা প্রায় ৩০০ ক্যালোরির সমান।
এই পরিমাণটি দুই বছরের বেশি বয়সী শিশুদের জন্য নির্ধারিত দৈনিক ক্যালোরির ১০ শতাংশের চেয়ে অনেক বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, এই পরিমাণ ৫ শতাংশের নিচে থাকা উচিত। ১০ শতাংশ মানে শিশুর বয়স অনুসারে প্রায় ১০০ থেকে ২০০ ক্যালোরি। আর দুই বছরের কম বয়সী শিশুদের কোনোভাবেই প্রক্রিয়াজাত চিনি খাওয়ানো উচিত নয়।
চিনি ছাড়লে কয়েক দিনেই শরীরে পরিবর্তন আসতে পারে
শিশুদের মধ্যে চিনির ব্যবহার কমানো মার্কিন সরকারের হেলদি পিপল ২০৩০ লক্ষ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু এমন একটি সমাজে এই সংখ্যা কমানো বেশ কঠিন, যেখানে ক্যান্ডি বা ললিপপ ছাড়াও কোমল পানীয়, ব্রেকফাস্ট সিরিয়াল, এমনকি শিশুদের খাবারেও চিনির অবাধ ব্যবহার রয়েছে। অনেক শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের চেম্বারেও শিশুদের হাতে ললিপপ তুলে দেওয়া হয়, যা প্রমাণ করে মিষ্টির সঙ্গে শিশুর সম্পর্ক কতটা স্বাভাবিক বলে ধরে নেওয়া হয়েছে।
গ্রাসনার বলেন, "এর মানে এই নয় যে আপনি আপনার সন্তানকে কখনোই মিষ্টি খেতে দেবেন না। তবে আমাদের গবেষণা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য শৈশবে চিনির পরিমাণ কমানো অত্যন্ত জরুরি।"
এক অভিনব প্রাকৃতিক পরীক্ষা
শৈশবের চিনির প্রভাব নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে গ্রাসনার এবং তার সহকর্মীরা এক অভিনব প্রাকৃতিক পরীক্ষার সন্ধান পান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাজ্যে চিনি ও মিষ্টিজাতীয় খাবারের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছিল। এই রেশন ব্যবস্থা ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত চালু ছিল—অর্থাৎ, যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো কেটে যাওয়ার অনেক পর পর্যন্ত।
গবেষকরা রেশন ব্যবস্থা শেষ হওয়ার ঠিক আগে জন্ম নেওয়া শিশুদের সঙ্গে, রেশন উঠে যাওয়ার পরপরই জন্ম নেওয়া শিশুদের স্বাস্থ্যের তুলনা করেছেন। যেহেতু রেশন তুলে নেওয়ার পরপরই চিনির ব্যবহার দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছিল, তাই তারা নিশ্চিতভাবে ধরে নিতে পারেন যে দ্বিতীয় দলটি তাদের জীবনের প্রথম কয়েক বছর অনেক বেশি চিনি খেয়েছে।
যুক্তরাজ্যের একটি বিশাল স্বাস্থ্য তথ্যভান্ডার ব্যবহার করে তারা কয়েক দশক পর প্রায় ৬০,০০০ শিশুর স্বাস্থ্যের ওপর নজর রাখেন। ফলাফল চমকে দেওয়ার মতো! যারা নিয়ন্ত্রিত পরিমাণে চিনি খেয়েছে, প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় তাদের ডায়াবেটিসের ঝুঁকি ৩৫ শতাংশ এবং উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি ২০ শতাংশ কম ছিল।
চিনি শিশুদের শৈশবেই ক্ষতি করে
অন্যান্য গবেষণায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত চিনি শিশুদের শৈশবেই তাদের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে।
চিনিযুক্ত খাবারে ক্যালোরি অনেক বেশি থাকে, যা স্থূলতার অন্যতম কারণ। বর্তমানে আমেরিকার প্রতি পাঁচজন শিশুর মধ্যে একজন স্থূলতার শিকার।
একটি সরকারি কমিটি তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, শিশুদের কোমল পানীয়, প্রক্রিয়াজাত মাংস এবং লবণাক্ত স্ন্যাকস কম খাওয়ালে তাদের স্থূলতার ঝুঁকি কমে।
