বিমানবন্দরে আগুনের জের এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি বাংলাদেশের রপ্তানি শৃঙ্খল
হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো কমপ্লেক্সে ভয়াবহ আগুন লাগার দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় পার হতে চললেও সেখানে আন্তর্জাতিক কুরিয়ারের মাধ্যমে আসা পার্সেল ডেলিভারি স্বাভাবিক হয়নি। বরং কার্যত ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এর ফলে আমদানি-নির্ভর ব্যবসা ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছে, ব্যবসায়ীরা আশঙ্কা করছেন—এই অচলাবস্থা অব্যাহত থাকলে বিদেশি অর্ডার হারাতে হবে।
খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, এসব কারণে শীর্ষস্থানীয় আন্তর্জাতিক কুরিয়ার প্রতিষ্ঠান–ডিএইচএল বাংলাদেশমুখী পার্সেল পিকআপ বন্ধ করে দিয়েছে। আরো অন্তত একটি শীর্ষস্থানীয় আন্তর্জাতিক বিমান সংস্থাও বাংলাদেশমুখী কার্গো আনা বন্ধ রেখেছে বলে জানা গেছে।
এদিকে যেসব শিল্প প্রতিষ্ঠান সময়মতো কাঁচামাল আমদানির ওপর নির্ভরশীল—বিশেষ করে তৈরি পোশাক (আরএমজি) রপ্তানিকারক ও ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো—তারা বলছে, চালান বিলম্বের কারণে উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং ভবিষ্যৎ রপ্তানি অর্ডার ঝুঁকির মুখে পড়ছে।
রপ্তানিকারকরা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত
পোশাক ও টেক্সটাইল রপ্তানিকারকরা বিদেশি বায়ারদের পাঠানো নমুনা (স্যাম্পল) সময়মতো না পেলে নতুন অর্ডার নিশ্চিত করতে পারেন না। এখন এসব নমুনা বিদেশে আটকে আছে, ফলে উৎপাদকরা সতর্ক করে বলেছেন—যদি দ্রুত বিমানবন্দরের কার্গো কার্যক্রম স্বাভাবিক না হয়, দেশের রপ্তানি পরিস্থিতির গুরুতর অবনতি হতে পারে।
বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু টিবিএসকে বলেন, "যেসব পার্সেল আসছে, তা ডেলিভারি হচ্ছে না। যার কারণে ডিএইচএল-সহ আরো কেউ কেউ বাংলাদেশমুখী কনসাইনমেন্ট পিকআপ বন্ধ রেখেছে। ফলে রপ্তানিকারকদের বড় অংশই বায়ারের কাছ থেকে এয়ারে স্যাম্পল আনতে পারছে না।"
তিনি বলেন, "এখন পর্যন্ত এ কারণে অর্ডার ক্যানসেলেশন বা ক্রয়াদেশে ক্ষতি হয়নি। তবে এভাবে চলতে থাকলে আমরা ভবিষ্যতের অর্ডার কনফার্ম করতে পারবে না, যার কনসিকোয়েন্স হবে খুবই সিভিয়ার।"
বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, "আমাদের এখন মূল সমস্যা হলো এয়ার কুরিয়ারের মাধ্যমে রপ্তানি পণ্যের স্যাম্পল আসছে না। এর বিকল্পও আমরা বের করতে পারিনি। স্যাম্পল না আসলে অর্ডার ধরা বা তৈরি হওয়া পণ্য যথাসময়ে শিপমেন্ট করা যাবে না।"
খালাস কার্যক্রম বিশৃঙ্খল, চালান আনা বন্ধ রেখেছে ডিএইচএল
ডিএইচএল এক্সপ্রেস, ফেডএক্স, ইউপিএস, টিএনটি, স্কাইনেট ও ডিটিডিসি-সহ বাংলাদেশে ৪০টির বেশি আন্তর্জাতিক এয়ার এক্সপ্রেস অপারেটর কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
গত ২৯ অক্টোবর, ডিএইচএল এক্সপ্রেস বাংলাদেশ তাদের অংশীদারদের জানায়, বিমানবন্দরে আগুনের কারণে তারা আপাতত ইনবাউন্ড নন-ডকুমেন্ট শিপমেন্ট গ্রহণ বন্ধ রেখেছে।
এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করে ডিএইচএল এক্সপ্রেস বাংলাদেশের পরিচালক আবুল কাশেম চৌধুরী বলেছেন, "আমাদের বাংলাদেশমুখী পার্সেল পিকআপ এখনো বন্ধ রয়েছে।" কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, "আগুন লাগার পর এয়ারপোর্ট এখনো রেডি নয়। যার কারণে আমরা পার্সেল আনছি না।"
