স্বচ্ছ সোলার প্যানেল: বদলে দেবে নবায়নযোগ্য শক্তির ভবিষ্যৎ?


আমাদের ব্যস্ত শহর এবং তার ঘিঞ্জি ভবনের ভিড়ে পর্যাপ্ত খোলা জায়গা পাওয়া যেন বিলাসিতা। ছাদের জায়গা সীমিত, খোলা জমি প্রায় নেই বললেই চলে—ফলে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের সুযোগও সীমিত। প্রচলিত সোলার প্যানেল কার্যকর হলেও যে পরিমাণ জায়গা দরকার, তা আমাদের নেই।
কিন্তু ভাবুন তো, আমাদের চারপাশের জানালার কাচ, আকাশচুম্বী ভবনের কাচ কিংবা মোবাইল ফোনের স্ক্রিনের কাচ নিজে থেকেই বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারত ?
এই ধারণাকে বাস্তবে রূপ দিচ্ছে স্বচ্ছ সৌর প্যানেল। যুগান্তকারী এই প্রযুক্তি নিত্যদিনের শহুরে জীবনে নবায়নযোগ্য শক্তি তৈরির এক অসাধারণ সম্ভাবনা তৈরি করেছে।
সাধারণ কাচকেই যখন বিদ্যুৎ উৎপাদনের 'অদৃশ্য' উৎসে পরিণত করা যায়, তখন প্রচলিত সৌর প্যানেলের মতো অতিরিক্ত জায়গার দরকার পড়ে না, আবার আধুনিক স্থাপত্যের সৌন্দর্যও বজায় থাকে। এটি শুধু নতুন প্রযুক্তিই নয়, বরং টেকসই ভবিষ্যতের পথে একটি স্বচ্ছ, বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ।
২০১৪ সালে মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির (এমএসইউ) গবেষকরা প্রথম সম্পূর্ণ স্বচ্ছ সৌর প্যানেল তৈরি করেন। এই প্যানেলগুলো অদৃশ্য আলো, যেমন অতিবেগুনি ও ইনফ্রারেড শোষণ করে বিদ্যুতে পরিণত করে, কিন্তু চোখে পড়ার মতো আলো আটকে রাখে না, তাই দেখতে সম্পূর্ণ স্বচ্ছ থাকে।
প্রথম ধাপের প্যানেলগুলো মাত্র ১ শতাংশ দক্ষতা দেখালেও এখন তা প্রায় ৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ভবিষ্যতে আরও উন্নতির সম্ভাবনা রয়েছে। এমএসইউ-র প্রধান গবেষক রিচার্ড লান্টের মতে, এই প্রযুক্তি আকাশচুম্বী ভবনের জানালা থেকে মোবাইল ফোনের স্ক্রিন পর্যন্ত যেকোনো স্বচ্ছ কাচকে শক্তি উৎপাদনের উৎসে রূপান্তর করবে এবং সৌর শক্তিকে নতুন মাত্রা দেবে।
অন্যদিকে, প্যারিস জলবায়ু চুক্তির বহু বছর পেরিয়ে গেলেও বিশ্ব এখনও নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথে নিরন্তর গবেষণা ও উদ্ভাবনে ব্যস্ত। জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে বিভিন্ন দেশ।
এই পরিপ্রেক্ষিতে দক্ষিণ কোরিয়ার ইনচিওন ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীরা সম্পূর্ণ স্বচ্ছ সৌর সেল তৈরিতে বড় সাফল্য অর্জন করেন। সম্প্রতি জার্নাল অভ পাওয়ার সোর্সেস-এ প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে এমনটাই জানিয়েছে অধ্যাপক জুনডং কিমের নেতৃত্বে পরিচালিত গবেষকদল।

এ গবেষণায় বলা হয়েছে, সোলার প্যানেলের 'হেটারোজাংশন' অংশে একধরনের পাতলা স্ফটিকীয় স্তর তৈরি করা হয়েছে, যা সূর্যের আলো শোষণ করে তাকে বিদ্যুতে রূপান্তর করতে সক্ষম। বিশেষ প্রযুক্তিতে তৈরি এই স্তরের মাধ্যমেই সৌরশক্তি কার্যকরভাবে ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে।
এই স্বচ্ছ সোলার প্যানেল তৈরির মূল কৌশল হলো দুটি উপাদান—নিকেল অক্সাইড ও টাইটানিয়াম ডাইঅক্সাইড-এর সংমিশ্রণ। টাইটেনিয়াম ডাইঅক্সাইড একটি পরিচিত, পরিবেশবান্ধব ও সহজলভ্য অর্ধপরিবাহী (সেমিকন্ডাক্টর), যা ইতোমধ্যেই সৌর প্রযুক্তিতে ব্যবহৃত হচ্ছে। অপরদিকে, নিকেল অক্সাইডের রয়েছে উচ্চ আলোক স্বচ্ছতা ও কম তাপমাত্রায় উৎপাদনের সুবিধা। এ দুই উপাদানের সমন্বয়েই তৈরি হয়েছে কার্যকর, পরিবেশবান্ধব এবং সম্পূর্ণ স্বচ্ছ এই সোলার সেল।
স্বচ্ছ সৌর প্যানেল কীভাবে কাজ করে?
স্বচ্ছ সৌর প্যানেল প্রচলিত সৌর প্যানেলের মতোই আলো শোষণ করে বিদ্যুৎ তৈরি করে। তবে পার্থক্য হলো, এগুলো কেবল চোখে দেখা না-যাওয়া আলো (যেমন অতিবেগুনি ও ইনফ্রারেড রশ্মি) শোষণ করে, আর দৃশ্যমান আলো কাচের মতোই ভেদ করে চলে যায়। ফলে জানালা বা কাচ স্বাভাবিকভাবে স্বচ্ছই থাকে।
এই প্রযুক্তিতে থাকে একাধিক স্তর—স্বচ্ছ পরিবাহী স্তর, সেমিকন্ডাক্টর বা অর্ধপরিবাহী উপাদান ও সুরক্ষামূলক প্রলেপ—যেগুলো একত্রে কাজ করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সহায়তা করে।
এই নতুন প্যানেল ভবনের কাচ, জানালা বা মোবাইল স্ক্রিনের মতো স্বচ্ছ পৃষ্ঠে বসানো সম্ভব, যা একইসঙ্গে স্বচ্ছতা বজায় রাখে এবং বিদ্যুৎ তৈরি করে—কোনো বাড়তি জায়গা না নিয়েই।
সাইটেকডেইলি-র তথ্যমতে, নবায়নযোগ্য শক্তির বিভিন্ন উৎস—যেমন জল, বায়ু ও তরঙ্গশক্তির তুলনায় সৌরশক্তিকেই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য এবং কার্যকর উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে বহুদিন ধরেই। এই কারণেই সৌরশক্তিকে আরও কার্যকর ও সাশ্রয়ী করার পেছনে দীর্ঘদিন ধরে ব্যাপক গবেষণা ও উন্নয়নে বিশাল বিনিয়োগ করা হয়েছে।

