শুধু ধনকুবেরদের জন্য আবুধাবির কৃত্রিম সার্ফিং, এক সেশনে গুনতে হয় লাখ টাকা!

সার্ফারদের জন্য যা যা দরকার, তার প্রায় সবকিছুই আবুধাবিতে ছিল। ছিল উষ্ণ আবহাওয়া, ঝকঝকে রোদ আর কাচের মতো স্বচ্ছ পানি। শুধু একটা জিনিসই ছিল না—ঢেউ।
তবে ২০২৪ সালের অক্টোবরে সেই চিত্র পুরোপুরি বদলে যায়। চালু হয় 'সার্ফ আবুধাবি'। বিশ্বের দীর্ঘতম কৃত্রিম ঢেউ উপহার দিয়ে এই সংস্থাটি এখন আবুধাবিকে সার্ফিংয়ের এক বৈশ্বিক তীর্থস্থানে পরিণত করতে চায়।
এই ওয়েভ পুলটি প্রায় ৭০০ মিটার দীর্ঘ! এখানে একটানা এক মিনিট ধরে একটি ঢেউয়ের ওপর ভেসে থাকা যায়। বিশ্বের অন্য সব ওয়েভ পুল যেখানে মিঠা পানি ব্যবহার করে, সেখানে সার্ফ আবুধাবি আরব উপসাগর থেকে সরাসরি ৮০ মিলিয়ন লিটার নোনা পানি তুলে এনেছে। তবে সেই পানি কিছুটা বিশুদ্ধ করে লবণাক্ততা কমানো হয়েছে।
পানির নিচে থাকা বিশাল এক ডানা যেন জাদুর মতো এই ঢেউ তৈরি করে। পুলের তলদেশকে এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে, যা ঢেউটিকে নিখুঁতভাবে ভাঙতে সাহায্য করে। সার্ফ আবুধাবির জেনারেল ম্যানেজার রায়ান ওয়াটকিন্স বলেন, "এই ডিজাইনটাই হলো আসল জাদু, আর এটা আমাদের পেটেন্ট করা।"
এই অবিশ্বাস্য প্রযুক্তির পেছনের কারিগর হলেন কেলি স্লেটার, ইতিহাসের কিংবদন্তী সার্ফার। ক্যালিফোর্নিয়ায় তার তৈরি 'সার্ফ র্যাঞ্চ' ওয়েভ পুলটিই প্রথম সারাবিশ্বে আলোড়ন ফেলেছিল। সেই একই প্রযুক্তির আরও উন্নত সংস্করণ ব্যবহার করা হয়েছে আবুধাবিতে।
সেই নিখুঁত ঢেউয়ের খোঁজ
১৯৬৬ সালের 'দি এন্ডলেস সামার' নামের একটি তথ্যচিত্র সার্ফারদের মনে 'নিখুঁত ঢেউয়ের' স্বপ্ন গেঁথে দিয়েছিল। কিন্তু প্রকৃতির সেই নিখুঁত ঢেউ পাওয়া ছিল ভাগ্যের ব্যাপার।
কিন্তু সার্ফ আবুধাবির ঢেউ নিয়ে কোনো সংশয় নেই, এটি প্রতিবারই নিখুঁত। ওয়াটকিন্স বলেন, "আমরা সংখ্যার চেয়ে মানের ওপর বিশ্বাসী। আমরা বিশ্বের সেরা ঢেউ তৈরি করি, সবচেয়ে বেশি নয়।" তাদের ৮০ শতাংশের বেশি গ্রাহক বিদেশি পর্যটক, যারা শুধু এই ঢেউয়ের অভিজ্ঞতা নিতেই হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে আসেন। তাদের লক্ষ্য বাজারের সবচেয়ে বিলাসী ভ্রমণকারীরা।
তবে এই নিখুঁত ঢেউয়ের অভিজ্ঞতা পেতে হলে গুনতে হয় মোটা অঙ্কের টাকা। এখানে একসাথে মাত্র চারজন সার্ফার পুলে নামতে পারেন। প্রত্যেককে দিতে হয় ৩৫০০ দিরহাম, যা প্রায় ৯৫০ ডলার (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১ লাখ ১৫ হাজার টাকা)। বিনিময়ে প্রত্যেক সার্ফার ছয়টি নিশ্চিত ঢেউ পান। তবে বেশিরভাগ গ্রাহকই ৯০ মিনিটের জন্য ২০,০০০ দিরহাম (প্রায় ৫,৪৫০ ডলার বা সাড়ে ৬ লক্ষ টাকা) দিয়ে পুরো পুলটাই ব্যক্তিগতভাবে ভাড়া নিয়ে নেন।
ওয়াটকিন্স বলেন, এই চড়া দামের পেছনে কারণও আছে। "আমাদের এখানে একটানা ৫৫ সেকেন্ড দীর্ঘ রাইড পাওয়া যায় এবং আপনি দুটি নিখুঁত 'টিউব' (ভেঙে পড়া ঢেউয়ের ভেতরের গোলাকার অংশ) পাবেন।" গ্রাহকদের জন্য রয়েছে কোচের ব্যবস্থা, এমনকি সার্ফিং শেষে ভিডিও দেখে নিজের ভুলগুলো শুধরে নেওয়ার সুযোগও।
সাগরের বিকল্প, নাকি শুধুই বিনোদন?
