স্বাস্থ্য-শিক্ষায় অগ্রাধিকার দিয়ে ৩৬ প্রকল্পে বিদেশি অর্থায়নের পরিকল্পনা সরকারের
প্রচলিত ভৌত অবকাঠামোর পরিবর্তে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের অবকাঠামো উন্নয়নকে গুরুত্ব দিয়ে ৩৬টি প্রকল্পে বৈদেশিক ঋণের জন্য উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে প্রস্তাব দেবে সরকার। এর মধ্যে উচ্চ শিক্ষা খাতে প্রকল্প রয়েছে ৯টি এবং স্বাস্থ্য খাতে অবকাঠামো উন্নয়নের প্রকল্প রয়েছে ৭টি।
উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে আনুষ্ঠানিক ঋণ প্রস্তাব পাঠানোর চূড়ান্ত পর্যায়ে—আজ বুধবার বৈদেশিক সহায়তা অনুসন্ধান কমিটির ৭০তম সভায় এসব প্রকল্প উপস্থাপন করা হবে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব শাহরিয়ার কাদের ছিদ্দিকীর সভাপতিত্বে এই সভাটি অনুষ্ঠিত হবে।
ইআরডি কর্মকর্তারা জানান, শুরুতে ২৪টি প্রকল্প বৈদেশিক সহায়তা অনুসন্ধান কমিটির সভার জন্য তালিকা নোটিশ দেওয়া হয়। পরে গুরুত্ব অনুযায়ী, নতুন করে আরো ১২টি প্রকল্প সভায় উপস্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। অর্থাৎ, মোট প্রকল্পের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৬টি।
তারা আরও জানান, ২৪ প্রকল্প বাস্তবায়নে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ ঋণ প্রস্তাব দিতে যাচ্ছে সরকার। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে মোট ব্যয় হবে ৮০ হাজার ৭৫১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৬৮ হাজার ৬৩৯ কোটি টাকার ঋণ প্রস্তাব রয়েছে। এছাড়া তালিকায় নতুন যুক্ত হওয়া ১২ প্রকল্পসহ মোট ৩৬টি প্রকল্পে বৈদেশিক ঋণ প্রস্তাব রয়েছে এক লাখ কোটি টাকারও বেশি।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের ১৬টি প্রকল্প ছাড়াও স্থানীয় সরকার খাতে পাঁচটি, বিদ্যুৎ খাতে দুটি, রেলওয়ে অবকাঠামোতে তিনটি এবং পানিসম্পদ খাতে তিনটি প্রকল্প রয়েছে। এছাড়া বিমানবন্দর, সেতু, অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন, আইসিটি, কৃষি, শ্রম এবং যুব ও ক্রীড়া খাতে একটি করে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশ- এর চেয়ারম্যান এম মাসরুর রিয়াজ বলেন, "বৈদেশিক অর্থায়ন এমন প্রকল্পে নেওয়া উচিত, যেগুলো উচ্চ অর্থনৈতিক ও মানব পুঁজি রিটার্ন নিশ্চিত করে। অর্থাৎ, এমন প্রকল্পে বিনিয়োগ করা, যা কেবল আর্থিক লাভ নয় – বরং জনগণের দক্ষতা, স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় উন্নতি ঘটিয়ে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের প্রকল্পগুলো এই শর্ত পূরণ করে। এগুলোর যথাযথ বিচার ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত হলে দেশের সার্বিক মানবসম্পদ উন্নত হবে, যা শেষপর্যন্ত অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতা বাড়াবে।"