সূর্যালোকের অতিবেগুনি রশ্মিকে সরাসরি বিদ্যুতে রূপান্তর করার ক্ষমতা এর জনপ্রিয়তা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে এখন অনেক বাসাবাড়ি, কারখানা ও প্রতিষ্ঠান সৌরশক্তিকে তাদের প্রধান জ্বালানি হিসেবে বেছে নিচ্ছে।
প্রচলিত সোলার প্যানেল বনাম স্বচ্ছ সোলার প্যানেল
প্রচলিত সোলার প্যানেল বনাম স্বচ্ছ সোলার প্যানেলের কাজের ধরন ও ব্যবহার আলাদা। প্রচলিত সোলার প্যানেল বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনে দক্ষ, তাই সীমিত জায়গায় শক্তি সঞ্চয়ের জন্য এটি উপযুক্ত। অন্যদিকে স্বচ্ছ সোলার প্যানেল যেখানে প্রয়োজন সেখানে 'অদৃশ্য' হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যেমন জানালা বা ইলেকট্রনিক ডিভাইসে। এটি সৌন্দর্য রক্ষা করে পরিবেশবান্ধব শক্তি উৎপাদন সম্ভব করে।
মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষকরা উন্নত প্রযুক্তিতে স্বচ্ছ সোলার প্যানেলের আয়ু প্রায় তিন দশক পর্যন্ত বাড়ানোর সম্ভাবনা দেখিয়েছেন।
তবে উভয় সোলার প্যানেলই গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন এবং জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমায়।
যদিও প্রচলিত সোলার প্যানেল ছাদ ও সৌর খামারে বেশি ব্যবহৃত হয়, অন্যদিকে স্বচ্ছ সোলার প্যানেল জনবহুল এলাকায় হালকা ও বহুমুখী ব্যবহারের জন্য কার্যকর। তবে সারাদিন নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য বৃহৎ ব্যবস্থাপনা ও শক্তি সংরক্ষণ প্রয়োজন।
স্বচ্ছ সোলার প্যানেলের ব্যবহার ও ভবিষ্যৎ
স্বচ্ছ সৌর প্যানেল আলো প্রবাহিত রেখে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে, যা ভবনের জানালা, গ্রীনহাউস, গাড়ির ওপরের ছাঁদ (সানরুফ), স্মার্টফোনের স্ক্রিনসহ বিভিন্ন স্থানে ব্যবহারযোগ্য।
এটি পরিবেশবান্ধব শক্তি সরবরাহে সাহায্য করে আউটডোর শেল্টার, পাবলিক স্পেস, কৃষি ক্ষেত্র ও মহাকাশ গবেষণায় প্রয়োগযোগ্য। শিক্ষামূলক প্রদর্শনী থেকে শুরু করে আবাসিক স্কাইলাইট ও একোয়ারিয়ামে এটিকে শক্তি উৎপাদনের সুবিধাজনক ও স্বচ্ছ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা যায়। ফলে, স্বচ্ছ সৌর প্যানেল ভবিষ্যতে পরিচ্ছন্ন ও টেকসই শক্তির গুরুত্বপূর্ণ উৎস হবে।
স্বচ্ছ সোলার প্যানেল ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হলে তাদের ব্যবহার অগণিত সম্ভাবনার পথ খুলে দেবে। ইলেকট্রনিক্স, যানবাহন, ভবনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তি সঠিকভাবে প্রয়োগ করার জন্য ইঞ্জিনিয়ার, সোলার বিশেষজ্ঞ, স্থপতি ও নির্মাতাদের দক্ষতা থাকা প্রয়োজন।

ভবনের দেয়ালে স্বচ্ছ সোলার প্যানেল সংযোজন করে নবায়নযোগ্য শক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা যাবে। নবায়নযোগ্য শক্তি খাতে নতুন নতুন প্রযুক্তি যেমন পারোভস্কাইট সেমিকন্ডাক্টর, সিলিকনের পরিবর্তে বা কম ব্যবহারের সম্ভাবনা নিয়ে আসছে, যা ভবিষ্যতে সৌর শক্তির গতিপথ বদলে দিতে পারে। তাই বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি পৃথিবীব্যাপী পরিচ্ছন্ন জ্বালানির ভবিষ্যৎ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
- অনুবাদ: আয়েশা হুমায়রা ওয়ারেসা