সুভাষ ঘাই: ১৫ বছরে তৈরি করেন ৭ ব্লকবাস্টার! চার অভিনেতাকে বানিয়েছেন সুপারস্টার; ‘তারকা তৈরির কারিগর’

মুম্বাইয়ের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে রোজ হাজারো স্বপ্ন ভাঙে আর গড়ে। এখানে টিকে থাকার লড়াইটা ভীষণ কঠিন। অনেকেই হারিয়ে যান ভিড়ের মধ্যে। কিন্তু এমনও একজন ছিলেন, যার গল্পটা ছিল ঠিক উল্টো। পুনের ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে অভিনয়ের প্রশিক্ষণ নিয়েও একের পর এক প্রযোজকের দরজা থেকে ফিরতে হয়েছে তাকে। অভিনেতা হওয়ার স্বপ্ন যখন ফিকে হয়ে আসছিল, তখন তিনি কলম তুলে নিলেন। ঠিক করলেন, অন্যের লেখা সংলাপে নয়, নিজের লেখা গল্পেই তিনি রাজত্ব করবেন।
আর তারপর? তারপরের ১৫টা বছর ছিল এক ইতিহাস। যে হাত দিয়ে লেখা স্ক্রিপ্ট একদিন বাতিল হয়েছিল, সেই হাতেই তৈরি হলো ৭টি কালজয়ী ব্লকবাস্টার। জন্ম হলো জ্যাকি শ্রফ, মহিমা চৌধুরীর মতো তারকাদের। তিনিই সুভাষ ঘাই।
১৯৪৫ সালের ২৪ জানুয়ারি মুম্বাইয়ের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে তার জন্ম। তবে শৈশব কেটেছে নাগপুরে, দাদা-দাদির আদরে। ছোটবেলা থেকেই মঞ্চ আর গল্পের দুনিয়া তাকে টানত। স্কুল-কলেজে অভিনয়ের জন্য জিতে নিয়েছেন বহু পুরস্কার। পড়ালেখা শেষে বাবাকে নিজের স্বপ্নের কথা জানিয়ে পা বাড়ালেন সিনেমার জগতে। সোজা ভর্তি হলেন পুনের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়াতে। সেখান থেকে ডিপ্লোমা নিয়েই স্বপ্নপূরণের আশায় পা রাখলেন মুম্বাইয়ের মাটিতে।

কিন্তু পথটা সহজ ছিল না। প্রশিক্ষণ থাকা সত্ত্বেও অভিনয়ের সুযোগ যেন সোনার হরিণ! পেট চালানোর জন্য ছোটখাটো চরিত্রে কাজ করতে লাগলেন। তবে দ্রুতই বুঝলেন, এভাবে হবে না। নিজের ভাগ্য নিজেকেই গড়তে হবে।
সুভাষ ঘাই ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন অভিনেতা হিসেবে। 'তকদীর' ছবিতে মাত্র ১,০০০ রুপির বিনিময়ে ফরিদা জালালের প্রেমিকের চরিত্রে অভিনয় করেন। তিনি নিজেই একবার বলেছিলেন, "প্রযোজকরা আমাকে সম্মান করতেন, কিন্তু কাজ দিতেন না।" সাফল্যের প্রথম আলো দেখালেন গুরু দত্তের ভাই আত্মারাম। তিনি সুভাষ ঘাইকে 'উমং' ছবিতে সুযোগ দেন। সুভাষ ঘাইয়ের কথায়, "আমাকে আরও ২১ জন তরুণের সাথে মাসে ৭০০ টাকায় নেওয়া হয়েছিল। এর কিছুদিন পরেই আমি রেহানাকে (মুক্তা) বিয়ে করি।"
কিন্তু অভিনয়ে মন বসছিল না, ঝুঁকলেন চিত্রনাট্য লেখার দিকে। এখানেই তিনি খুঁজে পেলেন তার আসল সত্তা। তার লেখা গল্প পরিচালকদের নজর কাড়তে শুরু করে।

সাফল্যের রাজপথে
'কালীচরণ' এবং 'বিশ্বনাথ'-এর মতো ছবি সুভাষ ঘাইকে পরিচালক হিসেবে পরিচিতি এনে দেয়। তবে 'গৌতম গোবিন্দ' বা 'ক্রোধী'-এর মতো ফ্লপ ছবিও হজম করতে হয়েছে। ১৯৮০ সালের 'কর্জ' ছবিটি বক্স অফিসে ঝড় না তুললেও, ইন্ডাস্ট্রিতে তার আসন পাকা করে দেয়। আসল চমক আসে 'বিধাতা' দিয়ে। দিলীপ কুমার আর সঞ্জয় দত্তকে নিয়ে বানানো এই ছবি বক্স অফিসে রীতিমতো আগুন ধরিয়ে দেয়! এই সাফল্যের পরেই তিনি নিজের প্রযোজনা সংস্থা খোলার সাহস পান।
তারকা তৈরির কারিগর
সুভাষ ঘাইয়ের আরেক নাম হয়ে ওঠে 'স্টার মেকার'। নতুন প্রতিভাদের সুযোগ দেওয়াই ছিল তার নেশা। তিনি বলতেন, "আমি ঠিক করেছিলাম, কেবল নতুনদের নিয়েই কাজ করব।" তার 'হিরো' ছবিতেই জন্ম হয় দুই নতুন তারকার—জ্যাকি শ্রফ এবং মীনাক্ষী শেষাদ্রি। অভিনয়ের 'অ-আ-ক-খ' না জানা জ্যাকিকে তিনি নিজের হাতে গড়েপিটে তৈরি করেন। 'হিরো' টানা ৭৫ সপ্তাহ প্রেক্ষাগৃহে চলেছিল, যা তাকে বলিউডের অন্যতম সেরা পরিচালকের তকমা দেয়।

এরপর 'পরদেশ' ছবিতে মহিমা চৌধুরী বা 'সওদাগর'-এ মনীষা কৈরালার মতো তারকাদের জন্মও তার হাত ধরেই। অনিল কাপুর থেকে শুরু করে অনুপম খের, বলিউডের বহু উজ্জ্বল নক্ষত্র তার ছোঁয়ায় আলোকিত হয়েছে।
এক 'শোম্যান'-এর কথা
একজন সাধারণ অভিনেতা থেকে বলিউডের কিংবদন্তি 'শোম্যান' হয়ে ওঠার এই গল্পটা শুধুই সুভাষ ঘাইয়ের নয়, এ যেন হার না মানা এক স্বপ্নের গল্প। অসাধারণ গল্প বলার ভঙ্গি আর জহুরির মতো প্রতিভা চেনার ক্ষমতা—এই দুইয়ের মিশেলে তিনি বদলে দিয়েছেন বহু অভিনেতার ভাগ্য, আর তৈরি করেছেন বলিউডের ব্লকবাস্টার সিনেমার এক নতুন ইতিহাস। তার সিনেমার গান, নাটকীয়তা আর আবেগ আজও দর্শকদের মনে গেঁথে আছে।