শিল্প-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে এয়ার কুরিয়ারে পার্সেল ও নথিপত্র আনা-নেওয়ার প্রায় ৭০ শতাংশই করে ডিএইচএল ও ফেডএক্স। ডিএইচএল প্রতিদিন গড়ে ২,৫০০ বাংলাদেশমুখী পার্সেলের চালান বহন করে থাকে বলে জানান কাশেম চৌধুরী। এয়ার কুরিয়ার কার্গোতে থাকা আমদানি ও রপ্তানির মালামালের মধ্যে তৈরি পোশাক ও টেক্সটাইল খাতের মালামাল থাকে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ।
বিদেশি একটি এয়ারলাইনের এক সিনিয়র কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ এয়ারলাইনগুলোকে পরামর্শ দিয়েছে—যথাযথ অবকাঠামো প্রস্তুত না হওয়া পর্যন্ত আমদানি কার্গো না আনতে।
বৃষ্টিতে ভিজছে পণ্য, ক্ষোভ ব্যবসায়ীদের
আগুনের দুই সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও বিমানবন্দরের কার্গো ব্যবস্থাপনার পরিস্থিতি এখনো বিশৃঙ্খল। ক্ষতিগ্রস্ত শেডগুলো এখনো নির্মাণ করা হয়নি, ফলে অনেক আমদানি পণ্য খোলা আকাশের নিচে পড়ে আছে—অনেক পণ্য বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে।
একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, গত শনিবারের বৃষ্টিতে আমদানি কার্গোর বাইরে খোলা আকাশের নিচে থাকা বিপুল পরিমাণ আমদানিকৃত কনসাইনমেন্ট ভিজছিল।
ঢাকা কাস্টমস এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের আইনবিষয়ক সম্পাদক কাজী আজমল হোসেন বলেন, "দুই সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও নতুন শেড তৈরি হয়নি, এটা দুঃখজনক। এতই সক্ষমতার অভাব?"
ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট বরিশাল এজেন্সির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রশিদুল হাসান বলেন, "দুটি ফ্লাইটের মাধ্যমে ইনসেপ্টার তিনটি কনসাইনমেন্ট (চালান) এসেছে গত চার দিন আগে। বহু খোঁজাখুঁজির পর আমরা মাত্র একটি পেয়েছি। বাকীগুলো এখনো পাইনি।"
ক্লিয়ারেন্সের বিলম্ব ঘিরে দোষারোপের পালা
কার্গো ক্লিয়ারেন্স জট দূর করতে ব্যবসায়ী সংগঠন, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক), বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ও কাস্টমস কর্মকর্তাদের মধ্যে একাধিক বৈঠক হলেও সমাধান আসেনি। প্রত্যেকেই এই জটের জন্য অপর পক্ষকে দায়ী করছে।
বেবিচক -এর চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মোস্তফা মাহমুদ সিদ্দিক টিবিএসকে বলেন, "কার্গো অপারেশন ২৪ ঘণ্টাই চলছে, কিন্তু কুরিয়ার প্রতিনিধি ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টরা বারবার অনুরোধ করার পরও পণ্য নিচ্ছেন না। ফলে কার্গো জমে যাচ্ছে। এনিয়ে আমরা কয়েকটা মিটিং-ও করেছি। আশা করি, দ্রুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।"
অন্যদিকে বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল এয়ার এক্সপ্রেস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কবির আহমেদ বলেন, সীমিত জায়গা ও প্রক্রিয়াগত জটিলতা কার্গো জট আরও বাড়িয়ে তুলছে। "একটি মাস্টার বিলের অধীনে থাকা কয়েকজন প্রতিনিধি উপস্থিত না থাকলে পুরো চালান আটকে যায়। আগে এয়ার এক্সপ্রেস কোম্পানিগুলোর নিজস্ব ওয়্যারহাউজ (গুদাম) ছিল, প্রতিনিধি না পাওয়া গেলে চালান সেখানে নিয়ে রাখা হতো। এখন ওইসব শেড আগুনে পুড়ে যাওয়ার পর—তা সেভাবে তৈরি হয়নি। ফলে কোথায় রাখবে?"
