প্রায়ই মাথাব্যথায় ভোগেন? হতে পারে কারণ আপনার ঘাড়ের সমস্যা

জীবনে কোনোদিন মাথাব্যথা হয়নি এমন লোক বোধহয় খুব কমই খুঁজে পাওয়া যাবে। আর মাথা ব্যথার একটি বড় কারণ হলো মাইগ্রেন ও উদ্বেগ। এক গবেষণা বলছে, এই মাথাব্যথা হয়ত আপনার ঘাড়ের ব্যথার কারণেই হচ্ছে।
সম্প্রতি দ্য জার্নাল অব হেডেক অ্যান্ড পেইন-এ প্রকাশিত একটি গবেষণায় প্রথমবারের মতো দেখা গেছে, মাথাব্যথার সঙ্গে পেশির একটি বৈজ্ঞানিক যোগসূত্র পাওয়া গেছে।
গবেষকরা ৫০ জন রোগীর মধ্যে এমআরআই পরীক্ষা করে উদ্বেগজনিত মাথাব্যথা এবং মাইগ্রেনের ক্ষেত্রে ঘাড় ও পেশির সঙ্গে যুক্ত সংযোগ পরীক্ষা করেছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, ঘাড়ের ব্যথা দুই ধরনের মাথাব্যথার সাথেই সম্পর্কিত।
ট্রাপেজিয়াস পেশিতে সূক্ষ্ম পরিবর্তনও পাওয়া গেছে এমআরআই স্ক্যানে। এই পেশি মেরুদণ্ডের মধ্যভাগ থেকে ঘাড় ও কাঁধ পর্যন্ত বিস্তৃত। ধারণা করা হচ্ছে, এটি প্রদাহজনিত হতে পারে।
জার্মানির উলম ইউনিভার্সিটি হাসপাতাল ও টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি অব মিউনিখের রেডিওলজিস্ট ও গবেষণার সহ-লেখক নিকো সলম্যান বলেন, 'আমরা দেখেছি যে পেশির এই পরিবর্তনের সঙ্গে ৩০ দিনের মধ্যে রোগী কতদিন মাথাব্যথায় ভোগেছেন এবং ঘাড়ের ব্যথার মাত্রার মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য সম্পর্ক রয়েছে।" তিনি আরও যোগ করেন, "এই ফলাফলগুলো ঘাড়ের এলাকা ও মস্তিষ্কের মধ্যে মাথাব্যথার সঙ্গে সম্পর্কের একটি বৈজ্ঞানিক প্রমাণ দিতে পারে।'
তবে নিউ ইয়র্কের মাউন্ট সিনাই আইকান স্কুল অব মেডিসিনের নিউরোলজি প্রফেসর মার্ক গ্রিন কিছু ফলাফলের সঙ্গে একমত নন। তিনি বলেন, 'আপনি এমআরআই থেকে সরাসরি প্রদাহ ধরে নিতে পারবেন না—পেশিটি শুধু টান বা সংকুচিতও হতে পারে।' তবে তিনি ঘাড়ের ব্যথা ও উদ্বেগজনিত মাথাব্যথা বা মাইগ্রেনের সম্পর্ক অস্বীকার করেননি।
ঘাড়ের ব্যথা ও মাথাব্যথা সম্পর্কে সলম্যানের গবেষণাই প্রথম প্রচেষ্টা নয়। নিউরোলজি জার্নালে প্রকাশিত অন্য আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, মাইগ্রেন শুরু হওয়ার আগে, চলাকালীন এবং পরবর্তী সময়ে ঘাড়ের ব্যথা ব্যাপকভাবে দেখা যায়।
গবেষণার সহ-লেখক ডন সি. বুজে, নিউরোলজি প্রফেসর, বলেন, 'অনেকে মনে করেন ঘাড়ের ব্যথা মাইগ্রেনের কারণ। কিন্তু অনেক সময় মাইগ্রেনের আক্রমণ শুরু হয়ে গেছে এটার ইঙ্গিত দিতে ঘাড়ের ব্যাথা শুরু হয়। এমন সময় মাইগ্রেনের চিকিৎসা শুরু করা উচিত।'
ঘাড়ের পেশি, মস্তিষ্ক এবং ব্যথার সম্পর্ক
ঘাড়ের ব্যথা আসলে কি সরাসরি মাথাব্যথার কারণ, নাকি দুই ধরনের ব্যথা একসাথে ঘটে—এটি সম্পূর্ণভাবে বোঝা যায়নি। তবে একটিই স্পষ্ট: 'মাইগ্রেনে ভোগা মানুষদের মধ্যে অনেকেই ঘাড়ের ব্যথায় ভোগেন, এমনকি মাইগ্রেন অ্যাটাক না থাকলেও,' বলেন জেসিকা আইলানি, মেডস্টার জর্জটাউন ইউনিভার্সিটি হাসপাতালের হেডেক সেন্টারের পরিচালক ও ক্লিনিকাল নিউরোলজি প্রফেসর।
যে কারণগুলো এই সম্পর্কের পিছনে আছে, তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো ট্রাইজেমিনাল ন্যার্ভ বা পঞ্চম ক্র্যানিয়াল নার্ভ। এটি মস্তিষ্কের ব্রেইনস্টেমের সঙ্গে যুক্ত এবং উপরের ঘাড়ের স্নায়ুতে পৌঁছে, মুখ ও মাথার বিভিন্ন অংশে ব্যথা, স্পর্শ এবং তাপমাত্রার সংকেত পাঠায়।