তিনি বলেন, "গত দশকে বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পে অবকাঠামো নির্মাণে ব্যাপক বৈদেশিক অর্থায়ন হয়েছে। এতে বড় বড় অনেক কাজ সম্পন্ন হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এর ফলে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সেবার মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলো দুর্বল ও অবহেলিত থেকে গেছে। এই ভারসাম্যহীনতা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। তাই এখন সেবা খাতের দিকে অগ্রাধিকার বাড়ানো একটি সঠিক সিদ্ধান্ত। এর পাশাপাশি দুর্বল শাসনব্যবস্থা (গভর্ন্যান্স) এবং প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধির ওপর জোর দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। কারণ, সুশাসন ছাড়া কোনো প্রকল্পই তার কাঙ্ক্ষিত ফল দিতে পারে না।"
ইআরডি কর্মকর্তারা জানান, ইতোমধ্যে ৩৬টি প্রকল্পের সবকটির প্রাথমিক প্রকল্প প্রস্তাব (পিডিপিপি) – পরিকল্পনা কমিশনের নীতিগত অনুমোদন পেয়েছে। এছাড়া অনেক প্রকল্প নিয়ে ইতোমধ্যে উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে আলোচনা আগেই শুরু হয়েছে। তারা বেশকিছু প্রকল্পে আগ্রহও দেখিয়েছে। এখন দ্রুত ঋণ প্রক্রিয়ার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
তবে কিছু প্রকল্প আছে, যা নিয়ে এখনো উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে আলোচনা হয়নি। প্রকল্পের ধরন ও বৈদেশিক ঋণের শর্ত অনুযায়ী উন্নয়ন সহযোগী নির্বাচন করা হবে বৈঠকে। একবার চূড়ান্ত হলে সব পিডিপিপি ও ঋণ প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে পাঠানো হবে।
স্বাস্থ্য খাতের প্রকল্প
স্বাস্থ্য খাতে চীনের ঋণ ও অনুদানে বাস্তবায়নের জন্য তালিকায় চারটি প্রকল্প রয়েছে। যার মধ্যে ঢাকা ও রংপুরে হাসপাতাল নির্মাণ অন্তর্ভুক্ত। রংপুরে ১,০০০ শয্যার একটি হাসপাতাল নির্মাণে ১,৪৮০ কোটি টাকা ব্যয় হবে, যা পুরোপুরি অনুদান হিসেবে দেওয়া হবে। এখানে আধুনিক ডায়াগনস্টিক সুবিধা, বিশেষায়িত ইউনিট থাকবে। এছাড়া সারাদেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে স্থাপনের জন্য ডায়ালাইসিস মেশিন সংগ্রহ করা হবে।
চীন চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে ৫০০–৭০০ শয্যার একটি হাসপাতাল নির্মাণের প্রকল্পও বিবেচনা করছে, এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ২,৬২৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১,৯৪৪ কোটি টাকা অনুদান হিসেবে দেবে চীন। স্বাস্থ্য খাতের অন্যান্য অগ্রাধিকার প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে জেলা হাসপাতালগুলোকে শক্তিশালীকরণে ৪,৫৭৫ কোটি টাকার প্রকল্প, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স উন্নয়নে ১২,৯৬০ কোটি টাকার প্রকল্প এবং ভেনম রিসার্চ সেন্টার উন্নয়নে ৩১ কোটি টাকার অনুদানভিত্তিক প্রকল্প।
শিক্ষা খাতের প্রকল্প
শিক্ষা খাতে সরকারের অনুমোদিত প্রকল্পগুলোর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্য ২,৮৪০ কোটি টাকার একটি বৃহৎ প্রকল্প রয়েছে। পাশাপাশি বিদেশি ঋণের আওতায় প্রস্তাবিত প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে ৬১৬ কোটি টাকার চতুর্থ শিল্পবিপ্লব (ফোরআইআর) রিসার্চ অ্যান্ড ইনোভেশন পার্ক, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস ইউনিভার্সিটির গবেষণা সুবিধার আধুনিকায়ন, সামুদ্রিক বিপদ সংকেত ব্যবস্থা এবং উন্নতমানের ফার্মাসিউটিক্যাল ল্যাবরেটরি।