ঢাকা বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন রাগীব সামাদ বলেন, "আগে সরকারি ছুটির দিনে কার্গো কার্যক্রম বন্ধ থাকত, তবে এখন ৭ দিনই বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ, নিরাপত্তাকর্মী এবং বিমানের হ্যান্ডলিং টিম ২৪ ঘণ্টা কাজ করছে। ছুটির দিনগুলোতেও বিমানবন্দরের কর্মীরা সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে কুরিয়ার কোম্পানি ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের অনীহার কারণে প্রক্রিয়া ধীর হচ্ছে।"
"কুরিয়ার ও অন্যান্য সংশ্লিষ্টদের অনেকেই গভীর রাতে কাজ করতে আগ্রহী নন। এর ফলে রাতে ব্যাকলগ (অপেক্ষমাণ পণ্য) বেড়ে যাচ্ছে," যোগ করেন তিনি।
বাড়ছে ক্ষতি
বিজিএমইএ জানিয়েছে, বিমানবন্দরের আগুনে তাদের সদস্য কারখানাগুলোর সরাসরি ক্ষতি প্রায় ১০০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যালস ইন্ডাস্ট্রি জানিয়েছে, ৪৫টি ওষুধ কোম্পানির মোট ক্ষতি হয়েছে ১৬৫ কোটি টাকার বেশি; এরমধ্যে হেলথকেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের ক্ষতি ২৫ কোটি টাকা ও ইনসেপ্টার ২১.৫৫ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যাকসেসরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন বলেছে, তাদের সদস্যদের ক্ষতিও ১০০ কোটি টাকার বেশি হতে পারে।
ইন্টারন্যাশনাল এয়ার এক্সপ্রেস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এর একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, "প্রাথমিকভাবে সরাসরি ক্ষতির পরিমাণ ৮০০ কোটি টাকা হয়েছে বলে আমরা জেনেছি। তবে এর সূদূরপ্রসারী ক্ষতি হবে এক বিলিয়ন ডলারের উপরে।"
৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কার্গো সরানোর নির্দেশ
এদিকে পরিস্থিতি সমাধানে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন উপদেষ্টা এস কে বশিরউদ্দীন সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে নিয়ে গত রোববার একটি সভা করেছেন। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, আমদানিকৃত চালান ৪৮ ঘন্টার মধ্যে ডেলিভারি না নিলে তা পরবর্তীতে দাবি করা যাবে না।
এরপর বিজিএমইএ তাদের সদস্যদের জানায়, প্রায় ১,০০০ টন কার্গো ক্লিয়ারেন্সের অপেক্ষায় আছে এবং এগুলো ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সরিয়ে না নিলে নিলামে তোলা বা ধ্বংস করা হতে পারে।
শাহজালাল বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক রাগীব সামাদ বলেন, "এয়ারপোর্ট একটি ট্রানজিট এলাকা— পণ্য স্টক করে রাখার জায়গা নয়। যাদের নিজস্ব গুদাম আছে, তারা পণ্য আনলে দ্রুত ক্লিয়ার করে নিতে হবে।"