ওয়ার্ল্ড হেডেক সোসাইটি সভাপতি মার্ক গ্রিন বলেন, 'ঘাড়ের উপরের স্নায়ুগুলো ট্রাইজেমিনাল নার্ভ সক্রিয় করে মাইগ্রেন উদ্বেগ করতে পারে। মাইগ্রেনে আক্রান্ত ৭৫ শতাংশ মানুষ ঘাড়ের ব্যথায় ভোগেন।'
দীর্ঘস্থায়ী ব্যথার সঙ্গে আরও একটি সমস্যা হলো পেইন সেনসিটাইজেশন। সহজভাবে বলতে গেলে, দীর্ঘসময় ব্যথা থাকলে স্নায়ুতন্ত্র বা নার্ভাস সিস্টেম ক্রমাগত সক্রিয় থাকে, যার ফলে ব্যথা অনুভবের সীমা কমে যায় এবং মানুষ ব্যথার প্রতি সংবেদনশীল হয়ে যায়।
স্ক্যান্ডিনেভিয়ান জার্নাল অফ পেইন-এ প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা ঘাড়ের ব্যথা এবং দীর্ঘমেয়াদি মাইগ্রেন (মাসে ১৫ বা তার বেশি দিনের মাথাব্যথা) বা উদ্বেগজনিত মাথাব্যথা-য় ভোগেন, তাদের স্কাল্পে [মাথার তালু] সংবেদনশীলতা বেশি থাকে। এর কারণ হিসেবে পেইন সেনসিটাইজেশনকে ধরা হয়।
আইলানি আরও ব্যাখ্যা করেন, 'যখন একটি স্থানে বেশি ব্যথা থাকে, তখন অন্য স্থানেও ব্যথা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে, কারণ সব ব্যথাই মূলত মস্তিষ্কে থাকে। মস্তিষ্ক অতিরিক্ত সংবেদনশীল হয়ে যায় এবং ব্যথা আরও তীব্র মনে হয়। এছাড়া ব্যথার সংকেত বন্ধ করাও কঠিন হয়ে যায়।'
অধিকন্তু, মাইগ্রেন বা উদ্বেগজনিত মাথাব্যথায় ভোগা মানুষের ঘাড় ও মাথার পেশিতে সাধারণত কিছু মায়োফ্যাসিয়াল ট্রিগার পয়েন্ট থাকে। এগুলো স্পর্শ করলে মাথাব্যথা শুরু হতে পারে।
গবেষণা দেখিয়েছে, যারা উদ্বেগজনিত মাথাব্যথা ভোগেন, তাদের স্ক্যাল্পে সক্রিয় মায়োফ্যাসিয়াল ট্রিগার পয়েন্ট থাকে এবং এর ফলে ব্যথা প্রতিরোধের ক্ষমতা কমে যায়—যা পেইন সেনসিটাইজেশনের ইঙ্গিত দেয়।
কারা বেশি আক্রান্ত এবং কেন
যেকোনো ব্যক্তি যার ঘাড়ে ব্যথা আছে, তারা উদ্বেগজনিত মাথাব্যথা বা মাইগ্রেনের আক্রমণের ঝুঁকিতে থাকতে পারে—বিশেষত যারা এ ধরনের মাথাব্যথার প্রবণতা রাখেন।
কিছু ক্ষেত্রে ঝুঁকি আরও বেশি থাকে, যেমন: যাদের ঘাড়ের হাড় ও ডিস্কের ক্ষয় (স্ফন্ডিলোসিস) রয়েছে, যাদের ভুল ভঙ্গিতে বসা বা ঘুমানোর অভ্যাস রয়েছে বা যারা খেলার সময় আঘাত বা চোট পেয়েছেন।
নিউরোলজিস্ট এবং হার্টফোর্ড হেলথকেয়ার হেডেক সেন্টারের পরিচালক ব্রায়ান গ্রোসবার্গ, বলেন, 'যাদের হঠাৎ ঘাড়ে ব্যথা হয়—যেমন গাড়ির দুর্ঘটনায় হুইপল্যাশ আঘাতের কারণে—তাদের মধ্যে ঘাড়ের ব্যথা, মাথাব্যথা এবং ব্যথার সংবেদনশীলতা একসাথে দেখা যেতে পারে।'
কিছু ক্ষেত্রে, ঘাড়ের ব্যথার সঙ্গে মাথাব্যথা থাকলে এটি সতর্কতার সংকেত হতে পারে। ডন বুজে বলেন, 'যদি সঙ্গে থাকে জ্বর, কাঁপুনি বা ঠাণ্ডা লাগা, চলাফেরায় সমস্যা, ভারসাম্য হারানো, হাঁটতে কষ্ট, হাত-পায়ে ব্যথা বা ঝনঝনানি—তাহলে ঘাড়ের ব্যথা গুরুতর কিছু রোগের লক্ষণ হতে পারে, যেমন টিউমার বা মেনিনজাইটিস।'
যদি এই ধরণের উদ্বেগজনক লক্ষণ না থাকে এবং ঘাড়ের ব্যথা উদ্বেগজনিত মাথাব্যথা বা মাইগ্রেনের সঙ্গে যুক্ত থাকে, তাহলে লক্ষ্য হবে দুই ধরনের ব্যথাকে একসাথে নিয়ন্ত্রণ করা যাতে একটির কারণে অন্যটি উদ্বেগ না হয়। মার্ক গ্রিন বলেন, 'ঘাড়ের ব্যথা দ্রুত এবং সঠিকভাবে চিকিৎসা করা জরুরি, যাতে সমস্যা বাড়ে না।'
চিকিৎসা কী?
