কাদামাটি আর সৌরশক্তিতে গড়া বিশ্বের প্রথম 'নেট-জিরো এনার্জি' মসজিদ

একদিকে হাজার বছরের পুরনো কাদামাটি দিয়ে দেয়াল গাঁথার কৌশল, আর অন্যদিকে রয়েছে একেবারে অত্যাধুনিক সৌর প্রযুক্তি। দুটোকে কি মেলানো যায়? ঠিক এই অসম্ভবকে সম্ভব করেই আবুধাবিতে তৈরি হচ্ছে বিশ্বের প্রথম 'নেট-জিরো এনার্জি' মসজিদ।
এর মানে হলো, মসজিদটি নিজের চলার জন্য যতটুকু শক্তি দরকার, তার পুরোটাই নিজেই তৈরি করবে। আর পরিবেশের ওপর এর কোনো বাজে প্রভাব পড়বে না, কারণ এটি কোনো কার্বনই নিঃসরণ করবে না। এই বছরের অক্টোবর মাসেই মসজিদটি খুলে দেওয়ার কথা রয়েছে।
আবুধাবি শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে টেকসই শহর 'মাসদার সিটি' এই অসাধারণ মসজিদটি তৈরি করছে। এর নকশা করেছে বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ সংস্থা অরুপ । মসজিদটি তার প্রয়োজনীয় ১০০% শক্তিই সৌর প্যানেলের মাধ্যমে উৎপাদন করবে। এছাড়াও, এতে এমন কিছু অভিনব পদ্ধতি ব্যবহার করা হবে, যাতে স্বাভাবিকের চেয়ে এক-তৃতীয়াংশ কম শক্তি এবং অর্ধেকেরও বেশি জল খরচ হবে।
তবে কাজটা মোটেও সহজ ছিল না। ডিজাইনারদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল মসজিদের দিক ঠিক রাখা। কারণ, মসজিদের কিবলা প্রাচীরকে সবসময় মক্কার দিকে মুখ করে রাখতে হয়। কিন্তু সূর্যের তাপ থেকে বাঁচতে প্রায়শই ভবনের দিক পরিবর্তন করার দরকার হয়।
তাই প্রকৌশলীরা কিছু দারুণ কৌশল বের করেছেন। যেমন, তাঁরা ব্যবহার করেছেন বিশেষ ধরনের ছাউনি, কোণাকুণি জানালা, এবং ছাদে আলোর ব্যবস্থা। দেয়ালের ভেতরে দেওয়া হয়েছে তাপ নিরোধক আস্তরণ, আর বাইরের অংশে ব্যবহার করা হয়েছে শীতল উপকরণ।
প্রাচীন অনুপ্রেরণায় আধুনিক নির্মাণ
এই মসজিদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো এর বিশাল মাটির প্রাচীর। সংযুক্ত আরব আমিরাতের সবচেয়ে পুরনো আল বিদিয়াহ মসজিদের থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে এটি তৈরি। প্রায় পনেরো শতকের ওই মসজিদটিও মাটি দিয়েই গড়া হয়েছিল।

এই নতুন মসজিদেও স্থানীয় খনি থেকে মাটি এনে ৬০ মিটার চওড়া আর ৭ মিটার উঁচু এক বিশাল কিবলা প্রাচীর তৈরি করা হয়েছে। এর মূল কাজ হলো গনগনে সূর্যের তাপকে মসজিদের ভেতরে ঢুকতে না দেওয়া। মাসদার সিটির একজন কর্মকর্তা আমনা আল জাবি বলেন, "এত বড় আকারের মাটির কাঠামো সংযুক্ত আরব আমিরাতে আগে কখনো তৈরি হয়নি।"
মসজিদটিতে প্রায় ১,৩০০ মানুষ একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারবেন। আর এর ভেতরে লাগানো থাকবে স্মার্ট সেন্সর। এই সেন্সরগুলো ভেতরের তাপমাত্রা, আর্দ্রতা আর কতজন মানুষ আছে, তা সবসময় মাপতে থাকবে। যখন প্রয়োজন, ঠিক তখনই পাখা বা এসি চালু হবে। ফলে অযথা শক্তি নষ্ট হবে না।
আল জাবি আশা করেন, এই মসজিদটি ভবিষ্যতের অন্য সব মসজিদ, এমনকি অন্যান্য সামাজিক ভবনের জন্যও একটি মডেল বা 'ব্লুপ্রিন্ট' হয়ে উঠবে।
ন্যূনতম নকশা, আধুনিক ভাবনা
আবুধাবির খলিফা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক খালেদ আলাওয়াদি মনে করেন, পরিবেশবান্ধব মসজিদ বানানো খুবই ভালো উদ্যোগ। তবে এর চেয়েও বেশি জরুরি হলো বসবাসের বাড়িগুলোকে আরও পরিবেশবান্ধব করে তোলা। তিনি আরও বলেন, "মসজিদগুলোতে যদি আরও প্রাকৃতিক আলোর ব্যবস্থা করা যায় বা শীতকালে বাতাস চলাচলের সুব্যবস্থা রাখা যায়, তাহলে সেটাও অনেক বড় একটা ব্যাপার হবে।"

আসলে, এই নিট-জিরো মসজিদটি সংযুক্ত আরব আমিরাতে পবিত্র স্থানগুলোকে নতুন করে সাজানোর এক বড় আন্দোলনেরই অংশ। যেমন, মাসদার সিটিতেই গত বছর চালু হওয়া এস্তিদামা মসজিদ। সেটিও সৌরশক্তি ব্যবহার করে এবং ব্যবহৃত জল পুনরায় পরিশোধন করে কাজে লাগায়। আবার আবুধাবির আব্রাহামিক ফ্যামিলি হাউস নামের একটি কমপ্লেক্সে একটি মসজিদ, একটি সিনাগগ এবং একটি গির্জা পাশাপাশি তৈরি করা হয়েছে। সেগুলোর নকশাও একদম সাদামাটা আর আধুনিক।
এক্স আর্কিটেক্টস ফার্মের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ফরিদ ইসমাইল বলেন, "আমরা এমন একটি মসজিদ তৈরি করতে চেয়েছিলাম যা ইসলামিক স্থাপত্য দ্বারা অনুপ্রাণিত, কিন্তু একই সাথে আজকের সমাজ, সংস্কৃতি এবং প্রযুক্তিকেও তুলে ধরে।"
স্থপতিরা বলছেন, গত এক দশকে মসজিদের নকশার ভাষাটাই যেন বদলে গেছে। অধ্যাপক আলাওয়াদির মতে, মসজিদের মূল উপাদান—যেমন মিনার, গম্বুজ আর মিহরাব—এগুলো থাকতেই হবে। এগুলো ঠিক রেখে বাকি নকশাটা যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যেকোনো রকম হতে পারে। আর এটাই আধুনিক মসজিদ স্থাপত্যের সৌন্দর্য।