শিশুদের মধ্যে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের হার বৃদ্ধির পেছনেও অতিরিক্ত চিনি দায়ী। একসময়কার 'প্রাপ্তবয়স্কদের রোগ' হিসেবে পরিচিত এই অসুখটি এখন প্রায় ৫০,০০০ শিশুকে প্রভাবিত করছে। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিদিন ৮ আউন্সের এক গ্লাস মিষ্টি পানীয় খেলে ছেলেদের মধ্যে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স ৩৪ শতাংশ বেড়ে যায়। অন্যদিকে, গবেষকরা ৪৩ জন কৃষ্ণাঙ্গ ও ল্যাটিনো শিশুর খাদ্য তালিকা থেকে চিনির পরিমাণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনেন। মাত্র ৯ দিনেই তাদের লিভারের চর্বি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়, যা ক্যান্সার এবং অন্যান্য রোগ প্রতিরোধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অতিরিক্ত চিনির অন্যান্য প্রভাবের মধ্যে রয়েছে মেয়েদের বয়ঃসন্ধি এগিয়ে আসা এবং দাঁতের ক্ষয় বা ক্যাভিটি বেড়ে যাওয়া।
তবে চিনি খেলে শিশুরা অতি চঞ্চল হয়ে যায়—কয়েক দশক আগের এই ধারণাটি ১৯৯০-এর দশকেই গবেষণায় ভুল প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু এটি মনোযোগের ঘাটতি এবং চঞ্চলতার মতো অন্যান্য মানসিক সমস্যা তৈরি করতে পারে।
অল্প চিনিতেই বড় ক্ষতি
এই ধরনের নেতিবাচক প্রভাবের জন্য খুব বেশি চিনির প্রয়োজন হয় না। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা দৈনিক ক্যালোরির ২৫ শতাংশ চিনি হিসেবে গ্রহণ করেছে, তাদের লিভারে চর্বি ও রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। তবে যারা মাত্র ১০ শতাংশ চিনি গ্রহণ করেছে, তাদের মধ্যেও এই সমস্যা দেখা গেছে।
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি জীববিজ্ঞানী কিম্বার স্ট্যানহোপ বলেন, কোমল পানীয় এবং প্রক্রিয়াজাত খাবারে থাকা উচ্চ ফ্রুক্টোজ কর্ন সিরাপ লিভারের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। কারণ, শরীর যতটা গ্লুকোজ গ্রহণ করতে পারে, ফ্রুক্টোজের ক্ষেত্রে তেমন কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। ফলে অতিরিক্ত ফ্রুক্টোজ সরাসরি লিভারে চর্বি হিসেবে জমা হয়।
সন্তানের খাদ্য তালিকা থেকে চিনি কমানো একটি কঠিন কাজ। মিয়ামির নিক্লাস চিলড্রেন'স হসপিটালের শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ জোশুয়া টারকফ বলেন, এর জন্য আপনাকে শার্লক হোমসের মতো গোয়েন্দা হতে হবে। খাবারের লেবেল পড়া তখনই কাজে দেবে, যখন আপনি জানবেন যে চিনি কয়েক ডজন ভিন্ন নামে থাকতে পারে। যেমন: মল্টোজ, ডেক্সট্রোজ, হাই ফ্রুক্টোজ কর্ন সিরাপ, এমনকি 'ন্যাচারাল ফ্রুট জুস কনসেন্ট্রেট', যা শুনতে স্বাস্থ্যকর মনে হলেও আসলে তা নয়।
শিশুদের বেশি করে পানি এবং কম মিষ্টি পানীয় পান করতে উৎসাহিত করুন। সকালের নাস্তায় প্যাকেটজাত সিরিয়ালগুলো আসলে 'আধা-তরল ডেজার্ট' ছাড়া কিছুই নয়। এর বদলে ফল দিয়ে ওটস খাওয়াতে পারেন।
টারকফ বলেন, "প্রকৃতি চিনিকে দুর্লভ করে তৈরি করেছে, কিন্তু মানুষ তাকে সহজলভ্য করেছে।" শিশুকে শান্ত করার জন্য মিষ্টি ধরিয়ে দেওয়া থেকে বিরত থাকুন, কারণ এটি শৈশবেই চিনির প্রতি এক ধরনের মানসিক আসক্তি তৈরি করতে পারে।
কৃত্রিম মিষ্টির ব্যবহারও ঝুঁকিমুক্ত নয়। ২০২৪ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, সাধারণ সুইটনার সুক্রালোজ স্থূলতা এবং লিভারের প্রদাহের কারণ হতে পারে।
তবে চিনি পুরোপুরি বন্ধ করা বাস্তবসম্মত নয়। গ্রাসনারের মতে, "লক্ষ্য হলো শিশুদের সীমানা শেখানো—কখন এবং কতটা চিনি খেতে হবে।" শৈশবে তৈরি হওয়া এই অভ্যাসই তাদের সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে।