এখন পর্যন্ত এমন কোনো একক চিকিৎসা নেই যা ঘাড়ের ব্যথা এবং উদ্বেগজনিত মাথাব্যথা দুইই পুরোপুরি কমাতে পারে। তবে বিভিন্ন ওষুধবিহীন পদ্ধতি কার্যকর হতে পারে, যেমন: ম্যাসাজ, আকুপাংচার, স্ট্রেচিং ব্যায়াম কিংবা গরম বা ঠান্ডা সেঁক।
জেসিকা আইলানি বলেন, 'কাজের জায়গায় সঠিক এর্গোনমিক সেটআপ ও ঘুমের জন্য সহায়ক বালিশ ব্যবহারেও ঘাড়ের ব্যথা কমানো যায়।'
গবেষণায় দেখা গেছে, মায়োফ্যাসিয়াল রিলিজ (ঘাড়ের সংবেদনশীল পেশিতে চাপ প্রয়োগ) এবং স্ট্রেচিং প্রযুক্তি মাইগ্রেনের তীব্রতা ও ঘাড়ের নড়াচড়া ক্ষমতা উন্নত করতে সাহায্য করে।
সলম্যানের দল সম্প্রতি রিপিটেটিভ পারিফেরাল ম্যাগনেটিক স্টিমুলেশন বা আরপিএমএস (rPMS) ব্যবহার করেছেন। এটি একটি বিশেষ যন্ত্র যা চৌম্বকীয় তরঙ্গ ব্যবহার করে ঘাড়ের পেশি উদ্দীপিত করে ব্যথা কমায়। সলম্যান বলেন, 'পুনরাবৃত্ত আরপিএমএস প্রয়োগের ফলে আমরা দেখেছি, মাথাব্যথা কমে যেতে পারে।'
ওষুধের দিক থেকে, ঘাড়ের ব্যথা বা উদ্বেগজনিত মাথাব্যথ বা মাইগ্রেনের জন্য প্যারাসিটামল বা আইবুপ্রোফেন ব্যবহার করা যায়। তবে মার্ক গ্রিন সতর্ক করে বলেন, 'ওষুধ বেশি ব্যবহার করলে ব্যথা আরও বেড়ে যেতে পারে—এটি 'মেডিকেশন-ওভারইউস হেডেক' বা রিবাউন্ড হেডেক হিসেবে পরিচিত।'
নিয়মিত বা দীর্ঘমেয়াদি মাথাব্যথার ক্ষেত্রে, ঘাড়ের ব্যথার সঙ্গে মিলিয়ে কিছু অ্যান্টি-ডিপ্রেস্যান্ট যেমন- অ্যামিট্রিপটাইলিন, মিরটাজাপিন, ডুলোক্সেটিন এবং কিছু অ্যান্টি-সিজার ওষুধ যেমন- গ্যাবাপেন্টিন ব্যবহার করা হতে পারে।
অন্য মাইগ্রেন চিকিৎসার মধ্যে আছে ট্রিপটান, জিপ্যান্ট বা ডাইটান শ্রেণির ওষুধ এবং বিভিন্ন প্রতিরোধমূলক ওষুধ: বেটা-ব্লকার, ট্রাইসাইক্লিক অ্যান্টিডিপ্রেস্যান্ট, মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি ইত্যাদি।
বোটক্স ইনজেকশনও কখনও ব্যবহার করা হয় দীর্ঘমেয়াদি মাইগ্রেনে। ২০২৩ সালের টক্সিন্স জার্নালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ১১৬ জন রোগীর মধ্যে যাদের ঘাড়ের সমস্যা বেশি, তাদের মাসিক মাথাব্যথার দিন সংখ্যা এবং মাইগ্রেনজনিত অসুবিধা কমাতে বোটক্স সবচেয়ে বেশি কার্যকর হয়েছে। তবে মাথাব্যথার তীব্রতা সব রোগীর মধ্যে প্রায় সমান হ্রাস পেয়েছে।
মার্ক গ্রিন বলেন, 'যদি মাথাব্যথা নিয়মিত হয়, তাহলে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়াই ভালো। এতে ঘাড় ও মাথার ব্যথার পুনরাবৃত্তি বন্ধ করা সম্ভব।'