এছাড়া শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসন সুবিধা, স্বাস্থ্যকেন্দ্রিক অবকাঠামো, একটি মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য গবেষণা সুবিধা স্থাপনের পরিকল্পনাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
অবকাঠামো খাতের প্রকল্প
এছাড়া বৈদেশিক ঋণের মাধ্যমে বাস্তবায়নের জন্য বেশ কয়েকটি অবকাঠামো প্রকল্প রয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে কক্সবাজার বিমানবন্দর (দ্বিতীয় ধাপ), নারায়ণগঞ্জ থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত রেলওয়ে বিদ্যুতায়ন, ধীরাশ্রমে আইসিডি এবং তিস্তা নদীর সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার প্রকল্প (টিআরসিএমআরপি) প্রথম ধাপ।
২০ হাজার কোটি টাকার কক্সবাজার বিমানবন্দর প্রকল্পে রানওয়ে ৯ হাজার ফুটে সম্প্রসারণ এবং প্রস্থ ২০০ ফুট করা হয়েছে। আরেকটি প্রকল্পে একে সমুদ্রের ভেতর (সাগরের চ্যানেল ভরাট করে) সম্প্রসারণের কাজও চলছে। ৩৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে বিমানবন্দরের একটি নতুন টার্মিনাল আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর উদ্বোধন হবে। এতে বছরে ১৮ লাখ যাত্রী সেবা দেওয়া যাবে—যা বর্তমান সক্ষমতার দ্বিগুণেরও বেশি।
তিস্তা প্রকল্প
তিস্তা নদীর সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার প্রকল্প (টিআরসিএমআরপি) প্রথম ধাপ- এর জন্য চীনের কাছে ৫৫০.৬২ মিলিয়ন ডলারের ঋণ প্রস্তাব দেওয়া হবে। এই প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৪৭.২৫ মিলিয়ন ডলার।
ইতোমধ্যে চীন এই প্রকল্পে আগ্রহ দেখিয়েছে বলে জানান কর্মকর্তারা।
এই প্রকল্পে তিস্তা ব্যারাজ থেকে ১০২ কিলোমিটার জুড়ে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে ১৭০.৮৭ বর্গকিলোমিটার জমি পুনরুদ্ধার করা হবে। উত্তোলন করা মাটি ব্যবহার করা হবে কৃষিজমি, শিল্প, নগর বসতি ও সোলার প্ল্যান্ট স্থাপনের জন্য।
এছাড়া বন্দর ও রেল উন্নয়ন প্রকল্পও রয়েছে, যার জন্য দ. কোরিয়া এবং বহুপাক্ষিক ঋণদাতাদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে।
তবে অর্থনীতিবিদ মাসরুর রিয়াজ সতর্ক করে বলেছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশের বৈদেশিক ঋণ বাড়ায় তা পরিশোধের চাপও বাড়ছে। এই অবস্থায়, ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্ক ও বিচক্ষণ হওয়া প্রয়োজন। অপ্রয়োজনীয় বড় আকারের ঋণ পরিহার করে কেবল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্পেই ঋণ নেওয়া উচিত। এটি দেশের সামগ্রিক ঋণ ভারকে একটি সহনীয় মাত্রায় রাখতে সাহায্য করবে। অবকাঠামো প্রকল্পের বাণিজ্যিক রিটার্ন রয়েছে। এই ধরনের প্রকল্পগুলো এখন সারাবিশ্বে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব (পিপিপি) এবং বেসরকারি অর্থায়নে হচ্ছে। বাংলাদেশের জন্যও এটি একটি সুবর্ণ সুযোগ। ধীরে ধীরে অবকাঠামো খাতে বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে পিপিপি এবং বেসরকারি অর্থায়নের দিকে সরে আসা যেতে পারে। এতে সরকারের ওপর ঋণের বোঝা কমবে এবং বেসরকারি খাতও অর্থনৈতিক উন্নয়নে আরও বেশি ভূমিকা রাখতে পারবে।
