প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হলো ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ সোলার প্যানেল

দেশীয় শিল্পগোষ্ঠী ইস্ট কোস্ট গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রেডিয়েন্ট অ্যালায়েন্স যুক্তরাষ্ট্রে প্রথমবারের মতো সোলার (সৌর) পিভি মডিউল রপ্তানির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক নবায়নযোগ্য জ্বালানি সরবরাহ চেইনে যুক্ত করল।
রেডিয়েন্টের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, ২০২৫ সালের ১৯ জুন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ক্লিনগ্রিড ইনকরপোরেশনের কাছে প্রথম চালানটি পাঠানো হয়। ২১৫ কোটি টাকারও বেশি মূল্যের চার বছর মেয়াদি এ রপ্তানি চুক্তির আওতায় প্রতিষ্ঠানটি ২০২৮ সাল পর্যন্ত মোট ৬৪ দশমিক ৬০ মেগাওয়াট সোলার মডিউল সরবরাহ করবে। এর মধ্যে ২০২৫ সালেই ১২ দশমিক ৪০ মেগাওয়াট পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
আশুলিয়ার সাভারে অবস্থিত রেডিয়েন্ট অ্যালায়েন্সের সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় কারখানায় ১০০ ও ২০০ ওয়াট ক্ষমতার সোলার মডিউল উৎপাদিত হচ্ছে। বছরে ৬০০ মেগাওয়াট উৎপাদন সক্ষমতার এ কারখানাটি দেশের অন্যতম আধুনিক উৎপাদন প্ল্যান্ট।
রেডিয়েন্ট অ্যালায়েন্সের প্রধান নির্বাহী মাসুদুর রহিম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-কে বলেন, "এটা শুধু আমাদের প্রতিষ্ঠানের নয়, বরং পুরো দেশের জন্যই একটি বড় অর্জন। আমরা প্রমাণ করছি— 'মেইড ইন বাংলাদেশ' এখন বৈশ্বিক ক্লিনটেক বাজারেও প্রতিযোগিতা করতে সক্ষম।"
শিল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই রপ্তানির মাধ্যমে সোলার প্যানেল উৎপাদনে বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনাময় নতুন দেশ হিসেবে উঠে আসছে। বর্তমানে এই খাতের নেতৃত্বে রয়েছে চীন, ভারত ও ভিয়েতনাম। এদিকে, ২০২৬ সালের জন্য আরও ৩০০ মেগাওয়াট সোলার মডিউল সরবরাহের বিষয়ে একটি নতুন চুক্তি নিয়ে আলোচনা চলছে, যা স্থানীয় উৎপাদনের প্রতি আন্তর্জাতিক আস্থার ইঙ্গিত দেয়।
রহিম বলেন, "বাংলাদেশ থেকে কোনো স্থানীয় কোম্পানির সোলার পিভি মডিউল রপ্তানির ঘটনা এটাই প্রথম।" তিনি জানান, রেডিয়েন্ট অ্যালায়েন্স প্রায় ১০ বছর ধরে সোলার হোম সিস্টেমের জন্য পণ্য তৈরি করছিল, যা কেবল দেশের বাজারেই ব্যবহার হতো।
তিনি আরও বলেন, "এখন আমরা আন্তর্জাতিক বাজারের জন্য পণ্য তৈরি করছি।" এ লক্ষ্যেই সম্প্রতি নতুন একটি উৎপাদন লাইন চালু করা হয়েছে।
রেডিয়েন্টের কারখানায় ৫০ ওয়াট থেকে ৭০০ ওয়াট পর্যন্ত বিভিন্ন ক্ষমতার সোলার পিভি মডিউল তৈরি হচ্ছে। এই কারখানায় কোম্পানিটি প্রায় ২ কোটি ডলার বা প্রায় ২২০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে।
বাংলাদেশ সোলার মডিউল প্রস্তুতকারক সমিতির (এসএমএমএবি) সাধারণ সম্পাদক গোলাম বাকী মাসুদ বলেন, "এটি প্রমাণ করে বাংলাদেশ এখন উন্নত মানের নবায়নযোগ্য জ্বালানির পণ্য তৈরি করে রপ্তানি করতে পারছে।" তিনি আরও বলেন, "এটা আমাদের বহু দিনের স্বপ্ন ছিল। আমরা এই দিনের জন্য অপেক্ষা করছিলাম।"
তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্রে চীনা সোলার প্যানেলের ওপর অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক আরোপ করায় বাংলাদেশের জন্য বড় সুযোগ তৈরি হয়েছে।
সোলার মডিউল ম্যানুফ্যাকচারারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এসএমএমএবি) সভাপতি ও রহিমআফরোজ রিনিউয়েবল এনার্জি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুনাওয়ার মিসবাহ মঈন বলেন, "যুক্তরাষ্ট্রে রেডিয়েন্টের রপ্তানি উদ্যোগ দেশীয় অন্যান্য উৎপাদকদের জন্য অত্যন্ত উৎসাহজনক।"
তিনি বলেন, "এর আগে আমরা নেপালে খুব ছোট আকারের প্যানেল রপ্তানি করেছিলাম। এখন বড় আকারের প্যানেল তৈরির প্রয়োজন, যার জন্য বড় বিনিয়োগ দরকার।"
দেশীয় সোলার প্যানেল উৎপাদকরা জানিয়েছেন, বাজারে স্বল্পদামে নিম্নমানের বিদেশি প্যানেল ঢুকে পড়ায় তারা প্রতিযোগিতায় টিকতে হিমশিম খাচ্ছেন। এতে স্থানীয় উৎপাদন খাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং গুণগত মান বজায় রাখা যাচ্ছে না।
এসএমএমএবি সভাপতি বলেন, "দেশে মান নিয়ন্ত্রণের কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেই।"
শিল্পসংশ্লিষ্টরা জানান, সরকারি নজরদারির অভাবে বিদেশি প্যানেলগুলো কম দামে বাজারে বিক্রি হচ্ছে, কিন্তু সেগুলোতে প্রযুক্তিগত ও নিরাপত্তা মান নিশ্চিত করা হচ্ছে না। এতে দেশীয় পণ্যের সঙ্গে সমানভাবে প্রতিযোগিতা করা সম্ভব হচ্ছে না।
এই খাতকে সুরক্ষা দিতে দীর্ঘদিন ধরে এসএমএমএবি দাবি করে আসছে—সরকারি সোলার প্রকল্পগুলোতে বাধ্যতামূলকভাবে স্থানীয় পণ্য ব্যবহারের একটি কোটার ব্যবস্থা চালুর জন্য। প্রস্তাব অনুযায়ী, বিদ্যুৎকেন্দ্র, স্কুল, হাসপাতালসহ বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় ব্যবহৃত সোলার মডিউলের একটি নির্দিষ্ট অংশ স্থানীয় উৎপাদকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করতে হবে।
মুনাওয়ার মঈন বলেন, "আমরা কোনো বিশেষ সুবিধা চাই না। চাই শুধু এমন একটি নীতিগত সহায়তা, যাতে দেশীয় শিল্প মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে।"