কোথাও মঙ্গলধ্বনি : 'দেলুপি' কেন দেখবেন?
তথ্যচিত্র ধারণ করতে গিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের ঘটনা বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে দুর্লভ নয়। কোথাও পড়েছিলাম, মোহসেন মাখমালবাফ কার্পেটের বিজ্ঞাপনের পয়সায় 'গাব্বেহ' নির্মাণ করেন। বছর তিনেক আগে মুক্তি পাওয়া চলচ্চিত্র 'কুড়া পক্ষীর শূন্যে ওড়া' দেখলে আমাদের মনে হয় তথ্যচিত্র এবং কাহিনীচিত্রের জল অচল ভেদ রেখা কোথাও যেন মুছে যায়। নির্মাতা নিজের গল্পকে বলবার জন্য যেকোনো ধরন ব্যবহার করতে পারেন। সত্যতর অর্থে, চলচ্চিত্রের তো কোনো প্রথামান্য ব্যাকরণ নেই।
খুলনার পাইকগাছা উপজেলার দেলুটি ইউনিয়ন। এই বছরের (২০২৫) অগাস্ট থেকে নভেম্বর দেলুটিতে 'দেলুপি' চলচ্চিত্রের কাজ শেষ হয়। দেলুপির কলাকুশলীরাও প্রায় সকলেই স্থানীয় মানুষ৷ প্রথমে তথ্যচিত্রের জন্য প্রয়োজনীয় দৃশ্য ধারণ শেষে, এক মাসের কিছু বেশি সময় ধরে চলে কাহিনিচিত্রের কর্মযজ্ঞ। তাঁদের প্রায় 'ট্যাগলাইন'—'এ কী দৃশ্য এ কী সিন!'—এই ছয় শব্দের বাক্যের আসল মজা বুঝতে গেলে 'দেলুপি' বড় পর্দাতেই দেখতে হবে। চেনা মুখ দেখতে দেখতে বাংলার দর্শক আজ ক্লান্ত। এই সেদিন সুমন মুখোপাধ্যায়ের 'পুতুল নাচের ইতিকথা' দেখতে গিয়ে মনে হলো, এ কী রে বাবা, এ তো শশী ডাক্তার নয়, আবীর চট্টোপাধ্যায় সাইকেল চালাচ্ছেন! তারকাখচিত সিনেমার মৌলিক সংকট বাংলা ভাষায় এটিই। আবার পেশাদার অভিনেতা নন, ক্যামেরার সামনে প্রথম আসা মানুষেরা সেলুলয়েডের কতদূর পর্যন্ত বিস্ময় নির্মাণে সক্ষম, আমরা সেসব দেখি ইতালির নব্য বাস্তবতাবাদী চলচ্চিত্রমালার উজ্জ্বল নিদর্শনে।
বিশ্ব চলচ্চিত্রের এই বছরের শ্রেষ্ঠ ফসলসমূহের দিকে তাকালে আমরা দেখব—হয় ধ্রুপদী আখ্যানের নিরীক্ষা অথবা একেবারেই নিজের অঞ্চলের সংকট শনাক্ত করা৷ লুক বেঁস'র 'ড্রাকুলা: অ্যা লাভ টেইল', গুইয়ের্মো দেল তোরো'র 'ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন'—একেবারেই এই সময়ের চোখে সর্বজনবিদিত কাহিনির নব নিরিখ। এই সময়ের চোখ—কথাটির অর্থ কিন্তু ব্যক্তি পরিচালকের বেড়ে ওঠার ইতিহাস আর প্রযুক্তির বিবর্তনের ইতিহাসের সমবায়। মার্কিনি পল টমাস অ্যান্ডারসন যখন ভিক্তর পিঞ্চনের উপন্যাস কাহিনিচিত্রে রূপান্তর ঘটান 'ওয়ান ব্যাটল আফটার অ্যানাদার' সিনেমায়, হেরো বিপ্লবীর কথা বলতে গিয়ে তিনি কিন্তু মার্কিন সমাজের ক্ষতের দাগ প্রকট করে তোলেন। কোরীয় পার্ক চ্যান উক 'নো আদার চয়েস' চলচ্চিত্রে অনেকটা বয়স পেরিয়ে আসা চাকরিহারা যুবকের মরিয়া লড়াইয়ের কথা বলেন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের রমরমা নিয়ে চেতাবনির পাশাপাশি নিজের দেশে