ফেলিপ্পে দা পিয়েরো একটি বিলাসবহুল সার্ফ ভ্রমণ ব্যবসা চালান। তিনি সিইও এবং ধনকুবেরদের নির্জন ঢেউয়ের সন্ধানে পৃথিবীর দুর্গম সব কোণে নিয়ে যান। এমন একটি চার দিনের ভ্রমণের খরচ শুরু হয় প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার ডলার থেকে।
দা পিয়েরো জানান, তার অনেক ক্লায়েন্টই এখন ওয়েভ পুলে সার্ফিং শিখছেন, কারণ এখানকার ঢেউ অনুমানযোগ্য এবং নিয়ন্ত্রিত। ব্যস্ত পেশাদারদের জন্য এটি দারুণ। তিনি নিজেও তার গ্রাহকদের মালদ্বীপ বা ইন্দোনেশিয়া যাওয়ার পথে আবুধাবির এই পুলে ওয়ার্ম-আপের জন্য নিয়ে আসেন।

তবে দা পিয়েরোর মতে, ওয়েভ পুল কখনোই সাগরের বিকল্প হতে পারে না। "ঢেউয়ের ওপর দাঁড়িয়ে ১০০ মিটার এগিয়ে যাওয়া মানেই সার্ফিং নয়।" তার ক্লায়েন্টরা তার কাছে আসেন 'প্রকৃতির সাথে, সাগরের ছন্দের সাথে সংযোগ' স্থাপন করতে। তিনি বলেন, "সাগরে ঝাঁপ দেওয়ার পর আপনি জানেন না পরের ঢেউটি আপনার জীবনের সেরা ঢেউ হবে, নাকি সবচেয়ে ভয়ঙ্কর আছাড় খাওয়ার কারণ হবে।"
তবে ওয়াটকিন্সের মতে, সাগরের এই অনিশ্চয়তাই অনেককে খেলাটি থেকে দূরে রাখে। ওয়েভ পুল সার্ফিংকে সবার জন্য সহজ করে তুলেছে। পুলের নিরাপত্তা এবং গোপনীয়তা এটিকে সিইও এবং তারকাদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। ক্রিস হেমসওয়ার্থ, লুইস হ্যামিল্টনের মতো তারকারা যেমন এখানকার নিয়মিত গ্রাহক, তেমনি ক্যালিফোর্নিয়ায় অবস্থিত স্লেটারের অন্য বিখ্যাত পুলটিতেও প্রিন্স হ্যারি এবং ইভাঙ্কা ট্রাম্পকে দেখা গেছে।
ওয়াটকিন্স বলেন, "গলফের জগতে আমরা হলাম 'অগাস্টা' (বিশ্বের সবচেয়ে অভিজাত গলফ কোর্স)। এখন সবাই সার্ফার হতে চায়। কিন্তু তারা যেমন-তেমন ঢেউ চায় না, তারা চায় নিখুঁত ঢেউ।"
কেলি স্লেটার একসময় স্বপ্ন দেখতেন, ওয়েভ পুল সার্ফিংকে "ফুটবলের মতো জনপ্রিয়" করে তুলবে। তবে বর্তমানে তার এই যুগান্তকারী প্রযুক্তিতে চালিত পুল রয়েছে মাত্র দুটি—একটি ক্যালিফোর্নিয়ার সেই বিখ্যাত সার্ফ র্যাঞ্চ, এবং অন্যটি সার্ফ আবুধাবি। আবুধাবির পুলটি তৈরি করতে প্রায় ৯০ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে বলে জানা গেছে।
অবশ্য, বিশ্বে আরও অনেক ওয়েভ পুল রয়েছে। ওয়াটকিন্স ব্যাখ্যা করেন, "নিখুঁত ঢেউ কেমন হবে, তা নিয়ে প্রত্যেকের ধারণা ভিন্ন।"
তাহলে সার্ফ আবুধাবি কি সেই নিখুঁত ঢেউ তৈরি করতে পেরেছে? ওয়াটকিন্স হেসে বলেন, "আমরা এর একটি সংস্করণ তৈরি করেছি।"