মোহাম্মদপুরে মা-মেয়ে হত্যা: গলার পোড়া দাগের সূত্র ধরে যেভাবে ধরা পড়লেন আয়েশা
রাজধানীর মোহাম্মদপুরে মা ও মেয়েকে হত্যার ঘটনায় গৃহকর্মী আয়েশাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। চাঞ্চল্যকর এই জোড়া খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত আয়েশাকে শনাক্ত করতে তার গলার পোড়া দাগ এবং পূর্বের একটি চুরির ঘটনাকে প্রধান সূত্র হিসেবে কাজে লাগায় তদন্তকারীরা।
বৃহস্পতিবার (১১ ডিসেম্বর) দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন্স) এস এন মো. নজরুল ইসলাম।
এর আগে গতকাল বুধবার (১০ ডিসেম্বর) দুপুর সাড়ে ১২টায় ঝালকাঠি জেলার নলছিটি থানার চরকায়া গ্রামে অভিযান চালিয়ে দাদাশ্বশুরের বাড়ি থেকে আয়েশাকে গ্রেপ্তার করে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ। এ সময় তার স্বামী রাব্বিকেও আটক করা হয় এবং তাদের কাছ থেকে চুরি যাওয়া একটি ল্যাপটপ উদ্ধার করা হয়।
যেভাবে শনাক্ত হলেন আয়েশা
সংবাদ সম্মেলনে এস এন মো. নজরুল ইসলাম জানান, তদন্তের শুরুতে পুলিশ বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। ঘটনার মাত্র তিন দিন আগে কাজে যোগ দেওয়া আয়েশার কোনো এনআইডি কার্ড বা মোবাইল নম্বর ভবন কর্তৃপক্ষ বা মামলার বাদীর কাছে সংরক্ষিত ছিল না। এমনকি সিসিটিভি ফুটেজে বোরখা পরিহিত থাকায় চোখ ও পায়ের পাতা ছাড়া তার চেহারা শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছিল না। তবে তদন্তে জানা যায়, আয়েশার গলায় আগুনে পোড়া দাগ রয়েছে এবং তিনি জেনেভা ক্যাম্প এলাকায় থাকতেন।
গতানুগতিক ধারার বাইরে গিয়ে পুলিশ মোহাম্মদপুর থানায় গত এক বছরে গৃহকর্মী কর্তৃক চুরির রেকর্ড পর্যালোচনা শুরু করে। এতে দেখা যায়, চলতি বছরের জুলাই মাসে হুমায়ুন রোড এলাকায় এক চুরির ঘটনায় অভিযুক্ত গৃহকর্মীর নামও আয়েশা এবং তার গলায়ও পোড়া দাগ রয়েছে। ওই ঘটনার ভুক্তভোগী পরিবারের দেওয়া একটি মোবাইল নম্বরের সূত্র ধরেই তদন্তের জট খোলে।
নম্বরটির সূত্র ধরে প্রযুক্তির সহায়তায় পুলিশ সাভারের হেমায়েতপুর এলাকায় আয়েশার স্বামী রাব্বির অবস্থান শনাক্ত করে। জানা যায়, রাব্বির স্ত্রী আয়েশা গৃহকর্মীর কাজ করেন এবং তারা আগে জেনেভা ক্যাম্পে থাকতেন। হত্যাকাণ্ডের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই এভাবেই নিশ্চিত হওয়া যায় আয়েশার পরিচয়।
গ্রেপ্তার অভিযান: ঢাকা থেকে ঝালকাঠি
পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর পুলিশ হেমায়েতপুরে আয়েশা ও রাব্বির ভাড়া বাসায় অভিযান চালালে তা তালাবদ্ধ পাওয়া যায়। পরে আয়েশার মায়ের দেওয়া তথ্যে জানা যায়, তারা ভোরেই বাসা ছেড়েছে। প্রযুক্তির সহায়তায় তাদের অবস্থান সদরঘাট এলাকায় দেখা যায়। এরপর পটুয়াখালীর দুমকীতে রাব্বির আত্মীয়ের বাড়িতে অভিযান চালিয়েও তাদের পাওয়া যায়নি। অবশেষে স্বজনদের দেওয়া তথ্যে ঝালকাঠির নলছিটি থানার প্রত্যন্ত চরকায়া গ্রামে রাব্বির দাদাশ্বশুরের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে স্বামীসহ আয়েশাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
হত্যার নেপথ্যে: ২ হাজার টাকা ও চুরির অপবাদ
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আয়েশা হত্যার দায় স্বীকার করেছেন। পুলিশ জানায়, আয়েশার চুরির পুরনো অভ্যাস ছিল। এমনকি নিজের বোনের বাসা থেকেও তিনি টাকা ও স্বর্ণালংকার চুরি করেছিলেন। মোহাম্মদপুরের ওই বাসায় কাজের দ্বিতীয় দিনেই তিনি ২ হাজার টাকা চুরি করেন। এ নিয়ে গৃহকর্ত্রী লায়লা আফরোজের সঙ্গে তার কথা কাটাকাটি হয়।
ঘটনার দিন (চতুর্থ দিন) আয়েশা মেলা থেকে কেনা একটি সুইচ গিয়ার চাকু নিয়ে কাজে যান। গৃহকর্ত্রী লায়লা আফরোজ চুরি যাওয়া টাকার বিষয়ে জেরা করলে এবং আয়েশার স্বামীকে ফোন দিতে চাইলে আয়েশা তাকে আক্রমণ করেন। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে লায়লা আফরোজকে ছুরিকাঘাত করেন তিনি। এ সময় মেয়ে নাফিসা লাওয়াল মাকে বাঁচাতে এলে তাকেও গুরুতর জখম করা হয়। নাফিসা ইন্টারকমে নিচে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে আয়েশা তার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মা ও মেয়ের মৃত্যু হয়।
পালানোর কৌশল
হত্যাকাণ্ডের পর আয়েশা রক্তমাখা কাপড় পাল্টে নাফিসার স্কুল ড্রেস পরে এবং ব্যাজ ও রিবন দিয়ে এমনভাবে নিজেকে আবৃত করেন যাতে কেউ সন্দেহ না করে। এরপর ল্যাপটপ, ফোন ও অন্যান্য মালামাল নিয়ে পালিয়ে যান। পরে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে গিয়ে ফের কাপড় পরিবর্তন করে সাভারের উদ্দেশ্যে রওনা হন এবং পথিমধ্যে সিংগাইর ব্রিজের ওপর থেকে রক্তমাখা কাপড় ও চুরি করা ফোন নদীতে ফেলে দেন।
আয়েশা ৬ ও স্বামী ৩ দিনের রিমান্ডে
এদিকে, মা-মেয়ে হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার গৃহকর্মী আয়েশার ৬ দিন এবং তার স্বামী রাব্বির ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। বৃহস্পতিবার (১১ ডিসেম্বর) ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. মাহবুব আলমের আদালত শুনানি শেষে এ আদেশ দেন। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী কাইয়ূম হোসাইন নয়ন আসামিদের রিমান্ডের পক্ষে শুনানি করেন।