চাকরিপ্রার্থী মানুষের দমবন্ধ বাঁচার চেষ্টা নথিভুক্ত করে রাখেন। কান চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা চলচ্চিত্র 'ইট ওয়াজ জাস্ট অ্যান অ্যাকসিডেন্ট' ( ফরাসী অনুবাদে 'অ্যা সিম্পল অ্যাক্সিডেন্ট') দেখে ফেলতে পারলে যেকোনো অনুভবী দর্শক কনটেমপোরারি মায়েস্ত্রো জাফর পানাহির অন্তরের ব্যথা বুঝতে পারবেন। সরকারের চক্ষুশূল পানাহি একজন ইন্টেলিজেন্স অফিসারকে অপহরণের কাহিনির কাঠামোর আবরণে রাষ্ট্রবিরোধী নিজস্ব ক্রিটিককেই বিশ্বময় ছড়িয়ে দেন। একজন চূড়ান্ত অপরাধীর সাথেও আমরা প্রতিহিংসামূলক আচরণ করব কি না—এই তাঁর জিজ্ঞাস্য। এক ধরনের কমপ্যাশনেট স্টেটমেন্ট, মত যত বিরুদ্ধই হোক, 'অপর' করে দেয়া যাবে না।
আমাদের বন্ধুটি কী করছেন 'দেলুপি' চলচ্চিত্রে তাঁর দল নিয়ে? প্রিমিয়ার হয়েছিল দেলুটিতেই, যার আবহ আর মানুষেরা এই ছবির প্রাণ। এক যাত্রাদলের নটদের ব্যক্তিজীবন, সংসারজীবন—রেজিম বদলের ঐতিহাসিক বাস্তব সময়, বন্যাকবলিত জনপদের জটিলতা আর তা থেকে উদ্ধারের জন্য শক্তপোক্ত বাঁধের অনিবার্যতা। ট্রেলার দেখলেই দেলুপি কাহিনির উপাদান চিহ্নিত করতে পারবেন যে-কেউই। আমাদের জনজীবনে বিগত রেজিম প্রধানের হেলিকপ্টারযোগে পলায়ন পুকুরে একটা ঢিল ছোড়ার মতন ঘটনা। ঢেউ কেন্দ্র থেকে প্রান্তের দিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। রাজনীতির চেনা মুখ বদলে বদলে যায়। দেড় যুগের পলাতক নেতা সর্বাঙ্গে কাদাজল মেখে বিরাটাকার গিরগিটির সাদৃশ্যে আবির্ভূত হয়। চূর্ণ ক্ষমতাবলয় গুছিয়ে গ্যাঁট হয়ে নয়া বন্দোবস্তের কথা ভাবে।
দেলুপি হালকা চালের গল্প বলার আদলে একটি রাজনৈতিক চলচ্চিত্রও। নির্মাতা তাওকীর ইসলাম জানেন, প্রকৃত শিল্পী সর্বকালে বিরোধী দলে। তাই ক্রিটিক তিনি জারি রাখেন। প্রায় সর্বত্র 'সাত তারিখ'-এর ইঙ্গিত। সমঝদারের জন্য ইশারাই কাফি। যাত্রার সময়, চলচ্চিত্রের সময়, বাস্তব সময়—এই তিন সময় পর্দায় লীন হয়ে আছে। যাত্রার মথুরা নগরীর সাদৃশ্যে দেলুপির জনপদের ছিন্নতা চোখে পড়ে, মনেও। কংসের উল্লাসের পাশাপাশি পুরনো মানুষদের গায়ের আর গলার জোরের আস্ফালন দেখে ফেলা যায়৷ আবার নির্মাতা যেহেতু নির্মাণের ঈশ্বর, তিনি চান মিলন। আমাদের বাস্তব পৃথিবী যে সংকটে পড়েছে তা থেকে উদ্ধারের কোনো সহজ প্রেসক্রিপশন নেই আপাতত। 'দেলুপি'-র অন্তর্ভুক্তিমূলক উপশম তাই আমাদের বিন্দু মুহূর্তের স্বস্তি দেয়৷ যদিও যাত্রা আমাদের দেশের প্রায় বিলুপ্ত এক শিল্প, তবু শেষ পর্যন্ত জনসমাবেশে তা ঘটে ওঠা আনন্দের। দেলুপির মধুর বিবাহটিও এক ধরনের নম্রতার বার্তা, আমাদের শান্ত ও স্থির থাকতেই বলে। কোথাও মঙ্গলধ্বনি....আসুন, দেখে নিই এই সময়ের ধারাবিবরণীর একটা কাহিনিচিত্র।
